আমাদের কথা বলতে দিতে হবে

সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারা দিন আমি যেন কম কথায় থাকি।

এটা হলো আমাদের প্রায় সবার পরিচিত ছোটবেলার নীতিকথার ছড়ার পরিচিত পঙ্‌ক্তির বর্তমানকালের সংস্করণ। ২৩ এপ্রিল প্রথম আলোর শেষ পাতায় ‘মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে আরও এক ধাপ পেছাল বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত খবর থেকে সবাই জেনে গেছেন, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের ২০২০ সালের মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে পৃথিবীর ১৮০টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ১৫১তম। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনের এই মহান বছরে আমাদের সংবাদমাধ্যম ও বাক্‌স্বাধীনতার এই অবস্থা!

গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ উঠলেই আমাদের নেতা-মন্ত্রীরা নিরবচ্ছিন্নভাবে কতগুলো সংখ্যা আউরে যান। প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের সংখ্যা সাংঘাতিক। কেবল সার্বক্ষণিক সংবাদ-টিভির সংখ্যা প্রায় এক ডজন। দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা শত শত। সাময়িকী, নিউজ পোর্টাল এবং আরও অনেক সংবাদমাধ্যম বেশুমার। অতএব, তাঁদের উপসংহার: গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বন্যায় দেশ ভেসে যাচ্ছে। ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী, আমাদের বাক্‌স্বাধীনতায় গিয়াছে ভরি। যত্তসব।

মন্ত্রী-নেতারা তো তত্ত্বকথার ধার ধারেন না। তা–ও বলি সংখ্যা সব সময় গুণের ইঙ্গিত দেয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংখ্যা থেকে গুণগত পরিবর্তন হতে পারে। যেমন ২০টি গাছ থাকলে সেটা হবে বাগান। কিন্তু গাছের সংখ্যা ১০ হাজার হলে সেটাকে আমরা বলি জঙ্গল বা বন। অর্থাৎ সংখ্যা বেড়ে গুণগত পরিবর্তন হয়ে বাগান থেকে জঙ্গল হয়। সাধারণ দৃষ্টিতে মাটি ভিজে জলাবদ্ধতা হয় আর গ্রামে-গঞ্জে জমি সাধারণত চাষবাসের আরও উপযুক্ত হয়। কিন্তু অতিবৃষ্টিতে পানি বন্যা তৈরি করে, যাতে হাজার হাজার এমনকি লাখ লাখ মানুষ প্রচণ্ড দুর্ভোগের শিকার হয়, এমনকি অনাহারেও মরতে পারে। এইখানেও বৃষ্টির পানির ফোঁটার সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়ে গুণগত পরিবর্তন ঘটায়। বৃষ্টির পানি হয়ে যায় বন্যা।

পাঠক আশা করি বুঝতেই পারছেন। সংখ্যা বাড়লেই মান বাড়ে না। কিন্তু এখন কেন জানি আমাদের সংখ্যায় পেয়ে বসেছে। আমাদের একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে সংখ্যা বাড়লেই গুণ ও মান বাড়বে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৮ হাজার থেকে বেড়ে ৩০ হাজারে উঠলে কিংবা বিভাগের সংখ্যা ৩০ থেকে ৮০–তে উন্নীত করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা বা অর্জিত জ্ঞানের গুণমান বাড়বে। আগেই বলেছি, আমরা এখন সংখ্যা রোগে আক্রান্ত। এই রোগের সংক্রমণ ঘটেছে কোভিড-১৯–এর অনেক আগে।

২.
মন্ত্রী-নেতারা সংখ্যার কথা যতই বলুন না কেন, সারা দুনিয়া জানে আমাদের দেশে বাক্‌স্বাধীনতা নেই বললেই চলে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের সূচক দেখে স্তম্ভিত হয়েছি। এমনকি প্রতিদিন যুদ্ধ চলা আফগানিস্তানের স্থানও সূচকে আমাদের চেয়ে ওপরে। ভুটান শুধু প্রাকৃতিকভাবেই নয়, এই সূচকেও তাদের অবস্থান আমাদের জন্য আকাশচুম্বী। একমাত্র সান্ত্বনা, আমাদের থেকেও নাকি খারাপ অবস্থায় আছে কয়েকটি দেশ। যেমন ইরান, কিউবা, ইরিত্রিয়া, চীন, তুর্কমেনিস্তান, উত্তর কোরিয়া ইত্যাদি।

এই সূচকে আমাদের নিচের দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের স্থায়িত্ব নিঃসন্দেহে বহু বহু বছর। অবশ্য দু-একটি দেশে ব্যতিক্রম থাকতে পারে। অর্থাৎ বেটা হয়তো আছে কুল্লে ১০ বছর। কিন্তু তার আগে বাপ হয়তো ছিল ২০ বছর।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা তথা বাক্‌স্বাধীনতা সীমিত করা আইনগুলোর কেন্দ্রে এসে জুটেছে একটা নতুন ধারণা। ‘ভাবমূর্তি’ রক্ষা করতে হবে, ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুণ্ন হতে দেওয়া যাবে না। যারা ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুণ্ন করবে বা ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করবে, তাদের নির্ঘাত জেলে পাঠাতে হবে। বিশেষ আদালত করা হয়েছে। দরকার হলে জেলে থাকবে দুই বছর। তারপর দেখা যাবে কোন ‘ভাবমূর্তি’ কীভাবে ক্ষুণ্ন করেছে।

মাস দুয়েক আগে বিবিসি রেডিওর খবরে শুনেছিলাম, তিন কাজিনকে পাকিস্তানের এক আদালত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। কিছুকাল আগে বিয়ের এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে ওই তিন পুরুষের নারী ‘কাজিন’রা ঘরের মধ্যে পরিবারের অন্য নারীদের সামনে নাচ–গান করেছিল। সেই নাচের ভিডিও করা হয়েছিল। ভিডিওগুলো কিছু লোকে দেখেও ছিল। এতে খানদানের ‘ভাবমূর্তি’ সম্পূর্ণ লুণ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। সেই কারণে ওই তিন পুরুষ পাঁচ নারী কাজিনকে হত্যা করেছিল। এই হত্যার দায়েই দোষী সাব্যস্ত করে আদালত তাদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন।

পাকিস্তানে ‘ভাবমূর্তি’ নষ্ট করার আইনে মৃত্যুদণ্ড আছে। আমরা এত খারাপ নই। আমরা কুল্লে ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রেখেছি।

ব্রিটিশরা আমাদের ভাবমূর্তির গুরুত্ব বা মূল্য কিছুই বোঝেনি। তাই তাদের আমলে (ব্রিটিশ আমলে) প্রণীত প্রধান ফৌজদারি আইন, যে আইনে সব ধরনের অপরাধ ও শাস্তির বিধান দেওয়া আছে সেই দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর সর্বমোট ৫১১টি ধারার মধ্যে মান-সম্মান অর্থাৎ, ভাবমূর্তি নিয়ে অপরাধের ধারা ছিল সর্বসাকল্যে একটি। সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ২ বছরের কারাদণ্ড। তদুপরি কোন ধরনের কথা বললে অর্থাৎ, বাক্‌স্বাধীনতার চর্চা করলে সেটা সেই ৪৯৯ ধারার অপরাধ হবে না, সেই ফিরিস্তিটা ছিল অনেক লম্বা। ফিরিস্তির শুধু একটা ব্যতিক্রম উল্লেখ করি: সরল বিশ্বাসে কোনো নেতার সমালোচনা করলে সেটা এই ধারার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না।

আগেই বলেছি যে ব্রিটিশরা আমাদের ভাবমূর্তির ঠেলা বোঝেনি। পাকিস্তানিরা পথ দেখাচ্ছে। আমরাও সেই পথে হাঁটি হাঁটি করে মধ্যযুগে ফিরে যাচ্ছি। ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা ছিল মধ্যযুগীয় ফৌজদারি আইনে ভীষণ অপরাধ। বিশেষত রাজা-বাদশাহ, জমিদার-নায়েব ও অন্যান্য রাজকীয় লোকজনের ভাবমূর্তি নষ্ট করলে শূলে চড়ানোর আইন ছিল না এমন কোনো দেশ বা সমাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন। খুব বড় দাগে বলতে গেলে বলা যায়, ১৮০০ সালের পর থেকে ইউরোপীয় দেশগুলোতে ও তাদের প্রভাবে উপনিবেশগুলোর আইনে ভাবমূর্তিজনিত অপরাধ তুলে দেওয়া হয়। ভাবমূর্তিকে ফৌজদারি আইন থেকে বাদ দেওয়ার মূল কারণ ছিল এ প্রসঙ্গে আইনের ধারার অপব্যবহার এবং অপপ্রয়োগ। কী কথায় ভাবমূর্তি নষ্ট হবে আর কী কথায় নষ্ট হবে না, সেটা অভিযোগকারীর খেয়ালখুশির ওপর নির্ভরশীল এবং ভাবমূর্তি কয় সের বা কয় মণ নষ্ট বা ক্ষতি হয়েছে, সেটা নির্ধারণে নির্মোহ পদ্ধতি অসম্ভব। এত কিছু বুঝে আইন তো আমরা করি না। নেতার গায়ে যাতে কোনো আঁচড় না লাগে, সেটাই আমাদের পরম ও চরম কামনা।

৩.
অমর্ত্য সেনের কিছু কথায় এই অধমের আস্থা আছে। সাদামাটাভাবে যতটুকু বুঝি তা হলো গণতান্ত্রিক দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না। ১০০ বছরে একটা–দুটো ব্যতিক্রম হলেও হতে পারে। কারণ, অর্থনীতি পদার্থবিদ্যা বা রসায়নশাস্ত্রের মতো বিজ্ঞান নয়। অর্থনীতি সমাজবিদ্যা। অবশ্য ইদানীং আমাদের একটা রায়ে আইনবিদ্যাকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার চেষ্টা আছে। এই করোনাকাল দীর্ঘায়িত হলে দুর্ভিক্ষ যে হবে, সে কথা বহু সমাজবিদ বলছেন। বলা বাহুল্য, বাক্‌স্বাধীনতা হলো গণতন্ত্রের মূল কথা। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে আমাদের ১৫১তম স্থান আমাদের গণতন্ত্রের যে মাত্রার দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়, সেই মাত্রায় দুর্বলতা চলতে থাকলে দুর্ভিক্ষ রোধ করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে।

আমাদের কথা বলতে দিতে হবে। মন খুলে কথা বলব। সমালোচনা করব। আজেবাজে লোকজনের সমালোচনা করব না। যাঁরা সমালোচনা শুনে নিজেকে শুধরে বা অন্য কোনো পন্থায় কাজ করে দেশ ও দশের আরও বেশি মঙ্গল করতে পারেন, শুধু তাঁদের সমালোচনা করাই অর্থবহ। সব সমালোচনাই তাঁরা আমলে নেবেন এমন ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। অনেক সমালোচনাই অর্থহীন হতে পারে, কিন্তু আমাদের সমালোচনা করতে দিতে হবে। কারণ, গণতন্ত্র ও বাক্‌স্বাধীনতাহীন দেশ মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।

ড. শাহদীন মালিক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক