সরকারি কর্মকর্তারা এই ছুটিতে যা করতে পারেন

করোনাভাইরাসের কারণে প্রথম দফায় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি দেওয়া হয়েছিল। এরপর সর্বমোট ৫ দফায় ছুটি বাড়ল ৫ মে পর্যন্ত। মোট ছুটি ৪০ দিন। এত দীর্ঘ ছুটিতে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীরা কী করবেন? ঘরের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়, এমনকি অতিথি আপ্যায়ন করা বা অতিথি হওয়াও সম্ভব নয়। বই পড়া, টিভি, নেটফ্লিক্স অন্যান্য বিনোদন, ফেসবুকে বিচরণ একসময় ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, গৃহস্থালি কাজ, ফোনালাপ, ধর্মকর্ম করেও সময় আর শেষ হয় না। তাই সময়ের উৎকৃষ্ট ব্যবহারের জন্য কিছু হোমওয়ার্ক প্রস্তাব করছি।

হোমওয়ার্কের বিষয়

আমাদের দেশে সরকারব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিমানবন্দরে বিদেশফেরত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিনে রাখা, তঁাদের সংস্পর্শে আসা লোকদের চিহ্নিত করা, ডাক্তার ও স্বাস্থ্যসেবীদের পিপিই প্রদান, সংক্রমণ শনাক্তকরণ পরীক্ষা, চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল, ভেন্টিলেটর সরবরাহ ও দুস্থদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যর্থতা সরকারব্যবস্থা ভেঙে পড়ার অল্প কয়েকটি নমুনা। সরকারব্যবস্থার অনেক উন্নতির সুযোগ রয়েছে। তাই হোমওয়ার্কের বিষয় হবে সরকারব্যবস্থার উন্নয়ন ও সংস্কার। হোমওয়ার্কের দুটি অংশ থাকবে।

প্রথম অংশ

সরকারি কর্মকর্তারা নিজ নিজ দপ্তরে যে সেবাটি প্রদান করেন তা কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে প্রস্তাব প্রণয়ন করবেন। এর প্রথম লক্ষ্য হবে দুর্নীতি হ্রাস। দুর্নীতি বেড়েই চলেছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবীদের মধ্যে এন-৯৫ মাস্কের পরিবর্তে নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহ এর সাম্প্রতিক উদাহরণ। তাই দুর্নীতি হ্রাস করতে হবে। যাঁরা দুর্নীতিতে লিপ্ত, তাঁরাও এ বিষয়ে প্রস্তাব করবেন। কেননা, কোনো সরকারি কর্মকর্তা চিরদিন স্বপদে থাকবেন না।

দ্বিতীয় লক্ষ্য হবে সেবা প্রদানের গতি বাড়ানো, দীর্ঘসূত্রতা কমানো। বিশ্বব্যাংকের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স ২০২০ অনুযায়ী বাংলাদেশে একটা নতুন ব্যবসা শুরু করতে লাগে ১৯.৫ দিন। একই কাজ করতে শ্রীলঙ্কায় লাগে মাত্র ৮ দিন। শুধু ব্যবসা শুরু করা নয়, জমির মালিকানা হস্তান্তর, বন্দর থেকে পণ্য খালাস, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ, এমনকি আদালতে বিচার পেতেও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের দ্বিগুণ–তিন গুণ সময় লাগে। এর ফলে উৎপাদন ব্যয় ও দ্রব্যমূল্য বাড়ছে এবং বৈদেশিক বাজারে প্রতিযোগিতায় আমাদের সক্ষমতা কমছে। তাই এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হবে।

এ–সম্পর্কিত আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে সেবাপ্রার্থীদের বারবার সরকারি দপ্তরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা কমানো। সবচেয়ে ভালো হয় সেবাপ্রার্থী যদি ঘরে বসেই সরকারি সেবা পেতে পারেন। ডিজিটাল ব্যবস্থার সম্প্রসারণের ফলে এখন এটা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব। যেমন, চলমান ছুটিতে আমরা অনলাইন ব্যাংকিং ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করে টাকা আদান–প্রদান করছি। একান্তই যদি সরকারি দপ্তরে যেতে হয়, তাহলে একই কাজের জন্য দুবারের বেশি যেন যেতে না হয়। বারবার সরকারি দপ্তরে যেতে সেবাপ্রার্থীর খরচ, রাস্তায় যানজট, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর অযথা কাজ বাড়ে। তাই এটা হবে তৃতীয় লক্ষ্য।

চতুর্থ লক্ষ্যটি হবে সেবা প্রদানসম্পর্কিত ব্যয় হ্রাস। এটা করতে হবে সরকারি কেনাকাটায় অনিয়ম রোধ করে। সরকারি সেবার ব্যয় বৃদ্ধির এটা অন্যতম প্রধান কারণ। রূপপুরের বালিশ–কাণ্ড থেকে শুরু করে মেগা প্রকল্পের ব্যয় পর্যন্ত সর্বত্রই এর বিস্তার। আরেকটি কারণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনবল। সার্বিকভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারি জনবল বহুলাংশে হ্রাস করা ও সেবার মান উন্নত করা সম্ভব।

পঞ্চম লক্ষ্যটি হবে সরকারি সম্পদের যথাযথ ব্যবহার। ‘সরকার কি মাল দরিয়ামে ঢাল’ মানসিকতা থেকে কীভাবে বের হওয়া যায়।

ষষ্ঠ লক্ষ্যটি হবে সরকারি বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন। সম্প্রতি আমরা সমন্বয়হীনতার কুফল দেখেছি। অফিস বন্ধ করে যানবাহন খোলা রেখে সামাজিক দূরত্ব ব্যাহত করে করোনাভাইরাসকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হলো। আবার পোশাকশ্রমিকদের অমানবিকভাবে ঢাকায় ফিরিয়ে এনে বলা হলো, কারখানা বন্ধ থাকবে। পোশাকশ্রমিকদের বেতন পরিশোধের ক্ষেত্রেও একই অব্যবস্থা।

সর্বশেষ লক্ষ্যটি হবে অন্যান্য কী উপায়ে সরকারি সেবার মান উন্নয়ন করা যায়। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগের সুযোগ থাকবে।

দ্বিতীয় অংশ

দ্বিতীয় অংশের লক্ষ্যগুলোও হবে অভিন্ন। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী অন্য যে দপ্তরের সঙ্গে তাঁর কাজের সম্পর্ক আছে, সে দপ্তরের কার্যক্রম উন্নয়ন বিষয়ে প্রস্তাব দেবেন। কারণ, আমরা সবাই নিজের কাজের চেয়েও অন্যের কাজ ভালো বুঝি। তাই এমনকি গ্রামের চায়ের দোকানে ম্যাচ চলাকালে বা পরে সাকিব আল হাসানকে কীভাবে তাঁর ক্রিকেট খেলা উচিত ছিল, সে বিষয়ে পরামর্শ দিতে শুনি। তবে যেহেতু নিজের কাজ সম্পর্কে সবাই বেশি অবগত হওয়ার কথা, তাই এই অংশের গুরুত্ব হবে তুলনামূলকভাবে কম।

মূল্যায়ন

ওপরের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে একটি প্রশ্নমালা তৈরি করে সব সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীকে পাঠাতে হবে। অনলাইনে তাঁরা তঁাদের প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত ই–মেইল ঠিকানায় অথবা এ ব্যাপারে প্রস্তুতকৃত বিশেষ অ্যাপের মাধ্যমে ৫ মে ছুটি শেষ হওয়ার আগেই পাঠাবেন। সবাইকে প্রস্তাব পাঠাতে হবে। যাঁরা পাঠাবেন না, তাঁদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে তা বিরূপ মন্তব্য হিসেবে বিবেচিত হবে।

ডেটা প্রসেসিং ও অর্থায়ন

বাংলাদেশে কমবেশি ১৫ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছেন। তাই এ ক্ষেত্রে তথ্যভান্ডার হবে বেশ বড়, যাকে আমরা বিগ ডেটা বলে থাকি। এ জন্য পাইথন, এমআইটির ব্যবহৃত জুলিয়া প্রভৃতি ও প্রস্তাব বাস্তবায়ন পর্যায়ে ব্লকচেইনসহ অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। এর ব্যয়ভার সরকার নিজে বহন করলে সবচেয়ে ভালো হয়। তবে করোনাভাইরাসের কারণে সরকার অর্থসংকটে আছে। এ ক্ষেত্রে অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ অনেকেই আগ্রহী হবে।

বাস্তবায়ন

ডেটা প্রসেসিং করে এর ফলাফল সংকলন করে একটি ওয়েবসাইটে জনসমক্ষে প্রচার করতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, বেসরকারি খাত, এনজিও ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি প্রস্তাবগুলো বিবেচনা ও বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করবে। তাঁরা বাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাবের প্রণেতা সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কাছে বিশদ জানতে চাইতে পারেন। সরকারের বাইরের যোগ্যতাসম্পন্ন কেউ এ কমিটির প্রধান হতে পারেন। যাঁদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য গৃহীত হবে, তাঁরা দ্রুত পদোন্নতি, গুরুত্বপূর্ণ পদায়ন, আর্থিক পুরস্কার, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবেন।

করোনাভাইরাস–পরবর্তী বিশ্ব নিঃসন্দেহে পাল্টাবে। আমাদের জীবনযাত্রা, সরকারের কর্মপদ্ধতি সবই বদলাতে হবে। সে জন্য এখনই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।

সরকার, বিশেষত মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিব বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ