ফজলে হাসান আবেদের অনুপস্থিতি টের পাচ্ছি

স্যার ফজলে হাসান আবেদ
স্যার ফজলে হাসান আবেদ

তাঁর জন্মদিন ছিল বলে তাঁকে মনে করে অনেকেই পোস্ট দিয়েছেন। সাধ্যমতো স্মরণ করেছেন তাঁকে। তাঁর সঙ্গে তোলা ছবি ইত্যাদি দিয়েও ফেসবুক-টুইটারে নানাভাবে এই করোনাকালে তাঁকে মনে করেছেন। তবে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি থেকেই যাঁরা আসন্ন সংকটের কথা আঁচ–অনুমান করতে পেরেছিলেন, তাঁরা অনুভব করেছেন ফজলে হাসান আবেদের অনুপস্থিতি। মনে করছিলেন তাঁর কথা, সে মনে করার সঙ্গে কোনো তারিখ বা দিবসের সম্পর্ক ছিল না। সম্পর্ক ছিল প্রয়োজনের, 'চলুন দেখি আবেদ ভাই কী বলেন?' এ কথা বলে শোকে-সংকটে-প্রয়োজনে দল বেঁধে একটা গঠনমূলক পরামর্শ একটা দিকনির্দেশনার জন্য বছরের পর বছর তাঁর কাছে ছুটে যাওয়া মানুষগুলো যেন দিশা হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁদের মধ্যে উন্নয়নকর্মী যেমন আছেন, তেমনি আছেন সরকারি কর্মকর্তা, নানা পেশার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। আবেদ ভাইয়ের ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব লিখেছিলেন, 'নিজস্ব মডেল প্রবর্তন না করেও তিনি প্রচলিত মডেল বা সরকারি উদ্যোগকে কার্যকর করতে ব্রতী হয়েছেন।' সরকারি ইপিআই (সর্বজনীন টিকাদান) প্রকল্পের সাফল্য আসে ব্র্যাকের সহায়তায়। শুধু কি টিকা প্রকল্প? সরকারের ভেতরে না থেকে সরকারের নানা উদ্যোগকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করেছেন নানাভাবে। 


বেশি দিন আগের কথা নয়। পিপলস হেলথ মুভমেন্টের চতুর্থ বিশ্ব সমাবেশের আয়োজন হয়েছিল ঢাকায় ২০১৮ সালের নভেম্বরে। প্রধান আয়োজকের ভূমিকায় ছিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। প্রায় বছর তিনেকের প্রস্তুতি আর শ্রম দিয়ে আয়োজিত সেই সম্মেলন প্রায় শেষ ধাপে এসে ভন্ডুল হয় হয়। বিদেশ থেকে অনেক অংশগ্রহণকারী ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক আসতে শুরু করেছেন। এসব আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যাঁরা আসেন, তাঁদের চিন্তা থাকে দেশটাতে যখন যাচ্ছিই, তখন আরও কয় দিন থেকে আরও কিছু দেখে আসব। কেউ আগে আসেন কেউ পরে যান। ড. জাফরুল্লাহর তখন ঘোর শনির দশা। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র টোটাল 'লকডাউন'। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে কে বা কারা যেন শুরু করেছিল গণস্বাস্থ্য ভাঙো জাফরুল্লাহ খেদাও আন্দোলন।
বাংলাদেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, কলেরা রোধের সাফল্য, মা ও শিশু স্বাস্থ্যের অভূতপূর্ব উন্নতি, টিকা কর্মসূচির বিস্তার, জন্মনিয়ন্ত্রণের সফল প্রসার—এসব দেখতে জানতে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এক শর বেশি প্রতিনিধি ততক্ষণে রওনা হয়ে গেছেন ঢাকার উদ্দেশে। আয়োজকেরা দল বেঁধে ছুটে যান আবেদ ভাইয়ের কাছে। তিনি পথ বাতলে দেন। সম্মেলন অনুষ্ঠানের জায়গা করে দেন। আয়োজকেরা এতটুকুই চেয়েছিলেন। তিনিই মনে করিয়ে দেন কীভাবে হবে অংশগ্রহণকারীদের আনা-নেওয়া। নিজেই হিসাব করে দেখিয়ে দেন কয়টা বাস কখন, কোথায় লাগবে। ব্যবস্থা করেন বাসের। তাঁর কথা একটাই ছিল, এতগুলো দেশ থেকে এত মানুষ আসবেন, তাঁরা যেন আমাদের সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা নিয়ে দেশে ফেরেন। প্রতিদিন ব্যক্তিগতভাবে খোঁজখবর রেখেছেন। প্রায় ভেস্তে যাওয়া একটা অনুষ্ঠান একা হাতে উঠিয়ে দেন।
তাঁকে অনেকেই প্রশ্ন করতেন কীভাবে আর কেন তিনি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কথা ভাবলেন। মানুষের পক্ষে এটা মনে করা স্বাভাবিক। গিয়েছিলেন স্কটল্যান্ডে নৌ-স্থাপত্য বিষয়ে পড়তে। বাদ দিয়ে লন্ডনে এসে সিএ পাস করে হলেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। ভালো চাকরি, নির্ভার জীবনের হাতছানি সবই ছিল। অনেকে মনে করেন সত্তরের ঘূর্ণিঝড় আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ না হলে তিনি ব্র্যাক গড়ে তুলতেন না। এসবেই ধারণার কথা, তবে তিনি যেসব সময়ই অন্য কিছু করতে চেয়েছেন, সেটা কোনো ধারণার কথা নয়। তিনি তখন লন্ডনে ছাত্র, কাগজে দেখলেন একটা প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দিয়ে টাকা চইছে। ক্ষুধার্ত গরিব মানুষের জন্য তারা কাজ করতে চায়। একটু অন্য রকম বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনটা ছিল অক্সফামের। অক্সফাম ১৯৪০ সাল থেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই অধিকৃত ও মুক্ত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাজ করে বেশ সমীহের একটা জায়গা করে নিয়েছিল মানুষের মনে। আবেদ ভাই পাঠিয়ে দিলেন ১০ পাউন্ড। প্রাপ্তি স্বীকার পেলেন। তারপর ভুলে গেলেন।
এক বছর পর অক্সফাম থেকে ডাকে একটা খাম পেলেন তাদের হিসাবের বয়ান অডিট রিপোর্ট। সিএর ছাত্র স্যার ফজলে হাসান আবেদ বিস্মিত হয়েছিলেন সামান্য ১০ পাউন্ডের কাছে এই জবাবদিহির কালচার দেখে। তাঁর কাছেই শোনা। এরপর তাদের কাজে তাঁর আগ্রহ বাড়ে, চিঠি লেখেন, খোঁজখবর নেন। জানতে চান তারা কেন পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করে না। এসবই ছিল তাঁর প্রস্তুতির একটা অংশ। ওই যে তরুণ বয়সে যে জবাবদিহি তাঁকে বিস্মিত করেছিল, সারা জীবন তিনি সেটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। পৃথিবীতে বোধ হয় ব্র্যাকই একমাত্র বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠান, যাকে এখন টাকার জন্য আলাদা করে প্রজেক্ট প্রপোজাল লিখতে হয় না। আর্থিক শৃঙ্খলা আর স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে ব্র্যাক এখন একটা উদাহরণ। অনেকেই বলেন, আবেদ ভাই সিএ ছিলেন বলে সেটা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ইচ্ছা বা নিয়তটাও জরুরি।
স্যার আবেদ ১৯৭২ সালে প্রথম অনুদান পেয়েছিলেন অক্সফাম থেকে। লন্ডন থেকে ঢাকায় আসার পথে কলকাতায় নেমে তাঁকে টাকাটা নিতে হয়েছিল। অক্সফামের যে প্রতিনিধি কলকাতা অফিসে তাঁকে টাকাটা দিয়েছিলে,ন সেই জুলিয়াস ফ্রান্সিস এখন ঢাকারই বাসিন্দা। তিনি জানালেন, সে সময় বাংলাদেশ ত্রাণ আর গৃহ নির্মাণের জন্য আরও অনেক তরুণ উদ্যোক্তা আর প্রতিষ্ঠানকে অর্থ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হিসাব চেয়ে আবেদের কাছে কখনো চিঠি লিখতে হয়নি, উল্টো আমাদেরই তিনি অনেক সময় মনে করিয়ে দিয়েছেন। এই স্বচ্ছতায় তাঁকে দিরাইয়ের ছোট্ট শালনা থেকে শুরু করে আজ পৃথিবীর ১১টি দেশের ১২০ মিলিয়ন মানুষকে বিভিন্ন সেবা সেবা পৌঁছে দেওয়ার ভিত্তি করে দিয়েছিল। ২০১৬ সালে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে স্যার আবেদ বলেছিলেন, 'আমি আমার কাজটা করার চেষ্টা করেছি।' তিনি নেই কিন্তু তাঁর এ কথা আমরা অনুসরণ করে আমাদের যার যা কাজ যদি ঠিকভাবে করার চেষ্টা করি, তাহলে করোনাকালে উত্তরণ কঠিন কিছু নয়। ধন্যবাদ আবেদ ভাই।
লেখক গবেষক
[email protected]