জামিলুর রেজা চৌধুরীর একটি অন্তিম আহ্বান

জামিলুর রেজা চৌধুরী
জামিলুর রেজা চৌধুরী

দিনটি ছিল ২৯ মার্চ। প্রকৌশলী মো. হাশমতউজ্জামানের ফোন রেখেই স্যারকে (অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী) ফোন দিই। বললেন, 'ওঁকে একটা দায়িত্ব দিয়েছিলাম। কম খরচে ভেন্টিলেটর তৈরি করার জন্য। বুয়েটের একটি টিম কাজ করছে। এর ফিডব্যাক এখনো পাইনি।' বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের কোনো একজন। স্যার নাম মনে করতে পারেননি। ওই শিক্ষক জানতে চেয়েছিলেন, প্রকল্প করতে বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন থেকে টাকাপয়সা দেওয়া যাবে কি না। স্যার বলেছিলেন, 'টাকাপয়সা দিতে পারব। খরচ যা লাগে। আমি সেই অধ্যাপকের নাম পাঠাচ্ছি। ইউ ক্যান টক টু হিম।'

বললাম, 'ভেন্টিলেটর নিয়ে আপনার ভাবনা কী?' স্যার বললেন, 'বুয়েটের ওরা কাজ করছে। আর হাশমত তো এয়ার কন্ডিশনিংয়ের লোক। বিষয়টি তার জানা। আবার এমআইটি (ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি) একটি ডেভেলপ করেছে, যেটা লো কস্ট ভেন্টিলেটর, পোর্টেবল। ওটারও ড্রয়িং দিয়েছিলাম। তারপর আর কিছু শুনি নাই, কী হলো।' আরও বললেন, 'কেবল এমআইটি নয়। আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় করেছে। যারা এয়ার কন্ডিশনিং, হিটিং ভেন্টিলেশন নিয়ে কাজ করে, তাদের এটা কাজে লাগবে।'

আমি এ নিয়ে কার সঙ্গে কথা বলতে পারি। উত্তরে বললেন, 'বারডেমে একজন বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আছেন। নাম বলতে পারব না। মিটিংয়ে দেখা-টেখা হয়। ওরা জানতে পারে।' বললেন, 'এখন আমরা একটা স্টেজ পার করছি। যদি আরও বাড়তে থাকে, দেয়ার উড বি নিড ফর লার্জার নাম্বার অব ভেন্টিলেটরস (আরও অনেক বেশি ভেন্টিলেটর প্রয়োজন)।'

বললাম, 'আমরা কেউ চাই না, সেদিকে পরিস্থিতি যাক।' স্যার বললেন, 'আমরা না চাইলেও একটা নেচারাল প্রজেক্টরি ফলো করবে। সেদিকে যাওয়ার সম্ভাবনাই অনেক বেশি। বাংলাদেশে যদিও আমরা আজকে বলি জানি না। কিন্তু কালকে বলছিল, ফোরটি নাইন। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য নাম্বার, নাকি আরও বেশি আছে।'

বললাম, 'এটা তো যতটা টেস্ট করছেন, তার মধ্যে পাচ্ছেন। কিন্তু শনাক্ত করার সংখ্যা তো খুব বেশি নয়। মীরজাদি সেব্রিনা (আইইডিসিআরের পরিচালক) বললেন, “গত ২৪ ঘণ্টায় ৪২ জনের করেছি, তার মধ্যে কাউকে পাইনি।” এখন ৪২ না করে পরীক্ষা ১০০ জনে করা যেত।' স্যার হেসে বললেন, 'সেটাই। এটা হলো তারা একটা ছোট স্যাম্পল নিয়ে কাজ করছে, তার মধ্যে, এর বাইরে কত থেকে যাচ্ছে, সেটা তো...। আর যেভাবে ট্রিট করে শুনলাম। আইইডিসিআরে টেলিফোন করলে খুব ভালো ট্রিটমেন্ট করে না। সুতরাং অনেকে সেখানে যায়ও না বোধ হয়।'

বললাম, 'ফ্লোরিডার একটি হাসপাতালে কোভিড-১৯-এর চিকিৎসারত একজন বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ (ড. রুমি আহমেদ খান) আমাদের বলেছেন, তাঁরা ডাবল টেস্ট করছেন। নেগেটিভ যার এল তাকে ২৪ ঘণ্টা ব্যবধানে দ্বিতীয় টেস্টের জন্য আসতে বলা হচ্ছে।'

এ কথার পিঠেই স্যার বললেন, 'আমাদেরটা জানি না। তবে গণস্বাস্থ্যেরটা হলে হয়তো কিছুটা এগোত। আজকে তো হোম মিনিস্টার ইন্টারভেন করে এটা চালু করতে চাচ্ছেন বোধ হয়। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর যেটা।' বললাম, 'তিনি একটা কিট উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীদের দিয়ে।' স্যার বললেন, 'হ্যাঁ, ওটার মাধ্যমেই তো আইডেনটিফাই করে। ওটা হলো ইউ হ্যাভ টু ওয়েট ফর থ্রি ডেজ।' বললাম, 'এটা একটা সীমাবদ্ধতা।' স্যার বললেন, 'বাট হুইচ টাইম হি মাইট হ্যাভ ট্রান্সমিটেড টু সাম আদার পিপল (কিন্তু এর মধ্যে তো ভাইরাস অন্য লোকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে)।' এদিন এ বিষয়ে এখানেই কথার ইতি টানলেন। বললেন, 'আমি বুয়েটের একজনের ফোন নাম্বার দিচ্ছি।'

পরদিন ৩০ মার্চ স্যারকে আবার ফোন দিই। বললাম, 'ড. জাহিদ ফেরদৌসের (বায়োমেডিকেল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক) সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, তাঁরা নতুনভাবে কোনো ভেন্টিলেটর উদ্ভাবন বা তৈরি করছেন না। ভেন্টিলেটরের কর্মক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন।' স্যার বললেন, 'মাল্টিপল ইউজার এই তো?' বললাম, 'জি।'

জাহিদের কথায়, একটি ভেন্টিলেটর একজনকেই ব্যবহার করতে হয়। চরম সংকটে দুজনের যাতে চলে, সেটা তাঁরা ডিজি হেলথকে বাতলে দেবেন। (১ মে বললেন, দিয়েছেন) তখন বলি, স্যার আপনি বুয়েট অ্যালামনাই থেকে তহবিলের কথা বলছিলেন। স্যারকে বললাম, 'আমরা একটি ভিডিও ('বাড়িই হতে পারে করোনা হাসপাতালের বিকল্প', ১ এপ্রিল) করছি। এর লক্ষ্য হলো লো কস্ট কোভিড হাসপাতাল বা করোনা সেবাকেন্দ্র তৈরি করা। এ বিষয়ে আপনার একটি বক্তব্য দিতে চাই।'

স্যার বললেন, 'যদি কোভিড-১৯-এর আরও বেশিসংখ্যক আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়, যাঁদের হাসপাতালে নিতে হবে এবং তাঁদের আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে, তাহলে আমাদের সামনে যন্ত্রের একটা অপ্রতুলতা দেখা দিতে পারে। সেটা কীভাবে সমাধান করা যায়, সে জন্য বুয়েট অ্যালামনাই বুয়েটের সাথে, আমাদের যারা প্রাক্তন ছাত্র আছে তাদের সাথে একটা উদ্যোগ নিচ্ছে। কীভাবে দ্রুত আমাদের ক্যাপাসিটি বাড়ানো যায়।'

বললাম, 'আর কিছু?' স্যার যুক্ত করলেন, 'বুয়েট অ্যালামনাই তো সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে আছে। তাদেরও সহায়তা চাচ্ছি এ জন্য।' বললাম, 'আপনার এই আহ্বান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কোভিড-১৯ রোগীর যেখানে চিকিৎসা (কম খরচে) হবে, সেখানে দূষিত বায়ু নির্গমনের যে ব্যবস্থা (নেগেটিভ ফ্লো রুম), সেটা কম খরচে লাগবে।'

স্যার বললেন, 'হ্যাঁ, হাসপাতালে যদি জায়গা না হয়, বেড শর্টেইজ হয়, তাহলে কীভাবে বাড়ির ভেতরেই একটা কক্ষকে বদলে নেওয়া যায়, যাতে ভেতরের দূষিত বাতাস বাইরে না যায়, সেটারও একটা ডিজাইন, আমাদের একজন প্রকৌশলী (হাশমতউজ্জামান) তৈরি করেছেন। এটাকে নেগেটিভ প্রেশার বলে।' বললাম, 'বিশেষজ্ঞদের মত হলো, বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তে এটা সবচেয়ে কাজের কথা। এর জন্য বিদেশ থেকে কিছু আমদানি করতেও হবে না। স্থানীয়ভাবে কম খরচে এটা করা যাবে। আপনার কি তাই মনে হয়? 'স্যার বললেন, 'আমার তা-ই মনে হয়। একটা তো হলো আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু আমাদের তো অবিলম্বে দরকার।'
এই পর্যায়ে বলি, 'স্যার আপনি হাসপাতাল ব্যবহারের দিক থেকে সার্বিকভাবে এবারে বলুন। এখান থেকে আপনার কণ্ঠ আমরা ব্যবহার করব। আপনি এক-দুই মিনিট বলুন।' স্যার এবারে স্বকণ্ঠে একটা আনুষ্ঠানিকতার মিশেলে বললেন:

'বাংলাদেশে সৌভাগ্যবশত আমাদের সংখ্যা, কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত, খুব একটা বেশি হয় নাই। কিন্তু যদি বেড়ে যায় হঠাৎ, অনেকে যেটা আশঙ্কা করছেন যে সংখ্যাটা বেড়ে যেতে পারে। তখন আমাদের অনেক স্বল্পতা হবে যেইগুলো, হাসপাতালে বেড পাওয়া যাবে না এবং যেই সাপোর্ট, যন্ত্রপাতি, সেইগুলো বাড়ানোর একটা চেষ্টা যে আমরা করছি, বুয়েট অ্যালামনাই থেকে এবং কিছু কিছু ডিজাইন বিশেষ করে বাইরে যাঁরা খুব স্বল্প ব্যয়ে এই যন্ত্রপাতি বানানোর চেষ্টা করছেন, সেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্য নিয়ে আর আমাদের যে, হাজার হাজার বুয়েট অ্যালামনাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁদের দক্ষতা আছে, তাঁদের সহায়তা নিয়ে আমরা এ দেশকে সাহায্য করতে চাই, বুয়েট অ্যালামনাইয়ের পক্ষ থেকে, যাতে আমাদের এই অভাবটা আমরা খুব দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারি।'

স্যার বললেন, 'ঠিক আছে?' বললাম, 'জি স্যার। আপনাকে ধন্যবাদ।' ফোন কেটে যাওয়ার আগে অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল: 'ওকে থ্যাংক ইউ।'
৩০ মার্চের বিকেল পৌনে পাঁচটায় এবং চিরকালের জন্য আমাদের সঙ্গে এটাই স্যারের শেষ কথা। কারিগরি কারণে স্যারের ভয়েস টেপটি অব্যবহৃত থেকে যায়।

মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে স্যার বুয়েটের শিক্ষকদের সঙ্গে জুম মিটিংয়ে বুয়েট কী করতে পারে, তা নিয়ে কথা বলেন। এক কোটি টাকার করোনা তহবিলে সায় ছিল তাঁর। স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীদের সুরক্ষায় দুটি আলাদা ডিভাইস তৈরিতে ছিল তাঁর অন্তিম আগ্রহ। আলট্রাভায়োলেট রে দিয়ে স্টেরিলাইজেশন বক্স করা। এটা পিপিই ও মাস্ক ক্লিন করবে। বারবার ব্যবহারে কাজে দেবে। অন্যটি হলো কম খরচে এন-৯৫-এর বিকল্প মাস্ক তৈরি করা। যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে এর মডেল চূড়ান্ত করেছে। কিছু সামগ্রী চীন থেকে আনা লাগবে।
বুয়েটিয়ানদের কাছে জাতির প্রত্যাশা বেশি। তাঁরা দ্রুত কিছু করে দেখালে স্যারের অন্তিম স্বপ্ন পূরণ হবে।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক।
[email protected]