গার্মেন্টসশ্রমিকেরা কি দেশের নাগরিক?

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

কয়েক বছর আগের একটা গবেষণার কথা। একজন পোশাকশ্রমিক কারখানার দুর্ব্যবস্থা, অন্যায়, অত্যাচারের কথা বলে আমাদের একজন মাঠ গবেষককে একটা প্রশ্ন করলেন: আমরা কি এই দেশের নাগরিক না? তাহলে আমাদের সঙ্গে এই আচরণটা কেন? প্রশ্নটা সেই থেকে মাথার ভেতর ঘুরছিল। খুব সাধারণ প্রশ্ন। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের সবারই কিছু অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান আমাদের দেয়। জানি না আমাদের মাঠ গবেষক সেই শ্রমিক ভাইকে কী উত্তর দিয়েছিলেন। তবে সম্প্রতি প্রশ্নটার একটা উত্তর আমি পেয়েছি।

মনে আছে, সাক্ষাৎকারটির বিস্তারিত শুনে খানিকটা হতাশও হয়েছিলাম। কারখানার মালিক ও মালিকের গুন্ডা বাহিনীর অত্যাচারের কথা তিনি বলেছিলেন। সে রকম কথা সেবার মাঠকর্ম করতে গিয়ে আরও অনেকের মুখেই শুনেছিলাম। কখনো কখনো এসব বিবরণ বিশ্বাস করাও কঠিন ছিল।

কিন্তু শ্রমিক ভাইটি এসব বলার পাশাপাশি শ্রমিক সংগঠন নিয়েও তাঁর একটা খারাপ অভিজ্ঞতার কথাও বলেছিলেন। বলেছিলেন, কোথাও বিচার দিয়েও কোনো লাভ হয় না। তিনি কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। শুধু একটা কথাই বলছিলেন (সেটাও হয়তো সাক্ষাৎকারটাকে আর পাঁচটা সাক্ষাৎকার থেকে আলাদা করেছিল আমার কাছে): শ্রমিকের ভালো যদি কেউ করতে পারে, সেটা সরকার। সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে ইত্যাদি।

নিজে উপস্থিত ছিলাম না, তাই আলাপটাতে সরাসরি অংশ নেওয়া হয়নি। আজ অনেক দিন পর মনে হলো শ্রমিক ভাইটিকে একটা উত্তর দিই। যেই দুঃখজনক সত্যটি সেদিন বলা হয়নি, সেটি হচ্ছে আপনি আসলে এই দেশের নাগরিক নন! আমি-আপনি এই একই দেশের আলো–বাতাসে বড় হলেও আমরা যেন আর এক দেশের নাগরিক নই। করোনা অতিমারির এই সময়ে সেই সত্যটাই যেন প্রকট হয়ে পড়ল। দেখেন ভাই, আপনার জন্য এক নিয়ম, আমার জন্য আরেক নিয়ম। আপনি কাজ করবেন কারখানায়, আর আমি ঘরে বসে ‘সামাজিক দূরত্ব’ (কথাটা হবে দৈহিক দূরত্ব) উদ্‌যাপন করব।

দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক বিকাশ আলোচনা করতে গিয়ে নৃবিজ্ঞানী আইহা অং বিভিন্ন ধাপ ভিত্তিক স্বাধীনতার ধারণা ব্যবহার করেছিলেন। মূলত এই দেশগুলোতে নব্য উদারনৈতিক অর্থনীতির দ্রুত বিকাশের স্বার্থে কীভাবে সেখানকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে (যেমন মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে মালয়দের) এক ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, আবার সেখানে বসবাসকারী চাইনিজদের আরেক ধরনের এবং মূলত দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য ভীষণ অমানবিক শর্ত সাপেক্ষে কাজ করার সুযোগ দিয়ে সেই দেশের অর্থনীতিকে ত্বরান্বিত করবার চেষ্টা করা হয়েছিল, তারই বিশদ বিবরণ রয়েছে অংয়ের গবেষণায়। আর বাংলাদেশে আমরা কেই–বা না জানি মালয়েশিয়ার মতো দেশে বাংলাদেশের শ্রমিকদের কী ধরনের অমানবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করে উপার্জন করতে হয় (মালয়েশিয়ায় পেনাং শহরে একজন শ্রমিক একবার আমাকে বলেছিলেন, কারণে-অকারণে শ্রমিকেরা কীভাবে স্থানীয় পুলিশের হেনস্তার শিকার হয় এবং কত টাকা যে তাদের এসব কাজে যায়!)। অতিমারির এই সময়ে দেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে সরকার/বিজিএমই/কারখানার মালিকদের টালবাহানা-ঠেলাঠেলি দেখে মনে হয়, নাগরিকদের জন্য একটা বৈষম্যমূলক নীতিমালা কোথাও তৈরি হয়ে গেছে। সেই মালয়েশিয়ার মতো। তারই বাস্তবায়ন যেন এখন দেখছি।

এক থেকে দেড় মাস ধরে গার্মেন্টসশ্রমিকদের কাজে যোগদানের প্রশ্নটি নিয়ে যে কত ধরনের কথা আমরা শুনলাম! একবার বলা হলো গার্মেন্টস বন্ধের সিদ্ধান্ত নেবেন মালিকেরা। রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতন বাবদ পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঘোষণা দিলেন প্রধানমন্ত্রী মার্চের ২৫ তারিখে, অথচ দুদিন পরেই কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর জানিয়ে দিল শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে কারখানা খোলা যাবে। এর ফলে করোনার ভেতর একদফা স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় ফিরতে হলো পোশাকশ্রমিকদের। বিজিএমইএ এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই নানা গল্প ফাঁদতে থাকল। কিছুদিন গেল প্রণোদনার হিসাব-নিকাশ নিয়ে। আবার লে–অফ ঘোষণায় সরকারের দিক থেকেও প্রণোদনা নিয়ে ভিন্ন চিন্তা দেখা গেল।

বলাবাহুল্য, পুরো সময়টা ধরেই এসব ঘটনার প্রতিবাদ করে আসছিল দেশের বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়ন ও সংগঠন। দেশের নেটিজেনরাও এই রকম পরিস্থিতিতে লে-অফ ও শ্রমিক ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে অনলাইন প্রতিবাদ করে। এপ্রিলের শেষে বিজিএমইএ নানা সমালোচনার কারণে কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি বলে প্রজ্ঞাপন জারি করলেও ২৬ এপ্রিল থেকে আবারও কাজে ফিরবার জন্য নির্দেশ দেন বেশ কয়েকজন কারখানামালিক। সংগত কারণেই প্রশ্ন জাগে, মালিকেরা কি দেশের নিয়মের ঊর্ধ্বে? এই লেখা যখন লিখছি, তখন আলোচনায় শেষ বিষয় ছিল ৪০ শতাংশ বেতন কেটে রাখাবিষয়ক। এপ্রিল মাসে যারা বাড়ি থেকে আসতে পারেনি, তাদের ৪০ শতাংশ বেতন কেটে রাখা হবে।

পোশাকশ্রমিকদের কাজে যোগদান নিয়ে দেড় মাস যাবৎ একটা ‘পিংপং’ খেলায় মেতেছে সরকার ও বিজিএমইএ/ কারখানার মালিকপক্ষ। দেশে এত এত হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট চলে (এবং সময়-সময় সেগুলোর খরচ বৃদ্ধি পায়, বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল রাস্তাগুলো নাকি বাংলাদেশেই) অথচ পোশাকশ্রমিকদের এক মাসও নিরাপদে ঘরে রাখার সাহস দেখাল না কেউ? সাধারণ ছুটি প্রশ্নে সরকারের ভূমিকা দেশের পোশাকশ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভঙ্গির ইঙ্গিত দেয়। ঢাকায় ফেরাকে কেন্দ্র করে দফায় দফায় শ্রমিকদের যে অবর্ণনীয় কষ্ট পেতে হলো, তার কি কোনো জবাব পাওয়া যাবে? এসব কারণেই বলতে ইচ্ছা হয় সরকারের কাছে কিছু চেয়ে লাভ নেই। তারা আপনাকে কিছু দেবে না। গার্মেন্টস খাতে আপত্কালীন প্রণোদনার কথা শুনে আশা জাগলেও পরক্ষণেই যখন আপনাদের এ রকম পরিস্থিতিতে কাজে যোগ দিতে বলা হলো, তখন মনে হলো আসলে আপনাদের জন্য সরকার নেই, আপনারা এই দেশের নাগরিক না।

ইতিমধ্যেই গার্মেন্টসশ্রমিকদের মধ্যে সংক্রমণের ঘটনা দেখতে পারছি। তাই নানা আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এই শ্রমিকেরাই দেশের জন্য কয়েক দশক ধরে অর্থনৈতিক সক্ষমতা দিয়েছে। এখনই কাজে যোগদান না করতে পারলে আমাদের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে বলে যাঁরা গান গাইছেন বা শিল্প শেষ হয়ে যাবে বলছেন (ফুট লুজ তত্ত্ব, যা সঠিক নয় বলে মনে করি), তাদের উদ্দেশ্যে বলি, অতিমারি যেমন বৈশ্বিক, এর জন্য কাজও করতে হবে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আপনারা একা একা বাঁচতে পারবেন না। বায়ারদের ওপর দোষ না চাপিয়ে বরং কীভাবে একযোগে কাজ করা যায়, সেই পথ খোঁজা জরুরি। অতিমারির প্রকোপ কমলে, দেশের অর্থনীতি নিয়ে নতুনভাবে আমাদের সবারই মন দিতে হবে। মন দিতে হবে কৃষিতে, সেই কৃষকসমাজের দিকে, যাঁরা আমাদের বাঁচিয়ে রাখলেন করনার দিনগুলোয়। সেই সবজি বিক্রেতা, ভ্যানওয়ালা, যার কাছ থেকে শাকসবজি কিনলেন এত দিন, সেই শ্রমিকদের দিকেও যাঁরা নিয়ম করে বাসার ময়লা সংগ্রহ করলেন এই করোনাকালে। মন দিতে হবে শিল্পে, যাতে প্রকৃতির ক্ষতি না হয়। মন দিতে হবে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দিকে, শিক্ষায়। মন দিতে হবে প্রাণ-প্রকৃতিতে। বড় বড় ব্রিজ, চার লেন–আট লেন দিয়ে আর কত দিন? উন্নয়নের নমুনা বদলাতে হবে।

মাহমুদুল সুমন: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক