কাঁচা ধানে মই ও ত্রাণ বিতরণ

জীবনের এমন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ কবি কিছু লেখেননি। জমিদার কবি ধান কাটা নিয়েও কবিতা লিখেছেন। ‘সোনার তরী’ কবিতায় তাঁকে বলতে শুনি: রাশি রাশি ভারা ভারা, ধান কাটা হল সারা/ ভরা নদী ক্ষুরধারা.../ কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।

তবে কবির কর্তিত ধান ছিল পাকা ধান, কাঁচা নয়।

পাকা ধানে মই দেওয়ার কথা আমরা শুনেছি। এ কাজে পৃথিবীতে বাঙালিই সবচেয়ে পারদর্শী। কিন্তু পাকা ধানে মই দেওয়া শুধু নয়, কাঁচা ধানে কাস্তে চালাতেও যে বাঙালি দক্ষ, তা করোনার কারণে ঘরে বসেই টেলিভিশনে দেখা গেল। কাঁচা ধানে কাস্তে চালানো আর পাকা ধানে মই দেওয়া একই কথা।

হাজার বছর ধরে বাঙালি গর্ব করে বলছে, ‘গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু’। বাঙালির গোলায় যে ধান ছিল, তার ভেতরে চাল ছিল, চিটা নয়। শস্যদানাহীন ধানকে বলা হয় চিটা। চিটা ধানের ভাত হয় না। চিটা ধানে খুদ হয়। এখন আমাদের দরকার ভাতের জন্য চাল, খুদ নয়। কিন্তু আমাদের জনদরদি জনপ্রতিনিধিরা প্যান্ট-শার্ট ও সানগ্লাস পরে কৃষককে সাহায্য করতে যে কাঁচা ধান কাটতে পাজেরো জিপ থেকে খেতে নেমে গিয়েছিলেন, ওই ধানে খুদও হবে কি না সন্দেহ।

অনেক কৃষকের খেতের ধান প্রায় পেকে এসেছে। সেই পাকা ধান না কাটতে কাটতেই বর্ষা এসে যাচ্ছে। শ্রমিকের অভাব। কৃষককে ধান কেটে দিতে সাহায্য করা দরকার। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ না অ-স্বয়ংসম্পূর্ণ, তার পরীক্ষা হবে আগামী বছর। কৃষকদের সাহায্য করতে মুভি ক্যামেরা নিয়ে ছাত্র-যুবকদের অনেকে মাঠে নেমে পড়েছেন। জনসেবার এই মওকা আমাদের জনপ্রতিনিধিরা হাতছাড়া করবেন, তাঁরা অত বোকা নন। ধানের খেতে নেমে পড়া দরকার, তা সে পাকা ধানের খেতই হোক বা কাঁচা ধানের খেত। ছবি তোলার জন্য একটা ধানখেত হলেই হলো!

 ‘কৃষক ভাইদের’ সঙ্গে রসিকতা বাঙালি সমাজে নতুন নয়, এবার এই মহাদুর্যোগের মধ্যে তার সঙ্গে যোগ হলো নতুন একটি: জনপ্রতিনিধিদের কাঁচা ধান কাটা।

এই সংসারে কোন কাজটি সঠিক আর কোনটি ঘোরতর অন্যায়, কোন সময়ে কোন কাজটি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, তা উপলব্ধি করার মতো আক্কেলবুদ্ধি পর্যন্ত আজ বাঙালি হারিয়ে ফেলেছে। যে সময় জাতি সুবিধাভোগী মানুষের, বিশেষ করে জনপ্রতিনিধিদের থেকে আশা করে সর্বোচ্চ বিবেচনাপ্রসূত কাজ, সেবামূলক তৎপরতা, সেই সময় লোকদেখানো জনসেবা নিকৃষ্ট ধরনের ভাঁড়ামি।

আজকাল রিলিফ বিতরণ অনুষ্ঠানের সঙ্গে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিশেষ তফাত নেই। মঞ্চ তৈরি হবে। তাতে ডেকোরেটরের পেছনে খরচা হবে ১০-১২ হাজার টাকা। মঞ্চের পেছনে বিরাট ডিজিটাল ব্যানার। তাতে সবচেয়ে বড় হরফে ত্রাণ বিতরণ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির নাম—নানা রকম পদবি ও বিশেষণসহকারে। এর নিচে সভাপতির নাম অপেক্ষাকৃত ছোট অক্ষরে। মাইকে সকাল থেকেই ঘোষিত হতে থাকে এলাকার মানুষের ‘নয়নমণির’ আগমনবার্তা। তিনি রাজধানী থেকে একটু আগেভাগেই লাঞ্চ করে বের হন। ওদিকে সকাল থেকে বুভুক্ষু মানুষ মঞ্চের তিন দিকে জড়ো হয়। যে জোয়ানের ঠ্যাঙে জোর আছে, তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন। যে বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার তিন দিন পেটে ভাত পড়েনি, তিনি মাটিতে বসে থাকেন। ত্রাণের বস্তুর চেয়ে পোঁটলাটি কোন জনদরদির হাত থেকে গৃহীত হলো, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কোনো ত্রাণ বিতরণ অনুষ্ঠানের ফটোসেশন দেখার মতো।

সাম্প্রতিক সময়েই দেখা গেছে, ত্রাণ নিতে গিয়ে যৎসামান্য লাঠির বাড়িও খেতে হয়েছে অনেককে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাতাদের পক্ষের লোকদের, অর্থাৎ কর্মীদের কোন্দলে মারামারিতে কারও নাক ফেটেছে, কারও মাথা ফেটেছে, কারও ছিঁড়েছে পাঞ্জাবি অথবা হাতাকাটা কোট। ধস্তাধস্তিতে খোয়া গেছে কারও চশমা কিংবা সানগ্লাস।

বাঙালি সমাজে দুর্যোগের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ নতুন নয়। ১০০ বছর আগেও বাঙালি নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা ত্রাণ দিয়েছেন। তাঁদের মঞ্চের প্রয়োজন হয়নি, ব্যানারের দরকার হয়নি, মাইক ছিল না, ফটোসেশন তাঁদের পছন্দ ছিল না বলে ত্রাণসামগ্রীর সঙ্গে কারও গলাতেই ক্যামেরা ঝুলতে দেখা যায়নি।

মাওলানা ভাসানী বহুবার বলেছেন, তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরুই ত্রাণ বিতরণ করা দিয়ে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, প্রখ্যাত রসায়নবিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুসহ সেকালের নেতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে ‘আমার সমাধান’ শীর্ষক এক লেখায় ভাসানী লেখেন, ‘বাংলা ১৩২৯ সনের (১৯২২) বন্যাও আমার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে বিপুলভাবে নাড়া দিয়াছিল। সেই সনে উত্তরবঙ্গে এক অভাবনীয় বন্যা হইয়াছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে, অতিবৃষ্টির দরুন সান্তাহার জংশনে কোমরসমান পানি হইয়া গিয়াছিল। রিলিফের কাজে আমরা কয়েকজন সেখানে পৌঁছিয়া কিভাবে কি করা যায় ভাবিতেছিলাম। একদিন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ আসিয়া হাজির, সঙ্গে ছিলেন বাংলার বিপ্লবী সন্তান সুভাষ বসু। দেশবন্ধুর হাতে দশ সের চিড়ার একটি পোঁটলা ছিল। উহা লইয়া তিনি যখন পানিতে নামিয়া পড়িলেন, তখন আমরা কেহ দাঁড়াইয়া থাকিতে পারি নাই।’

করোনা যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, তাতে বিপুলসংখ্যক মানুষকে অনাহার ও ক্ষুধা থেকে বাঁচাতে ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে হবে। তা চালাতে হবে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দীর্ঘদিন। ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব সরকারি কর্মকর্তা অথবা জনপ্রতিনিধির। ত্রাণ চুরি আমাদের কালচারে দাঁড়িয়ে গেছে বহুদিন থেকে। ত্রাণ চুরি আর সিঁধ কেটে চুরির মধ্যে গুণগত পার্থক্য নেই। ত্রাণসামগ্রী চুরি করে বহু মানুষ বিত্তবান হবে।

চুরির সঙ্গে যোগ হয়েছে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের প্রদর্শনী। সবচেয়ে কুৎসিত দৃশ্য হলো লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে ত্রাণ বিতরণ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় কখন ‘তিনি’ আসবেন, সেই অপেক্ষায়। রাষ্ট্র তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মানুষকে অপমান করতে পারে না। ভুলে গেলে চলবে না, অভাবী মানুষও দেশগঠনে ও অর্থনীতিতে অবদান রাখে এবং তারাই রাখে খুব বেশি।

আমাদের সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রে মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।’ অর্থাৎ, কোনো নাগরিককে কোনোভাবে অমর্যাদা করা যাবে না। মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার ‘মৌলিক মানবাধিকার’। সাময়িক অভাবী নাগরিককে তাদের বেঁচে থাকার জন্য অর্থ বা খাদ্য প্রদান কোনো দান-খয়রাত নয়, তা তাদের প্রাপ্য অধিকার। বাংলাদেশে লাইন ধরে ত্রাণ বিতরণের দৃশ্য বিদেশি মিডিয়ায় প্রচারিত হওয়ায় শুধু এসব মানুষের মর্যাদা নয়, দেশের মর্যাদাও ক্ষুণ্ন হয়। নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশের ভাবমূর্তির সঙ্গে তা সাংঘর্ষিক।

 সাব-সাহারা অঞ্চলের দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশ আর বাংলাদেশ এক নয়। এখানে কোন এলাকায় কার ত্রাণের প্রয়োজন, তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির জানার কথা। সরকারের প্রশাসনে ও স্থানীয় সরকারে লোক-লস্করের অভাব নেই। ত্রাণ পাওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া কঠিন নয়। সভ্য সমাজে প্রতিটি কাজ পরিচালনার জন্য অলিখিত নীতিমালা থাকে। লোকদেখানো নয়, স্বাভাবিক ও সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আমাদেরও একটা নীতিমালা থাকবে, সেটাই প্রত্যাশা।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক