লকডাউন শিথিল করার সিদ্ধান্ত কি আত্মঘাতী?

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশও সাধারণ ছুটি (লকডাউন) পালন করছে। যদিও অনেকে মনে করে থাকেন, এ ধরনের লকডাউন পশ্চিমা ধারার চিন্তা, আর এই ধরনের ব্যবস্থাপত্র বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অচল বা খুব একটা কার্যকর নয়। তবে গুগল মবিলিটি ডেটা বলছে, বাংলাদেশে লকডাউন ভালোই পালিত হচ্ছে। যদিও বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে তা ঠিকমতো আমল করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয় না। গতকাল মঙ্গলবার সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ঈদের কেনাকাটার জন্য দোকানপাট ১০ মে থেকে সীমিত আকারে খোলা রাখা যাবে।

এটা সহজে বোধগম্য যে সরকার হয়তো ব্যবসায়ীদের চাপে পড়ে বা ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে অথবা অর্থনীতির কথা চিন্তা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিমধ্যে গার্মেন্টসগুলো সীমিত আকারে চালু হয়েছে। অনেকে রসিকতা করে বলছেন, তার মানে কি দেশ থেকে করোনা চলে গেল। সেই রসিকতার মধ্যে রসের চেয়ে শঙ্কাই বেশি। আসল কথা হলো, এ লকডাউন খোলার সিদ্ধান্ত কতটা সুচিন্তিত, সেটা বলা মুশকিল। তবে গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে ডেটা দিয়ে এ বিষয়ে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। চলুন দেখা যাক ডেটা ও গাণিতিক মডেল কী বলে।

তিন মডেলে সম্ভাব্য পরিসংখ্যান
শুরু থেকেই বাংলাদেশে সংক্রমণের সম্ভাব্যতা নিয়ে হাহাকার দেখা গেছে। শুনেছি, সরকার একটা টেকনিক্যাল টিম গঠন করেছে এই বিষয়ে। যদিও তাদের প্রজেকশন সম্বন্ধে আমজনতা খুব বেশি জানে না বা হয়তো জানার কথাও না। কৌতূহলবশত এ নিয়ে একটু পড়াশোনা করছিলাম। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মোফাখের হোসেন এ বিষয়ে আমাকে ব্যাপক সহযোগিতা করেছেন। আমাদের করা গত ২০ এপ্রিলের সেই প্রজেকশনে (https://tinyurl.com/y7uyc86w) ছিল যে বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ৪ মে ১০ হাজার অতিক্রম করবে। কাকতালীয় হলেও সেটা মিলে গেছে। পরে প্রথম আলোয় দেখলাম, সরকার বলছে, মে মাস শেষে বাংলাদেশে ৪৮ হাজার থেকে ৫০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হতে পারে, যা আমাদের ২০ তারিখে করা প্রজেকশনের সঙ্গে মিলে যায়।

একই রকম মডেল দিয়ে আমি ঢাকার জন্যও প্রজেকশন করেছি। সে আলোকে গার্মেন্টস ও দোকানপাট খুলে দেওয়াটা কতটা যৌক্তিক, তা ব্যাখ্যা করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। আর এর জন্য আমি তিন ধরনের মডেলিং ব্যবহার করেছি: ১. এসআইআর মডেল, ২. টাইম সিরিজ (এক্সপোনেনশিয়াল) মডেল এবং ৩. সিগমইডাল-টাইপ ডিস্ট্রিবিউশন মডেল। যদিও অন্যান্য মডেলিং দিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করেছি, পাঠকের সুবিধার জন্য এখানে তিনটি মডেলই ব্যাখ্যা করা হলো। দেখা যাক মডেলগুলো কী বলে।

এসআইআর মডেল
এটা একটা ইপিডেমিওলজিক্যাল মডেল, যা পুরো জনসংখ্যাকে তিন ভাগে ভাগ করে: সাসেপটিবল (এস)–অর্থাৎ যাদের সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, ইনফেক্টেড (আই)-ইতিমধ্যেই যারা সংক্রমিত হয়েছে এবং রিমোভড (আর)–অর্থাৎ যারা ইতিমধ্যেই সংক্রমিত হয়ে সুস্থ হয়েছেন বা মারা গেছেন (অর্থাৎ তাঁদের আর সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা নেই)। মিলান বাতিস্তা নামে ইউনিভার্সিটি অব লুব্লিয়ানা, স্লোভেনিয়ার এক প্রফেসর এই মডেলটি করোনায় আক্রান্তের ডেটা দিয়ে (এমপিরিকিলি) নির্ণয় করার পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন, যা ব্যবহার করে সিঙ্গাপুরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিম বিভিন্ন দেশের প্রজেকশন করেছে। সেটা কিছুদিন আগে প্রথম আলোয় ছাপানোও হয়েছিল। সেই একই মডেল ব্যবহার করে আমি ঢাকার প্রজেকশন করেছি।

প্রজেকশন বলছে, যদি বর্তমান ধারা বজায় থাকে, তাহলে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ঢাকায় করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় আট হাজারের মতো হবে। এই মডেলে মোট কতজন আক্রান্ত হতে পারে, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আর-নট (Ro)–এর মান। এর মানে হলো একজন সংক্রমিত হওয়ার পর সে কতজকে সংক্রমিত করছে (বা করতে পারে)। লকডাউনের মাধ্যমে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে তা এক এর নিচে নিয়ে আসাই উদেশ্য থাকে। আর একের বেশি থাকা মানে সংক্রমণ বাড়ার সম্ভাবনাও বেশি। বর্তমান ডেটা বলে এর মান ২ দশমিক ৪৩, যার মানে হলো ঢাকার পরিস্থিতি এখনো বিপজ্জনক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি আমাদের বর্তমান লকডাউন থাকলেও। আর লকডাউন খুলে দিলে তা আরও বাড়বে, যার ফলে মে মাসের মধ্যেই ঢাকায় আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার, এমনকি তারও অনেক বেশি হওয়া অসম্ভব নয়।

টাইম-সিরিজ মডেল
এবার দেখা যাক টাইম-সিরিজ মডেল কী বলে। এখানে আমি ডেটা দিয়ে দেখতে চেয়েছি ঢাকার বৃদ্ধির হার কেমন। এটা দেখার জন্য এক্সপোনেনশিয়াল ফাংশন ব্যবহার করা হয়েছে। এই ফাংশনের এক্সপোনেনশিয়াল অংশের সহগ দেখে বোঝা যায় বৃদ্ধির হার কেমন ছিল বা হবে। সহগ যদি একের বেশি হয়, তার মানে হলো আক্রান্তের সংখ্যা এক্সপোনেনশিয়ালি (চক্রবৃদ্ধি হারে) বাড়ছে। সহজভাবে বলতে গেলে ১ থেকে ২, ২ থেকে ৪ বা তার বেশি, ৪ থেকে ৮ বা তার বেশি—কিছুটা এ রকম। সংক্রমণ-রোগের ক্ষেত্রে এটা খুবই স্বাভাবিক। আর সামাজিক দূরত্বের উদ্দেশ্যই হলো এটাকে একের নিচে নিয়ে আসা। ঢাকার ডেটা দিয়ে আমি পেয়েছি যে সেই সহগের মান ১ দশমিক ২০–এর কাছাকাছি, তার মানে ঢাকায় এখনো চক্রবৃদ্ধি হারে সংক্রমণ বাড়ছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ বাদ দিলে সেই সহগ সারা দেশের জন্য এক থেকে সামান্য বেশি। সেই হিসাবে দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় ঢাকা এখনো অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই ধারা বহাল থাকলে এই মডেল অনুযায়ী মে মাসের মাঝামাঝিতে শুধু ঢাকাতেই ১৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার আর মাস শেষে ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার লোক আক্রান্ত হতে পারে।

ফেসবুক অ্যানালিটিকস টিম মেশিন-লার্নিংভিত্তিক একটা প্রজেকশন টুল বের করেছে। সেই মডেল ব্যবহার করেও একই রকম প্রজেকশন পেয়েছি। এক্সপোনেনশিয়াল মডেলের সীমাবদ্ধতা হলো, এই মডেল স্বল্প মেয়াদে ভালো প্রজেকশন দিলেও দীর্ঘ মেয়াদে খুব একটা ভালো প্রজেকশন নাও দিতে পারে। কারণ, একটা পর্যায়ে বৃদ্ধির হার কিছুটা কমে আসবেই, যদিও এই মডেল দিয়েও তা ব্যাখ্যা করার সুযোগ আছে, তবে সে ক্ষেত্রে অন্যান্য মডেল বেশি উপযোগী। সিগমইডাল টাইপ মডেল এই ব্যাপারটা আমলে নিতে পারে।

সিগমইডাল মডেল
বাস্তবে এই রকম সংক্রামক বিধির ক্ষেত্রে প্রথমে একটু ধীরগতিতে বাড়ে, একটা সময় অনেক দ্রুত ছড়ায়, আর শেষ মুহূর্তে আবার ধীরগতির হয়ে যায়। সময়ের সাপেক্ষে আক্রান্তের সংখ্যা গ্রাফে প্লট করলে কিছুটা বাঁকা ইংরেজি ‘S’ অক্ষরের মতো দেখায়। এ ধরনের মডেল বা ফাংশনকে সিগমইডাল মডেল বা ফাংশন বলে।

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন এই ধরনের মডেল ব্যবহার করে। বলা হয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি তাদের প্রজেকশনে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। দুই ধরনের সিগমইডাল মডেল ব্যবহার করে দেখেছি যে বর্তমান গতিতে সংক্রমণ চলতে থাকলে মে মাসের মাঝামাঝি ঢাকায় মোট ১০ হাজার লোক আক্রান্ত হতে পারে, যা মাস শেষে গিয়ে ১৫ হাজার বা তারও বেশি হতে পারে। যদিও অন্য আরেকটা মডেল অনুযায়ী মে মাসের শেষে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়াতে পারে প্রায় ৯ হাজার থেকে ১০ হাজারের মতো। এখানে পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, এটা বর্তমান লকডাউন থাকবে ধরে হিসাব করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, লকডাউন উঠে গেলে সংক্রমণ, শঙ্কা, বিপদ—সবই বাড়বে।

সব মডেলের রেজাল্ট থেকে এটা পরিষ্কার যে ঢাকায় এখনো বিপদের শঙ্কা রয়েই গেছে, এমনকি লকডাউন থাকলেও। কিছুদিন আগে গার্মেন্টস খুলে দেওয়া হলো আর ১০ মে থেকে যদি দোকানপাট ও শপিং মলও খুলে দেওয়া হয়, তাহলে সে শঙ্কা আরও বহুগুণে বাড়বে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে মোট আক্রান্ত ব্যক্তির প্রায় ৬০ শতাংশই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে। আর তাই এই দুই এলাকার ব্যাপারে সাবধানতা আরও বেশি প্রয়োজন। চিন্তার বিষয় হলো বেশির ভাগ গার্মেন্টস কারখানাও এই দুই জেলায় ও গাজীপুরেই অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান বলছে, গতকাল তাদের আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ লাখে। অথচ প্রথম ৫০ দিনে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ছয় হাজারের মতো। আর বাংলাদেশে প্রথম ৫০ দিনে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১০ হাজার। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, আমাদের দেশে শঙ্কা এখনো রয়েই গেছে।

জীবন ও জীবিকার মধ্যে একটা সাংঘর্ষিক অবস্থা
এটা ঠিক যে বাংলাদেশে জীবন ও জীবিকার মধ্যে একটা সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজ করছে। ইতিমধ্যে সরকার অনেক প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তারপরও আমাদের মতো দেশ দীর্ঘদিন লকডাউন করে রাখার সামর্থ্য রাখে না। প্রভাবশালী পত্রিকা ইকোনমিস্টও বাংলাদেশ সম্পর্কে একই উপসংহার টেনেছে। তবে ভাবতে হবে আমরা এখনই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাব কি না। ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থেই হোক বা চাপেই হোক অথবা অর্থনীতির কথা চিন্তা করেই হোক, গার্মেন্টস আর দোকানপাট যদি খুলতেই হয়, তাহলে জোনিং সিস্টেমের কথা চিন্তা করা যেতে পারে। যেমন যেসব এলাকায় বেশি আক্রান্ত, সেসব এলাকা এখনই না খোলা এবং সে এলাকার লোকদের অন্য এলাকায় ও শপিং মলে যাতায়াত সীমিত করা ইত্যাদি। এই ক্ষেত্রে মোবাইল লোকেশনের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। মানুষের বর্তমান অবস্থান অনুযায়ী সবুজ, লাল ও হলুদ জোনে ভাগ করা এবং মোবাইলে এই মেসেজ পাঠানো এবং প্রবেশের ক্ষেত্রে তা দেখানো বাধ্য করা। ডিজিটাল বা ম্যানুয়াল কন্টাক্ট ট্রেসিং কার্যকর হতে পারে। কন্টাক্ট ট্রেসিং সিভিলিয়ান আর্মি গঠন করা যেতে পারে। স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ, জনস্বাস্থ্য ও আইটি বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে আরও ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন। তা ছাড়া গার্মেন্টসের জন্যও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা জরুরি।

মনে রাখতে হবে, ব্যবসা বা অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে তাড়াহুড়ো করলে যদি ভয়াবহতা বাড়ে, তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবসা বা অর্থনীতিরই বেশি ক্ষতি হবে। আমি মনে করি, আতঙ্ক নিয়ে নতুন জামা পরে ঈদ করার চেয়ে পুরোনো জামা পরে শঙ্কাহীন ঈদ অনেক বেশি আনন্দের।

ড. শাফিউন নাহিন: সহযোগী অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়