ত্রাণ বিতরণে সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টার খবরের পাশাপাশি ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে যে প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণ সরবরাহ অত্যন্ত অপ্রতুল।
কারণ বোধগম্য, কোভিড–১৯ মহামারির কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত হয়ে যাওয়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবনে দীর্ঘ মেয়াদে যে দুর্দশা নেমে এসেছে, তা আমাদের অতীতের সব অভিজ্ঞতা অতিক্রম করে গেছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে পুরো দেশের মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম বন্ধ থাকার অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। অতীতে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে কিছু নির্দিষ্ট এলাকার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দুর্যোগ–পরবর্তী কিছু সময়ের জন্য তাদের ত্রাণ–সহযোগিতার প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু কোভিড–১৯ মহামারির অর্থনৈতিক অভিঘাত লেগেছে পুরো জাতির জীবন ও জীবিকার ওপর। সারা দেশের বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষ দীর্ঘদিন ধরে কর্মহীন ও আয়হীন থাকায় খাদ্যসংকটে পড়ে গেছে। তাদের সংখ্যাটা বিপুল। তাই ত্রাণসামগ্রীর মোট চাহিদাও বিরাট। এ চাহিদা আরও কত দিন ধরে রয়ে যাবে, সে বিষয়ে এখনই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।
তাই এবারের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে অতীতের পদ্ধতিগুলোর সঙ্গে নতুন ও উদ্ভাবনী কৌশল যোগ করতে হবে। প্রথমেই ধরে নিতে হবে যে এই মহামারির স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক অভিঘাত হবে দীর্ঘমেয়াদি।
যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা উদ্ভাবন এবং মানুষের মধ্যে ইমিউনিটি গড়ার আগ পর্যন্ত এই মহামারির স্বাস্থ্যগত ধকল চলবে। সময়টি ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রলম্বিত হবে। এই সময়জুড়ে অর্থনীতির ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব চলবে। সুতরাং দু–তিন মাসের হিসাব করে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা যথেষ্ট হবে না, আরও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। সে অনুযায়ী সম্পদ আহরণ ও বিতরণের পরিকল্পনা নিতে হবে।
করোনার ফলে আমরা যে সংকটে পড়েছি, নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে তা মোকাবিলা করা আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন। কারণ,
আমাদের সম্পদ সীমিত। তবে সঠিক তথ্য–উপাত্ত ও চাহিদার প্রকৃত চিত্র পরিষ্কার হলে আমাদের যে সম্পদ আছে, তারই সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বিপন্ন মানুষের দুঃখ–কষ্ট লাঘব করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ত্রাণ খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানো এবং প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের স্বার্থে ন্যায়সংগত বণ্টনের গুরুত্ব সর্বাধিক।
ত্রাণ বিতরণ–সংক্রান্ত সরকারি ঘোষণাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। ত্রাণসামগ্রী চুরির অনেক খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা নানাভাবে মানুষকে সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সরকারের ঘোষিত অর্থ ও খাদ্যসামগ্রী এবং অভাবী মানুষের সংখ্যার তুলনামূলক বিশ্লেষণে যে চিত্রটা বের হয়, তা সন্তোষজনক নয়। কয়েক কোটি মানুষকে সহায়তা দিতে হলে যে সম্পদের জোগান দরকার, সে বিষয়ে সরকার কার্যত নীরব রয়েছে। ত্রাণ পাওয়া ব্যক্তিদের সঠিক তালিকা এবং তাঁদের হাতে বরাদ্দের পুরোটাই পৌঁছানোর বাড়তি চ্যালেঞ্জ তো থাকছেই। কেউ বলছেন নগদ পাঁচ হাজার টাকা এবং পাঁচ হাজার টাকার পণ্য সহায়তা দেওয়া হোক। তিন মাসেরটা এমনভাবে দেওয়া হোক, যাতে ত্রাণ নিতে সামাজিক দূরত্বের শর্তের গুরুতর ব্যত্যয় না ঘটে।
সেই সঙ্গে ত্রাণবিষয়ক কার্যক্রমের অগ্রগতির হালনাগাদ পরিসংখ্যান নিয়মিত প্রকাশ করা উচিত।