নেতৃত্বের ব্যর্থতা শোচনীয়

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

নেতৃত্ব হলো সেই গুণ, যার মাধ্যমে মানুষ তাদের লক্ষ্য খুঁজে পায় এবং অর্জন করে। করোনার সময়ে খুবই নির্ধারক এই গুণ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল চল্লিশের দশকে এই গুণ দেখিয়েছিলেন, যেমন দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ থেকে উত্তরণে দেখিয়েছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। এসব ঐতিহাসিক মাপের সঙ্গে তুলনায় পৃথিবীর দুই বৃহৎ অর্থনীতির নেতারা ভীষণভাবে ব্যর্থ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং উভয়ই করোনাভাইরাস বিস্তারের শুরুর দিকের সমস্যা অস্বীকার করার মাধ্যমে জনগণকে সজাগ ও সচেতন না করার ফলে জীবনহানি বাড়িয়েছেন। নিজেদের সামর্থ্যকে তাঁরা সমাধান খোঁজার বদলে পারস্পরিক দোষারোপে ব্যয় করেছেন। তাঁদের এই যুগল ব্যর্থতার কারণে পৃথিবী হয়তো তৈরি হওয়া এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মার্শাল প্ল্যানের মতো ‘কোভিড মার্শাল প্ল্যান’ তৈরির সুযোগ হারিয়েছে।

নেতৃত্ববিষয়ক তাত্ত্বিকেরা ‘রূপান্তরমূলক’ ও ‘গতানুগতিক’ নেতৃত্বের মধ্যে পার্থক্য করেন। পরের ধরনের নেতারা গতানুগতিক চালেই চলেন, সেখানে প্রথম ধরনের নেতৃত্ব পরিস্থিতিকে নতুন চেহারা দেন এবং নিজেরা সেই পরিবর্তনের ধারার মধ্যে থাকেন। রূপান্তরমূলক নেতারা যে সব সময় সফল হবেন, তা নয়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইরাকে আগ্রাসন চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের পুনর্গঠন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার ফল হয়েছে বিপর্যয়কর। বিপরীতে তাঁর বাবা, সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচ ডব্লিউ বুশের ছিল কাজ চালানোর মতো গতানুগতিক নেতৃত্ব। কিন্তু তাঁরও ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে ইউরোপের অস্থির সময়টা সামলানোর কিছু দক্ষতা। শীতল যুদ্ধ শেষ হলো, জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাশ্চাত্যের সঙ্গে জোরদার সম্পর্ক তৈরি করল, কিন্তু একটা গুলিও ফুটল না।

একেকজনের ধরন যা–ই হোক, নেতারা গোষ্ঠী-পরিচয়ের ওপর শক্তিশালী প্রভাব ফেলতে পারেন, ‘আমি’ ও ‘তুমি’কে ‘আমরা’ করে তুলতে পারেন। অকর্মণ্য নেতারা সমাজে বিদ্যমান বিভক্তির সুবিধা নিয়ে চলমান অবস্থাকেই আরও শক্তিশালী করেন—ট্রাম্প যা করেছেন। কিন্তু প্রভাবশালী রূপান্তরমূলক নেতারা সমাজের নৈতিক চরিত্রের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেন। যেমন ম্যান্ডেলা, খুব সহজেই কৃষ্ণাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকানদের নেতা হিসেবে থেকে যেতে পারতেন এবং কয়েক দশকের অবিচারের বদলাও নিতে পারতেন, কিন্তু নিরলসভাবে নিজের সমর্থকদের বৃত্তটা আরও বড় করায় কাজ করে গেছেন।

একইভাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ওই যুদ্ধে জার্মানি ৭০ বছরে তৃতীয়বারের মতো ফ্রান্সে আগ্রাসন চালায়—ফরাসি কূটনীতিক জাঁ মনে এই উপসংহারে আসেন যে প্রতিহিংসা নিলে ট্র্যাজেডিরই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। পরিস্থিতির উত্তরণে তিনি ইউরোপীয় কয়লা ও ইস্পাত উৎপাদনে যৌথ পরিকল্পনা নিয়ে আসেন, ঘটনাক্রমে সেটাই আজকের ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

এসব অর্জন অনিবার্য ছিল না। আমরা যখন আমাদের পরিবার ও ঘনিষ্ঠজন ছাপিয়ে তাকাই, তখন দেখতে পাই মানুষের অধিকাংশ পরিচয়ই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের সূত্রমতে, কোনো না কোনোভাবে ‘কাল্পনিক জনগোষ্ঠী’। কেউই একই জাতির কোটি কোটি মানুষের অভিজ্ঞতার সরাসরি অংশ হতে পারে না। তারপরও দুই শতক ধরে জাতি নামক এই ‘কল্পিত জনগোষ্ঠীর’ জন্য মানুষ প্রাণ দিতেও ইচ্ছুক থেকেছে।

কোভিড-১৯ ও জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি জাতি-পরিচয়ের ধার ধারে না। বৈশ্বিক পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষই বিভিন্ন ‘কল্পিত সম্প্রদায়ের’ অংশীদার-স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয়, জাতিসত্তার, ধর্মীয় ও পেশাভিত্তিক পরিচয়গুলোর মধ্যে তারা আবৃত হয়ে আছে। জনগণের মধ্যে সমর্থন বা সংহতি জাগানোর জন্য এখন সীমিত পরিচয় ধরে টান দেওয়ার দরকার নেই।

করোনা অতিমারি রূপান্তরমূলক নেতৃত্বের জন্য সুযোগ হাজির করেছে। রূপান্তরমূলক নেতা হলে গোড়াতেই সমস্যাটা ব্যাখ্যা করে নিতেন। কারণ, সংকটের চরিত্রটা বৈশ্বিক; কোনো একক দেশ চেষ্টা করেও এর সমাধান করতে পারবে না। ট্রাম্প ও সি চিন পিং উভয়ই এই সুযোগ নষ্ট করেছেন। উভয়ে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন যে ক্ষমতা-চর্চা সবার জন্যই ইতিবাচক হতে পারত। কে কার চেয়ে বড়, সেভাবে চিন্তা না করে তাঁরা দুজনই অন্যকে সঙ্গে নিয়ে শক্তিশালী হওয়ার চিন্তা করতে পারতেন।

অনেক বহুজাতিক বিষয়ে আমেরিকা অন্যদের এগিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নিজের লক্ষ্যও অর্জন করতে পারত। চীন যদি তাদের জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি ঘটায় বা কার্বন নিঃসরণ কমায়, তাহলে আমেরিকানরাসহ সবাই উপকৃত হতো। বিশ্বায়িত দুনিয়ায় নেটওয়ার্কও ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি। জটিলতর হতে থাকা দুনিয়ায় সবচেয়ে বিজড়িত রাষ্ট্রগুলোই সবচেয়ে শক্তিশালী, যারা যৌথ কাজে অন্য রাষ্ট্রগুলোকে কাছে টানার ক্ষমতা রাখে।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র তার দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ ভুলে স্বল্পমেয়াদি স্বার্থ হাসিল করতে চাইছে। হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর সাম্প্রতিক এক লেখায় যেমন বলেছেন, ‘আজকের নেতাদের উচিত সহযোগিতার পথে চলা, যাতে আন্তর্জাতিক সক্ষমতা বাড়ে।’ পাল্টাপাল্টি প্রচারণা না চালিয়ে ট্রাম্প জি-২০ দেশগুলোর জরুরি বৈঠক কিংবা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকতে পারতেন, যাতে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সহায়তার কাঠামো আরও জোরদার হয়।

ট্রাম্প দেখাতে পারতেন, কোভিড-১৯–এর নতুন ধাক্কায় গরিব দেশগুলো কঠিনভাবে ভুগবে, দক্ষিণ গোলার্ধে তা ছড়িয়ে পড়লে উত্তর গোলার্ধও রেহাই পাবে না। মনে রাখা ভালো, ১৯১৮–এর ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারি প্রথমবারের চেয়ে বেশি মানুষের প্রাণ নিয়েছিল। রূপান্তরমূলক নেতৃত্ব আমেরিকান জনগণকে বোঝাতে পারতেন যে কোভিড-১৯ মোকাবিলার তহবিলে আরও বেশি টাকা দেওয়া আমেরিকার নিজের স্বার্থের জন্যই ভালো।

যদি কোনো আমেরিকান চার্চিল অথবা ম্যান্ডেলা এভাবে জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তুলতেন, তাহলে করোনা অতিমারি আরও উন্নত বিশ্বরাজনীতির পথ রচনা করত। দুঃখজনকভাবে, আমরা রূপান্তরমূলক নেতৃত্বের সেই সুযোগটা হারিয়েছি এবং এই অতিমারি বিদ্যমান জনতুষ্টিমূলক জাতীয়তাবাদ এবং প্রযুক্তির কর্তৃত্ববাদী অপব্যবহার আরও বাড়িয়েছে। যেকোনো সময়ই নেতৃত্বের ব্যর্থতা পরিতাপের বিষয়, কিন্তু সংকটের সময় সেটা হয়ে দাঁড়ায় ট্র্যাজিক।

ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
জোসেফ এস নাই জুনিয়র: হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক