যেভাবে বিকাশ-চোরের কাছে ধরা খেলাম

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

নিজের গাধামি এবং পেশাদারিতে পর্বতপ্রমাণ গাফিলতির কথা কাউকে জানাব না ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার মতো বোকা-গাধা না হোক, দুনিয়ায় সরলবিশ্বাসী মানুষজন আছেন। তাঁদের সতর্ক করা দরকার।

১০ মে সকাল ১১টা ৫৭ মিনিটে একটা ফোন এল। যান্ত্রিক পেশাদারি একটা গলা সালাম দিয়ে বলল, ‘বিকাশ অফিস থেকে ফোন করেছিলাম, এই বিকাশ অ্যাকাউন্টটি ব্যবহার কে করে, আপনি?’

আমি তখন একটা কাজ নিয়ে নাস্তানাবুদ। কিছু না ভেবেই বললাম, ‘জি’। এবার গলাটি সটান বলল, অ্যাকাউন্টটি এইমাত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমার মাথায় পাগলাঘণ্টি বেজে উঠল।

করোনাকালে এই মোবাইল ব্যাংকসেবাটি ছাড়া অনেক কাজ অচল হয়ে যাবে। বিকাশ থেকে গ্রাহককে ফোন করে না—এই বহু বিজ্ঞাপিত কথাটা আমি উদ্বেগের ঠেলায় বেমালুম ভুলে গেলাম। অ্যাকাউন্ট সত্যিই বন্ধ কি না, তা যাচাইও করলাম না।

জানতে চাইলাম, অ্যাকাউন্ট কেন বন্ধ হয়েছে? বাবাজি বুঝে গেলেন, তিনি মুরগি ধরে ফেলেছেন। বললেন, ‘আর্জেন্ট চেকিং’-এ ধরা পড়েছে, অ্যাকাউন্ট নিবন্ধনের ফরমে আমার জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ভুল টোকা হয়েছে।

সংশোধন করার জন্য তিনি ‘হেড অফিস’ থেকে ফোন দিয়েছেন। অ্যাকাউন্ট চালু করতে চাইলে সব তথ্য ‘ভেরিফাইয়ের মাধ্যমে’ করতে হবে। আমার পুরো নাম, থানা আর জেলার নাম জেনে নিয়ে বললেন, ‘ধন্যবাদ, তথ্য সঠিক।’

তারপর বাবাজি বললেন, ‘চালু করে দিচ্ছি। অফিস থেকে মেসেজ যাবে।’ তিনি বাসার আরেকজনের মোবাইল নম্বর নিয়ে কলটি কাটলেন। তক্ষুনি আমার মোবাইলে বিকাশের নিয়মিত মেসেজের সারিতে নতুন মেসেজ এল।

অন্য নম্বরে তাঁর ফোনও এল। বাবাজি মেসেজে থাকা ‘ভেরিফাই’–এর পাসওয়ার্ডটি তাঁকে জানাতে তাড়া দিলেন। ভ্যাবাচ্যাকা আমি বলে দিলাম। তিনি ওই কল কেটে আবার আমার নম্বরে কল দিলেন।

ইতিমধ্যে আমার মাথায় ঢুকেছে যে ওটা ছিল ‘ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড’ অর্থাৎ ‘ওটিপি’। বরাবরের মতো বিকাশের ওই মেসেজেও লেখা ছিল: ওটিপি আর পিন কারও সঙ্গে শেয়ার করবেন না; বিকাশ এগুলো কখনো জানতে চায় না; এটা ৩০ সেকেন্ডে বাতিল হয়ে যাবে।

আমার সন্দেহ হলো। বাবাজির নাম জানতে চাইলে বললেন, নাজমুল হোসেন, বিকাশের সার্ভিস সেন্টারে আছেন। আরও বললেন, আমাকে একটা ‘আইডেন্টিফিকেশন সাবমিট’ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর এমন ঝামেলা না হয়। আমি আবার প্রলুব্ধ হলাম।

বাবাজি ক্যালকুলেটর খুলে আমাকে ২৫০০০-এর সঙ্গে আমার বর্তমান পিন নম্বর যোগ দিতে বললেন। আমি বাধ্য ছাত্রের মতো অঙ্ক করলাম। তিনি বললেন, এটা আমার অ্যাকাউন্টের নিরাপত্তার জন্য (!) ব্যক্তিগত আইডেন্টিফিকেশন নম্বর। অ্যাকাউন্ট চালু করার জন্য এটা তাঁকে বলতে হবে।

আমার বুদ্ধিনাশ হওয়া মাথাতেও চিড়িক দিল যে এভাবে বাবাজি আমার পিন নম্বর জেনে যাবেন। আমি আপত্তি জানালে তিনি হড়হড় করে মেলা কথার মধ্যে বললেন, ‘বিকাশ অফিস থেকে চেক করছি, এটা বুঝতে হবে।’ আমি মনে মনে ‘যা ছাতা’ বলে যোগফলটা জানালাম। তিনি বললেন, ‘একটু সময় দিয়ে সহযোগিতা করবেন।’

বাবাজি বোধ হয় এমন গাধার গাধা সুবোধ ছাত্র আর পাননি। এবার তিনি আমার ব্যাংক হিসাব থেকে বিকাশে টাকা চালাচালির অপশন চালু করার জন্য ব্যাংকের পাসওয়ার্ড জানতে চাইলেন। বললেন, সরাসরি বিকাশ থেকে আমার কাছে মেসেজ গেছে, তিনি তো ঠগ নন।

আরও বললেন, দুই দিন ধরে নেট খুব সমস্যা দিচ্ছে, আমি এত না বকবকালে এতক্ষণে কাজ হয়ে যেত। কিন্তু ততক্ষণে আমার টিউবলাইট জ্বলেছে। আমি কলটা কেটে বিকাশের পাসওয়ার্ড বদলাতে গিয়ে দেখি, অ্যাকাউন্ট বন্ধ। অর্থাৎ বাবাজি কাজ সেরে ফেলেছেন। মেসেজটা পাঠিয়েছিলেন কী করে, কে জানে।

আমার অতি বড় সৌভাগ্য যে বিকাশে দ্রুত যোগাযোগ করার সুযোগ ছিল। জানতে পারলাম, বাবাজি আমার টাকা অন্যত্র রওনা করিয়েছিলেন। তবে বিকাশ সেই লেনদেন থামিয়ে দিয়েছে। টাকাটা ফেরত পাব। বিকাশকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ!

এদিকে চোর পালানোর পর বুদ্ধি জন্মাল। ব্যাংক হিসাব এবং প্রত্যাগত বিকাশ অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড বদল করলাম। পুলিশের সাইবার ক্রাইম দপ্তরে বাবাজির নম্বর আর কীর্তি জানালাম।

লজ্জায় মরে যাচ্ছি। ওয়াকিবহাল থাকা, সন্দেহ করা আর যাচাই করা—৩৩ বছরেও যে সাংবাদিকতার এই তিন মূল শিক্ষা আমার হয়নি, বাবাজি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন। ফোনবইয়ে তাঁর নম্বরটি রেখেছি ‘ফ্রড করোনা বিকাশ’ নামে, কিন্তু তাঁকে পেলে সালাম জানাতাম।