সুবিচার, সুনীতি ও সুবিবেক

জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান।
জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান।

আনিসুজ্জামান স্যারের জগৎ অধমের জগৎ থেকে অনেক ব্যাপক, বিস্তৃত ও সমৃদ্ধময়। তবে আমার পুরো জগৎটা আনিসুজ্জামান স্যারের বিরাট ক্ষেত্রের ছোট্ট একটি অংশ। আমাদের আইনের যে জগৎ সেটা ইংরেজি ভাষার দখলে। আমরা আইন ইংরেজি ভাষায় বুঝতে অভ্যস্ত। এটা আমাদের সংকীর্ণতা এবং অদক্ষতা। বলা বাহুল্য, আনিসুজ্জামান স্যার আইন ইংরেজিতেও বুঝতেন, বাংলায়ও বুঝতেন। সেই কারণেই আমাদের সংবিধানটা তিনি বাংলায় লিখেছিলেন। সংবিধানের একটা ইংরেজি পাঠ আছে। তবে খোদ সংবিধানই বলে দিয়েছে যে বাংলা পাঠটাই মুখ্য।

আনিসুজ্জামান স্যারকে স্মরণ করতে গিয়ে এই লেখার শিরোনামে যে তিনটি শব্দ ব্যবহার করেছি সেগুলোর ইংরেজি পাঠের সঙ্গে বেশির ভাগ আইনজীবী পরিচিত। কিন্তু বাংলার এই তিনটি শব্দ, আশঙ্কা হয়, অনেকের মনে খটকা জাগাবে। আমাদের ঔপনিবেশিক আইনের ইতিহাসে সবচেয়ে পরিচিত তিনটি শব্দ হলো Justice, Equity, Good Conscience। বাংলায় যথাক্রমে সুবিচার, সুনীতি ও সুবিবেক। এই তিনটি শব্দ বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সম্পাদিত ও ২০০৬ সালে প্রকাশিত প্রায় ১২শ পৃষ্ঠার ‘আইন শব্দকোষ’ অর্থাৎ, ইংরেজি আইনি শব্দের বাংলা অভিধানের ভূমিকা থেকে নেওয়া। অভিধানটিতে প্রায় ৬ হাজার ‘ভুক্তি’ অর্থাৎ শব্দ আছে।

মুঘল-বাংলার আইন ছিল ফারসি ভাষায়। অর্থাৎ, মুঘলরা আইন লিখত ফারসি ভাষায়। কারণ, মুঘল সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিল ফারসি। নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমলে ছাপাখানা বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আইনের ছাপার বই মিলত না। ফারসি ভাষায় হাতে লেখা কিছু আইন হয়তো ছিল। অধমের চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। বাংলা মুল্লুকে ওই সব আইন নিয়ে কোনো বইও চোখে পড়েনি। দিল্লিতে প্রচলিত ফারসি ভাষায় লিখিত মুঘলদের আইন ১৯ শতকে ছাপাখানা চালু হওয়ার পর বই আকারে ছাপা হয়েছে। তবে ব্রিটিশ আমলের আগে অর্থাৎ, ১৭৫০ সাল নাগাদ আমাদের এই অঞ্চলে ফারসি ভাষায় লিখিত আইনের কোনো সংকলন নিয়ে আলোচনা চোখে পড়েনি। লম্বা কেচ্ছায় না গিয়ে সংক্ষেপে বলা যায়, তিন-চারজন সাদা চামড়ার ইংরেজ ১৮ শতকের শেষভাগে ইংরেজ প্রণীত আইনের ফারসি ও বাংলার অনুবাদ করেছিলেন। আইন রচনায় বাংলার ভাষার প্রয়োগ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়োজিত কর্মকর্তারাই করেছিলেন। বাংলা ভাষাভাষী আমাদের পূর্বসূরিরা মাতৃভাষা বাংলা ভাষায় আইন রচনার প্রয়াস পেয়েছিলেন কি না তা নিয়ে কোনো গবেষণা চোখে পড়েনি।

ইংরেজরা ১৮৩৪ সালে ঘোষণা দিয়েছিল যে মুঘল সাম্রাজ্যের সরকারি ভাষা ফারসির পরিবর্তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে সরকারি ভাষা হবে ইংরেজি। তখন থেকে ফারসি, বাংলা ইত্যাদি লোপাট হয়ে গেল। ইংরেজি হয়ে গেল আইনের ভাষা। ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা এ দেশ থেকে বিদায় হলো, পাকিস্তান হলো, ভারত হলো। কিন্তু আইনের ভাষা বদলাল না। ইংরেজি আইনের ভাষা হিসাবে থাকল বহাল তবিয়তে।

আমরা স্বাধীন হলাম। আমাদের প্রথম ও প্রধান আইন সংবিধান গৃহীত হলো ১৯৭২ সালে। ১৮৩৪ সালের পর এই সংবিধান ছিল বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম আইন। বাংলা ভাষায় সংবিধান লেখার কাজে তিনজনের যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তার কনিষ্ঠতম সদস্য ছিলেন আনিসুজ্জামান। তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন কমিটির প্রধান। প্রায় দেড় শ বছর যে ভাষায় কোনো আইন লেখা হয়নি সেই ভাষায় স্যার কেমন করে আইনটি লিখলেন তা ভেবে এখনো বিস্মিত হই।

৩. সঠিক দিন তারিখ মনে পড়ছে না। সম্ভবত ২০০২ সালের শেষের দিক। এখানে-ওখানে কাজ করি। কানাডিয়ান আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা (সিডা) ঢাকায় এসেছে। তাদের দিক থেকে উদ্দেশ্য মহৎ। বাংলাদেশের আইনের জগৎকে সাহায্য সহযোগিতা করবে। বুদ্ধি- পরামর্শ জোগান দেওয়ার জন্য আমি তাদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হলাম। মিটিং-সিটিং হতে থাকল। কী করা যায়, কী করা যায়। ১৯৮৭ সালে প্রণীত আমাদের একটা আইনে বলা হয়েছিল যে বাংলাদেশের আইন হবে বাংলা ভাষায়। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত সংসদ আইন পাস করত ইংরেজি ভাষায়। ১৯৮৭ সাল থেকে আইন প্রণয়ন হওয়া শুরু হলো বাংলা ভাষায়। ২০০২ সালে সিডার অফিসে বসে যখন সলা-পরামর্শ করছি তত দিনে বাংলা ভাষায় আইন প্রণয়নের বয়স হয়ে গেছে ১৫ বছর। কিন্তু আইনের কোন ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ কী হবে সেটার কোনো ফয়সালা তখনো হয়নি। সোজা ভাষায়, ইংরেজি-বাংলা আইনের ব্যাপক কোনো অভিধান ছিল না। অবশ্য বলে রাখা দরকার, বাংলা একাডেমি ছোটখাটো একটা অভিধান প্রকাশ করেছিল।

সবাই সম্মত হলেন, ইংরেজি-বাংলার আইন শব্দকোষ দরকার। ভালো কথা। অবশ্যম্ভাবী পরের প্রশ্ন, এই কর্মযজ্ঞ কে করতে পারবেন এবং কে করতে রাজি হবেন। বাংলায় সংবিধান সবার মাথায় ছিল। অতএব উত্তরটাও হলো স্বাভাবিক। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তারপর, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে। অর্থাৎ ইংরেজি আইনি শব্দের বাংলা অভিধান তৈরির প্রস্তাবটা স্যারকে দেবেন কে।

প্রায় দুই দশক আগের ঘটনা। আগেই উল্লেখ করেছি স্যারের বিরাট জগতে এই অধমের ঠায় মেলার কথা নয়। তা সত্ত্বেও একটু আধটু পরিচয় ছিল বলে বীরদর্পে  বলে বসলাম, স্যারকে আমিই বলব।

ইনিয়ে-বিনিয়ে একদিন কথা পাড়লাম। ধারণা ছিল কাজটা যেহেতু কঠিন সেহেতু স্যার সহজেই রাজি হবেন। হলোও তাই। যেহেতু আইনি ব্যাপার তাই এই কথা ওই কথা থেকে কথা গড়াল একজন আইন বিশারদের সহযোগিতার ব্যাপারে। দুই-চার দিনের মাথায় স্যার আমাকে নিয়ে গেলেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বাসায়। ওই বাসায় আমার যাতায়াত ছিল বহু বছর ধরে। তাই কোনো কুণ্ঠাবোধ ছিল না। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যারও সহজেই রাজি হয়ে গেলেন। সিডা অফিসে গিয়ে বীরদর্পে ঘোষণা দিলাম, ডান (done)।

ঢাকার বিজয়নগরে ছোটখাটো অফিস নেওয়া হলো। দুই-চারজন সহকারীও নিয়োগ হলো। অভিধানের কাজ শুরু হয়ে গেল পুরো দমে। অনেকেই ভেবেছিলেন দুই ‘বড় স্যার’ মাঝে মাঝে আসবেন, গবেষণা সহকর্মীদের কাজ সুপারভাইজ করবেন; আদেশ-নির্দেশ দিয়ে চলে যাবেন। বয়স হয়েছে। এখন বুঝেছি যে আদেশ-নির্দেশ ও তত্ত্বাবধান যাঁরা করে তাঁরা মহৎ ও মহান হতে পারেন না। যেখানে কাজ করার কথা এক ঘণ্টা সেখানে যাঁরা কাজ করেন পাঁচ-দশ-বিশ ঘণ্টা তাঁদেরকেই সমাজ মহৎ ও মহান হিসাবে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়।

আইন শব্দকোষ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৬ সালে। প্রকাশনার বছরখানেক আগেই আমি অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।

ফেব্রুয়ারি মাস এলেই ভাষা নিয়ে আমাদের ‘মাতম’ হয়। আইন ও বিচার বোধগম্য হওয়ার প্রধান পূর্বশর্ত হলো আইনের ইংরেজি শব্দগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ তৈরি করা।

বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান চলে গেছেন। আনিসুজ্জামান স্যারও চলে গেলেন। বিচার থাকবে এবং বিচারের জন্য আইনও থাকবে। ভালো বিচারের জন্য বাংলায় আইনি শব্দ তৈরি করতে হবে। তা তৈরির প্রথম ও সবচেয়ে বড় কাজটি করেছিলেন আনিসুজ্জামান স্যার। ৩৫ বছর বয়সে বাংলা ভাষায় আমাদের সংবিধান রচনা করেন। তারও তিন দশক পরে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সঙ্গে মিলে আইন শব্দকোষ রচনা করলেন।

সেই সময়ে অর্থাৎ, আইন শব্দকোষ রচনার প্রথম আমলে স্যারের সঙ্গে আমার অনেক ওঠাবসা হয়েছিল। মহৎ মানুষের ধারণা পেয়েছিলাম। পরে ২০১০-২০১১ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে চাপ তৈরির চেষ্টা করেছিলাম। এই সব বিভিন্ন সুবাদে সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতের জীব হওয়া সত্ত্বেও স্যারের সান্নিধ্যে পেয়েছিলাম। হাজারো মানুষের মতো আমারও এটাই গর্ব, এটাই সৌভাগ্য।

ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিকের আইনের শিক্ষক।