ধূমপান ও তামাক বর্জনের উত্তম সময় রমজান

ধূমপানে রোজা ভঙ্গ হয়। তাই রমজানে দিনের বেলায় বিশ্বাসী মুমিন রোজাদার ব্যক্তি ধূমপান করেন না। অনুরূপভাবে যাঁরা বিভিন্নভাবে তামাক সেবন করেন, তাঁরাও রোজা অবস্থায় তা করেন না। সুতরাং ধূমপায়ী ও তামাকসেবীদের জন্য তা বর্জনের মহাসুযোগ রমজান। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন রমজান মাস আসে, তখন বেহেশতের দরজা খুলে দেওয়া হয়, দোজখের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়; শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। (বুখারি, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা: ২৪১, হাদিস: ১,৭৭৮)। রমজানের রোজা অবস্থায় দিনের বেলায় হালাল খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ না করার শিক্ষা হলো বছরব্যাপী (জীবনভর) হারাম ও ক্ষতিকর খাদ্য ও পানীয় বর্জন করা।

ধূমপান ও তামাক সেবন প্রয়োজনীয়ও নয় এবং উপকারীও নয়; বরং শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই এটি সম্পূর্ণ অপচয়ের শামিল। ইসলামি বিধানে অপচয় করা হারাম; অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং কিছুতেই অপব্যয় কোরো না; নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই; আর শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা-১৭ ইসরা, আয়াত: ২৬-২৭)। পবিত্র মিরাজ রজনীতে যে ১৪টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রিয় নবীজি (সা.) দান করেছেন, এটি তার অন্যতম। এই মিরাজের রাতেই নামাজ ফরজ হয় এবং অপচয় নিরোধের এই নির্দেশ প্রদান করা হয়। সুতরাং এই নির্দেশ নামাজ–রোজার মতোই গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যপূর্ণ।

কিয়ামতের দিনে হাশরের ময়দানে যে ৫টি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কোনো আদম সন্তান এক কদমও নড়তে পারবে না, তা হলো জীবন, যৌবন, আয়, ব্যয়, জ্ঞান। ব্যয় সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা পানাহার করো; কিন্তু অপচয় কোরো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা-৭ আরাফ আয়াত: ৩১)।

এমন কোনো কাজকর্ম যা নিজেকে ধ্বংসের মধ্যে ফেলে বা অঙ্গহানি ঘটায় অথবা স্থায়ী ক্ষতি করে, তা সম্পূর্ণরূপে হারাম, নিষিদ্ধ ও নাজায়েজ। কারণ, মানুষ তার নিজের ¯স্রষ্টাও নয় মালিকও নয়; সবকিছুর মালিক হলেন আল্লাহ তাআলা; আর মানুষ হলো তার আমানতদার বা হেফাজতকারী। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা নিজেদের হাতে নিজেদের ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কোরো না। তোমরা সৎ ও সুন্দর কাজ করো; নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সৎকর্মপরায়ণ লোকদের ভালোবাসেন।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৯৫)।

ধূমপান ও তামাক একপর্যায়ে নেশায় পরিণত হয়, যা ছাড়া ধূমপায়ী ও মাদকসেবী থাকতে পারে না। ইসলামি শরিয়তে নেশা সর্বৈব হারাম। জাহান্নাম বা দোজখের বৈশিষ্ট্য তিনটি: আগুন, ধোঁয়া ও দুর্গন্ধ। এই তিনটির সমাহার ঘটে ধূমপানে। সর্বোপরি ‘ধূমপান মাদক
সেবনের সোপান’।

ধূমপান ও তামাকের ক্ষতি সর্বগ্রাসী। ধূমপান ও তামাক শুধু ব্যবহারকারীর নয়, ব্যাপকভাবে অন্যদেরও ক্ষতি সাধন করে। এটি দেশ, জাতি ও সমাজ সভ্যতার চরম শত্রু। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা সতর্ক থাকো এমন ফেতনা সম্পর্কে, যার ক্ষতিকর প্রভাব শুধু জালিম অপরাধী বিশেষের প্রতি আপতিত হবে না (বরং সামগ্রিকভাবে সবার ক্ষতি হবে)। আর জেনে রাখো নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা কঠোর প্রতিবিধানকারী।’ (সুরা-৮ আনফাল, আয়াত: ২৫)।

নিজের ক্ষতি করার যেমন এখতিয়ার নেই, তেমনি অন্যের ক্ষতি করাও জায়েজ নেই। একজন ধূমপায়ী ব্যক্তি নিজের ক্ষতির পাশাপাশি আশপাশের অন্যদেরও ক্ষতি করে থাকে, যা সম্পূর্ণ হারাম ও কবিরা গুনাহ। পেঁয়াজ একটি হালাল খাদ্য, ক্ষতিকরও নয় বরং উপকারী। কিন্তু কাঁচা পেঁয়াজে একধরনের ঝাঁজালো গন্ধ থাকে, যা অনেকে পছন্দ করেন না। তাই মহানবী (সা.) নির্দেশ দিলেন: তোমরা কাঁচা পেঁয়াজ খেয়ে (মুখের দুর্গন্ধ দূর না করে) মসজিদে বা জনসমাগমে আসবে না। (তিরমিজি)। যারা ধূমপান করে বা তামাক সেবন করে, তাদের মুখে ও শরীরে একধরনের উৎকট বিশ্রী দুর্গন্ধ ছড়ায়; যা পাশের মানুষের কষ্টের কারণ হয় এবং তা হারাম ও নাজায়েজ।

যেহেতু বিড়ি–সিগারেট ও তামাকের কোনো উপকারিতা নেই এবং এর কোনো শরিয়াসম্মত বৈধ বা ইতিবাচক বা কল্যাণকর ব্যবহারও নেই; বরং এর মধ্যে কেবল ক্ষতিই নিহিত। তাই এর উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিক্রয় ও বিপণন কোনোটিই জায়েজ নয়। সুতরাং শুধু ধূমপান ও তামাক সেবন নয়; বরং তামাকসহ এর যাবতীয় উপকরণ উৎপাদন, মজুতকরণ ও সংরক্ষণ এবং বিপণন ও বিতরণ সবই বন্ধ করতে হবে।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজি (সা.) রবিআহ গোত্রের প্রতিনিধিদের চারটি কাজের নির্দেশ দিলেন এবং চারটি কাজ বারণ করলেন। এক আল্লাহর ওপর ইমান আনা (এক আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং হজরত মুহাম্মদ [সা.] আল্লাহর প্রেরিত রাসুল), সালাত কায়েম করা, জাকাত প্রদান করা এবং রমজান মাসে সিয়াম পালন করা; গনিমতের এক–পঞ্চমাংশ দান করা। নিষেধ করলেন: শুকনো লাউয়ের খোল, সবুজ কলসি এবং আলকাতরার পলিশকৃত পাত্র ব্যবহার (যেসব মদপাত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়)। (বুখারি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ৬৭-৬৮, হাদিস: ৮৭; ই.ফা.)। 

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]