ঘরে থেকে কাজ: আগামী দিনের সম্ভাবনা

অনেকেই এখন অফিসের কাজ বাড়িতে বসে করছেন। ছবি: রয়টার্স
অনেকেই এখন অফিসের কাজ বাড়িতে বসে করছেন। ছবি: রয়টার্স

আমরা করোনাকালীন বিশ্বজুড়ে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় নানা রকম পরিবর্তন লক্ষ করছি। এটাকে আমরা পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে মানুষের মানিয়ে চলার অবিরাম প্রচেষ্টা হিসেবে দেখতে পারি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধের উদ্দেশ্যে দেশে দেশে লকডাউন আরোপ করা হয়েছে। লকডাউনের সময় অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের বাসায় থেকে কাজ চালিয়ে যেতে নির্দেশনা দিয়ে আসছে। এর মাধ্যমে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বা ‘ঘরে থেকে কাজ’ করার একটি নতুন ধারণা কর্মজীবীদের মধ্যে আরোপিত ও ক্ষেত্রবিশেষে জনপ্রিয় হতে শুরু করে।

‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বা ‘ঘরে থেকে কাজ’ করার ধারণাটি আমাদের দেশে কিছুটা নতুন হলেও পশ্চিমা দেশগুলোতে এটি প্রায় ৫০ বছরের পুরোনো একটি চর্চা। ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লবের প্রভাবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্ট সর্বপ্রথম এটা শুরু করে। এর উদ্দেশ্য ছিল কর্মীদের অফিসে আসা–যাওয়ার জ্বালানি খরচ কমানো। এর প্রেক্ষাপটে অনেক প্রতিষ্ঠানই এই নতুন ধারণার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার জন্য নিরীক্ষা শুরু করে। এই নিরীক্ষার অংশ হিসেবে অনেক পশ্চিমা প্রতিষ্ঠান তাদের কিছু কর্মীকে ঘরে থেকে কাজ করার অনুমতি দেয়। এভাবে গত শতকের আশির দশকে অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে পেরেছিল। যদিও সেই সময় কেউ কেউ এই ধারণার বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ঘরে থেকে কাজ করার প্রবণতাটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে শুরু করে।
এই পদ্ধতির জনপ্রিয়তা এত দ্রুত বাড়তে থাকে যে একে কেন্দ্র করে একটি নতুন পেশাজীবী গোষ্ঠী ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে। বাড়িতে বসে টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কল সেন্টারগুলোর আবির্ভাব ঘরে থেকে কাজ করার প্রবণতার হাত ধরেই বিকশিত হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের সপ্তাহের একটি সময়ে বাসায় বসে কাজ করার অনুমতি দিতে শুরু করে। পশ্চিমা সমাজের এ ধারণাটি লুফে নেওয়ার পেছনের সমসাময়িক পুঁজিবাদী চেতনা দ্বারা প্রভাবিত, কেননা এখানে পুঁজির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে মুনাফা বাড়ানোই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বলে ধরে নেওয়া যায়।
আমরা যদি এখন কিছু বিশেষ পেশার দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, কিছু কিছু পেশায় আগে থেকেই ঘরে থেকে কাজ করার প্রবণতা রয়েছে অনেক দিন ধরে। এর মধ্যে যে পেশাটির নাম সবার প্রথমে আসে সেটি হলো শিক্ষকতা। এ ছাড়া যাঁরা ফ্রিল্যান্সিং করে থাকেন, তাঁরা মূলত ঘরে থেকেই কাজ করে থাকেন। লেখক ও সাংবাদিকদের কাজকেও আমরা সর্বাগ্রে রাখতে পারি।
আমরা যদি সাম্প্রতিক সময়ে এই ঘরে থেকে কাজ করার প্রবণতাটির দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, এটি মূলত একটি শ্রেণিভিত্তিক শহুরে সমাজের জন্য প্রযোজ্য একটি ধারণা, যা তাদের কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। ঘরে থেকে কাজ করার যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন, সেটি এমনকি শহুরে সমাজেও সবার নেই। এখানে উচ্চগতির ইন্টারনেট, কম্পিউটার বা ল্যাপটপ অনিবার্য বিষয়। তাই ঘরে থেকে কাজ করার এই সক্ষমতা নিশ্চিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে একইভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
কেননা, অনেক প্রতিষ্ঠানের কাজের ধরন এমন যে ঘরে বসে কাজ করা প্রায় অসম্ভব। ঘরে থেকে কাজ করার মাধ্যমে অনেক প্রতিষ্ঠানই এই করোনাকালীন তাদের কার্যক্রম চলমান রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং তাদের কর্মীদের নিয়মিত বেতন–ভাতা পরিশোধ করতে পারছে। আমরা বিভিন্ন খবরে দেখতে পাই, অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের নিয়মিত বেতন–ভাতা দিতে পারছে না বা কেউ কেউ আংশিক বেতন–ভাতা পরিশোধ করতে পারছে। এমতাবস্থায় তাদের যদি ঘরে থেকে কাজ করার সক্ষমতা থাকত এবং তারা যদি তা বাস্তবায়ন করত, তাহলে তাদের এই প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হতো না।
আবার আমাদের দেশের কারও কারও মধ্যে ঘরে থেকে কাজ করার ব্যাপারে একধরনের অনীহা কিংবা ভীতি কাজ করে বলে দেখা যায়। কারও কারও মধ্যে ঘরে থেকে কাজ করার ক্ষেত্রে কর্মঘণ্টার নিয়ন্ত্রণহীনতা একটি শঙ্কার বিষয়াকারে দেখা দিচ্ছে। কেননা, ঘরে থেকে কাজ করার ক্ষেত্রে দৈনিক ৮ কর্মঘণ্টা মেনে চলা বেশ কঠিন। পাশাপাশি প্রযুক্তিভীতি কারও কারও জন্য ঘরে থেকে কাজ করার একটি অন্তরায় বলে কেউ কেউ মনে করেন। ঘরে থেকে কাজ করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা একটি বড় বিষয়। কারণ, অন্যদের সঙ্গে নিয়মিত মিটিং বা সভা করার ক্ষেত্রে ইন্টারনেট সংযোগ ও কম্পিউটার বা ল্যাপটপ থাকা দুটি পূর্বশর্ত।
এমন নানা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ঘরে থেকে কাজ করা বা ওয়ার্ক ফ্রম হোম বিষয়টি ইতিমধ্যেই অনেকের কাছে বেশ ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। আমরা যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, এই করোনাকালীন অনেক স্কুল তাদের কার্যক্রম অনলাইনভিত্তিক চালিয়ে আসছে। আমরা যদি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব যে একটি অংশ তাদের পাঠদান অনলাইন প্রক্রিয়ায় চালিয়ে আসছে। বিভিন্ন খবরে এটাও প্রকাশিত হচ্ছে যে বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় যেমন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় আগামী এক বছর তাদের যাবতীয় শিক্ষা প্রদান অনলাইনভিত্তিক করবে বলে ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া অনেক সরকারি–বেসরকারি এই করোনার সময়ে ঘরে থেকে কাজ করে যাচ্ছে, যা খুবই ইতিবাচক একটি বিষয়।
আমাদের দেশের নানাবিধ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা লক্ষ করি যে ঘরে থেকে কাজ করার ধারণাটি একটি বিশেষ শ্রেণির কাছে ধীরে ধীরে হলেও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, যা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলার একটি প্রচেষ্টা। নানাবিধ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ভবিষ্যতে এই ধারণাটি আমাদের কর্মক্ষেত্রকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে বলে মনে হয়।

ড. বুলবুল সিদ্দিকী: সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ এবং গবেষক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়