গরিব জেলাগুলোতে ত্রাণেও বৈষম্য?

৫০ লাখ সাহায্যগ্রহীতার তালিকায় প্রশ্নের ঊর্ধ্বে পাওয়া গেছে মাত্র সাড়ে ৭ লাখ মানুষের নাম। ছবি: ফাইল ফটো, প্রথম আলো
৫০ লাখ সাহায্যগ্রহীতার তালিকায় প্রশ্নের ঊর্ধ্বে পাওয়া গেছে মাত্র সাড়ে ৭ লাখ মানুষের নাম। ছবি: ফাইল ফটো, প্রথম আলো

বাংলাদেশের উন্নয়ন চরম বৈষম্যমূলক। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও বৈষম্য কমানোর পরিবর্তে বৈষম্য জিইয়ে রাখার মতো বরাদ্দ দেওয়া হয়। বৈষম্যনীতির এ অনুশীলন করোনাজনিত মহামারির চরম দুর্দিনেও জারি রাখা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় যে চাল ও অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে, তা অকল্পনীয় বৈষম্যপূর্ণ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ৫০ লাখ পরিবারের জন্য যে আড়াই হাজার করে টাকা এককালীন বরাদ্দ করা হয়েছে, তার চিত্রও অভিন্ন। ৫০ লাখ সাহায্যগ্রহীতার তালিকায় প্রশ্নের ঊর্ধ্বে পাওয়া গেছে মাত্র সাড়ে ৭ লাখ মানুষের নাম। সরকার চারজনের একটি পরিবার ধরে ২ কোটি গরিব মানুষকে এ সহায়তা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেছে। দেশের সর্বশেষ আদমশুমারি, দারিদ্র্য মানচিত্র এবং সরকারি বরাদ্দ অনুযায়ী ত্রাণ বিতরণের সেই চিত্র তুলে ধরছি।

সবচেয়ে ধনী জেলার চিত্র
সরকারি তথ্যমতে বাংলাদেশের সবচেয়ে কম দারিদ্র্য নারায়ণগঞ্জ জেলায়। এ জেলায় মোট গরিব মানুষের সংখ্যা ৭৬ হাজার ৬৫৩। এখানে মোট গরিব পরিবার ৯ হাজার ১৬৩টি। করোনা সংকট থেকে উত্তরণে অসহায় মানুষদের এককালীন আর্থিক সহায়তা কার্যক্রমে এ জেলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার পরিবার। মোট গরিব পরিবারের চেয়ে লক্ষাধিক পরিবারের জন্য বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, যেসব পরিবার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আছে, তারা এই সহায়তা পাবে না। নারায়ণগঞ্জে গরিব পরিবারের চেয়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বেশি পরিবার আছে, তা সহজে অনুমেয়।

দ্বিতীয় কম গরিব জেলার চিত্র
মুন্সিগঞ্জে গরিব পরিবারের চেয়ে আর্থিক বরাদ্দ বেশিসংখ্যক পরিবারের জন্য দেওয়া হয়েছে। ওই জেলায় সরকারি তালিকা অনুযায়ী গরিব মানুষের সংখ্যা ৪৬ হাজার ৫৭৫। এখানে গরিব পরিবার ১১ হাজার ৬৪৩টি। এই জেলায় ২ হাজার ৫০০ করে টাকার এককালীন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫২ হাজার পরিবারের জন্য। এই জেলাতেও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় এই সংখ্যার চেয়ে বেশি গরিব পরিবার আছে।

শতকরা হারে সবচেয়ে গরিব জেলার চিত্র
দেশের সবচেয়ে বেশি গরিব দুটি জেলার চিত্র দেখা যাক। বাংলাদেশের শতকরা হারে বেশি গরিব মানুষ বাস করে কুড়িগ্রামে। ১০০ জনে প্রায় ৭১ জন মানুষই সেখানে গরিব। এ জেলায় মোট গরিব মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ ৬৫ হাজার ৪৫। এখানে মোট গরিব পরিবার ৩ লাখ ৬৬ হাজার ২৬১টি। এ জেলায় এককালীন অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৯০ হাজার পরিবারের জন্য। প্রায় পৌনে ৩ লাখ গরিব পরিবার এই আর্থিক সহায়তা পাবে না।

সবচেয়ে বেশিসংখ্যক গরিবের জেলার চিত্র
দিনাজপুর দারিদ্র্যের হার বিবেচনায় দ্বিতীয় গরিব। কিন্তু গরিবের সংখ্যা বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি গরিব মানুষ এ জেলায় বাস করে। এ জেলায় মোট গরিব মানুষ ১৯ লাখ ৯৯ হাজার ৪৯০ জন। এখানে ৪ লাখ ৯৯ হাজার ৮৭২টি গরিব পরিবার আছে। এ জেলায় মোট ৭৭ হাজার পরিবারের জন্য ২ হাজার ৫০০ করে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ জেলায় সোয়া চার লাখ পরিবার বঞ্চিত হবে।

কম গরিব জেলায় বেশি আর বেশি গরিব জেলায় কম বরাদ্দ
১১ মে পর্যন্ত জেলাভিত্তিক যে চাল বিতরণ করা হয়েছে তার একটি পরিসংখ্যান এখানে তুলে ধরছি। চারজনের এক পরিবার ধরে পরিবারভিত্তিক গড়ে নারায়ণগঞ্জে বরাদ্দ ২০৮ কেজি চাল, মুন্সিগঞ্জে ১৫২ কেজি চাল। পরিবারপ্রতি গড়ে কুড়িগ্রামে ৬ কেজি এবং দিনাজপুরে ৫ কেজি চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জেলাভিত্তিক যে সামান্য আর্থিক বরাদ্দ তাও এই বৈষম্যের ভিত্তিতে করা। দেশের কম গরিব জেলাগুলোর সঙ্গে বেশি গরিব জেলাগুলোর বৈষম্যপূর্ণ ত্রাণ ও সহায়তা অব্যাহত রয়েছে। যে পরিসংখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা চুরি কিংবা অনিয়মের বিষয় আমলে না নিয়েই। তা ছাড়া সর্বশেষ আদমশুমারির সংখ্যার চেয়ে মানুষও কিছু বেড়েছে। তাই এই পরিসংখ্যানের চেয়ে বাস্তবে পরিবারগুলো আরও কম বরাদ্দ পাবে। যে জেলাগুলোতে কম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেগুলো চাহিদার তুলনায় কতটা অপ্রতুল, সেটি সহজেই বোঝা যাচ্ছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনা
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় দেশের জেলাগুলোকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করে ত্রাণ বিতরণ করছে। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে এই শ্রেণিবিন্যাস করেছে, তা বোধগম্য নয়। তবে জেলাভিত্তিক গরিব মানুষের সংখ্যা হিসাব না করেই যে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে, এটি একটি শিশুও বুঝবে। অথচ, একটি মন্ত্রণালয় যেভাবে এই বণ্টন ব্যবস্থা জারি রেখেছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং চরম বৈষম্যপূর্ণ।
সরকারপ্রধানের কাছে এসব বিষয়ে প্রকৃত খবর পৌঁছানো কিছুটা কঠিন বলেই মনে হচ্ছে। যেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রংপুর বিভাগের জেলাগুলোর সঙ্গে তৃণমূলের অবস্থা জানার চেষ্টা করছিলেন, সেদিন দেখলাম সরকারি কর্মকর্তা এমনকি একজন রাজনীতিকও মাঠের প্রকৃত সমস্যার কথা তুলে ধরলেন না। দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জেলাগুলোর নিয়তি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কারও ভাবার মতো নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি আছে কি না, সন্দেহ।

তৃণমূলের রাজনীতিক-আমলারা নির্বিকার
ভিডিও কনফারেন্সের দিনে রংপুরের রাজনীতিকেরা যে সময় বলেছেন রংপুরে কোনো সমস্যা নেই, ঠিক সেই সময় সিটি করপোরেশনের সামনে হাজারো মানুষ ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। তারপর কুড়িগ্রামে ইউএনওর গাড়ি ভাঙচুর করেছেন। দিনাজপুরেও ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে। কেউ কেউ এটাকে দুরভিসন্ধিমূলক কিংবা সাজানো আখ্যা দিতে পারেন। পরিসংখ্যান বলে, সারা দেশের তুলনায় ত্রাণ বণ্টন সুষম না হওয়ার ফলে এসব হচ্ছে। আমাদের একটি কথা অবশ্যই মনে রাখা জরুরি, শরীরের যেকোনো একটি অঙ্গে অসুস্থতা দেখা দিলে অশান্তি সারা শরীরেই হবে।

বৈষম্যপূর্ণ বরাদ্দের প্রতিকার চাই
অতীতে আমাদের চরম বৈষম্যের ইতিহাস আছে। আমরা করোনার মতো জটিল সমস্যায় সেগুলোর পুনরালোচনায় যেতে চাই না। খাদ্যনিরাপত্তা ছাড়া করোনার কালে সংক্রমণ রোধ করা অসম্ভব। সম্মানিত দুর্যোগ ও ত্রাণমন্ত্রী এই বৈষম্যমূলক ত্রাণ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামনে হাজির করবেন? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই এই বৈষম্যপূর্ণ বিধিব্যবস্থা রোধ করবেন।

(তথ্য নেওয়া হয়েছে ২০১১ সালের আদমশুমারি, ২০১৬ ও ২০১৯-এর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দারিদ্র্য মানচিত্রবিষয়ক প্রতিবেদন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া হিসাব এবং জেলাওয়ারি বরাদ্দের হিসাব থেকে।)

তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এবং পরিচালক, রিভারাইন পিপল।
[email protected]