রোদনভরা দিনে ঈদ

রোদনভরা এ বসন্ত সখী কখনো আসেনি বুঝি আগে।

এই রকম বিষণ্ন ঈদও বুঝি কখনো আসেনি। কেউ যদি ছয় মাস আগেও বলত, পৃথিবীর সবাই ঘরে বন্দী হয়ে থাকবে দিনের পর দিন, স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত, হাটবাজার-কলকারখানা সব বন্ধ থাকবে; প্লেন উড়বে না, লঞ্চ ছাড়বে না—তাহলে সে কথা কেউই বিশ্বাস করত না, সবাই হেসেই উড়িয়ে দিত। কেউ যদি বলত, বিশ্বকাপ ফুটবল অনিশ্চত হয়ে পড়বে, অলিম্পিক পিছিয়ে যাবে, লোকে তাকে উন্মাদ ছাড়া আর কীই–বা ভাবতে পারত! যেদিন প্রথম আমি বিবিসির অনলাইনে ছবি দেখলাম, কাবা শরিফ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, একজন লোকও নেই, সেদিন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বাংলাদেশে মার্চের শেষে যখন সাধারণ ছুটি দেওয়া হলো, সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হলো, আমি ভাবছিলাম, ১০ দিনের জায়গায় ছুটি ১৪ দিন করা উচিত, আচ্ছা আরও ৭ দিন ছুটি বাড়িয়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে! সেই মার্চের শেষ থেকে আজ মের শেষ, দুই মাস হয়ে গেল আমরা গৃহে অন্তরীণ।

এই অবস্থায় ঈদ এসেছে আমাদের দ্বারে। রোদনভরা ঈদ। একে তো করোনা তার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে, আমাদের নিকটাত্মীয় মারা গেছেন করোনায়, অনেক আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, মৃতের তালিকা লম্বা হচ্ছে; তার ওপর আছে করোনার টেস্ট করতে গিয়ে বিপত্তির শিকার হওয়া। করোনাক্রান্ত মানুষ ও পরিবারগুলোর প্রতি সমাজের অকারণ এবং অন্যায় রোষ। মাকে বনে ফেলে রেখে গেছে ছেলেমেয়েরা, এই দেশে এই খবরও আমাদের পড়তে হলো। আমাকে ড. মুনতাসীর মামুন বলেছিলেন তাঁর মাকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে তিনি কী রকম অসহায় বোধ করছিলেন, নিজে নিজে ট্রলি জোগাড় করে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিলেন হাসপাতালে! তাঁর মতো মানুষের যদি এই অভিজ্ঞতা হয়, তাহলে সাধারণ নাগরিকদের অবস্থা কী, সহজেই অনুমেয়। মুনতাসীর মামুন স্যারের মা ৮৫ বছরের জাহানারা খানের আগে হার্টের অপারেশন হয়েছে, তিনি শ্বাসকষ্টের পুরোনো রোগী, তিনি করোনাক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। মুনতাসীর মামুন স্যার এরপর নিজে করোনাক্রান্ত হন, তিনিও চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এই দুই উদাহরণ আমাদের সাহসও জোগায়।

আছে মানুষের অসহায়ত্ব। দুই মাস কাজ বন্ধ করে বাড়িতে বসে আছেন অনেকেই। কেমন করে সংসার চলবে, চুলায় হাঁড়ি উঠবে একজন রিকশাওয়ালার, একজন দোকানির, একজন বাসশ্রমিকের, একজন তাঁতির, একজন নির্মাণশ্রমিকের, একজন ক্ষুদ্র-উদ্যোক্তার। হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ। কী করছেন ঢাকা কিংবা কক্সবাজারের হোটেল-মোটেলে কাজ করা মানুষগুলো? পোশাকশিল্প কারখানায় অর্ডার বাতিল হচ্ছে, শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। প্রবাসী শ্রমিকেরা বিদেশের পথে বসে গেছেন।

বিপদ কখনো একা আসে না। ঘূর্ণিঝড় আম্পান এসে ঘরবাড়ি ভেঙে, জনপদগুলো লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে। বহু গ্রাম প্লাবিত। খেতের ফসল, গাছের ফল, ঘেরের মাছ নষ্ট হয়ে গেছে। কত মানুষ গৃহহারা। যাঁদের ঘরভাড়ি ভেঙেছে, যাঁদের গ্রাম প্লাবিত হয়েছে, যঁারা আশ্রয় নিয়েছেন বাঁধের ওপরে, তাঁদের দিনরাত সব এক হয়ে গেছে। টেলিভিশনের পর্দায় ঘরহারা মানুষের কান্না দেখে চোখ ভিজে ওঠে।

এই অবস্থায় এসেছে ঈদ। ঈদের একটা বড় সৌন্দর্য হলো মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন। মোলাকাত। গ্রামে নিজের মা–বাবা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিলিত হওয়া যেমন আছে, তেমনি ঈদের নামাজের পর দিনভর কোলাকুলিও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকেই পোক্ত করে। এবার কী হবে?

এবারের ঈদ হোক তাই নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার। ফিতরা দিতে হবে, জাকাত দিতে হবে। দান শুরু করতে হয় নিজের আত্মীয়স্বজনের মধ্য থেকে। এরপর পাড়া প্রতিবেশী। দুস্থ অসহায় পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। প্রবাসীদের মধ্যে যঁাদের সংগতি আছে, তঁারাও নিজেদের পরিবারে, একটু পিছিয়ে পড়া আত্মীয়স্বজনকে বিদেশ থেকে টাকা পাঠাবেন, এই হলো প্রত্যাশা।

ঈদ এসেছে খুব একটা করুণ সময়ে। তবে জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে চলবে না। মানুষের জীবনে আনন্দের দরকার আছে। মানুষের জীবনে উৎসবের দরকার আছে। সাধ্যমতো, এবং পরিমিতি বজায় রেখে আমরা আনন্দও করব। তবে সবচেয়ে বড় আনন্দ হবে সেটাই, যদি আমরা একটা ম্লানমুখে হাসি ফোটাতে পারি। এবারের ঈদ যত না আনন্দের, তারও চেয়ে বেশি কর্তব্য পালনের। মানুষ হিসেবে মানবতার ডাকে সাড়া দেওয়ার। মানুষ হিসেবে মানবিক হয়ে ওঠার।

সরকার অনেকগুলো বড় কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে আছে ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ টাকা পাঠানো। এ ছাড়া গরিব মানুষকে চাল দেওয়া, ১০ টাকা কেজিতে চাল বিক্রি ইত্যাদি। এর মধ্যে আবার মাঠ থেকে আসছে দুর্নীতির খবর। রিলিফের চালসহ ধরা পড়ছে কেউ কেউ। এইখানে দরকার নজরদারি। প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, গরিবের হক কাউকে আত্মসাৎ করতে দেওয়া হবে না, এই নীতির কঠোর প্রয়োগ দরকার। দরকার স্বাধীন সাংবাদিকতা। সেটা যেমন প্রাতিষ্ঠানিক গণমাধ্যম করবে, তেমনি করবেন নাগরিক-সাংবাদিকেরা। সামাজিক মাধ্যমে। সেখানে যেমন দরকার হবে দায়িত্বশীলতা, সত্যতার যাচাই-বাছাই, তেমনি দরকার হবে অভয়ের পরিবেশ। আমরা দেখেছি, ফেসবুকের কারণে বহু অন্যায়ের প্রতিবিধান হয়েছে। দায়িত্বশীল নাগরিকদের সেই সচেতন সজাগ ভূমিকা অব্যাহত রাখতে হবে, রাখতে দিতে হবে।

করোনার মধ্যে আম্পান। চিন্তাও করা যাচ্ছে না আমাদের কী হবে! কিন্তু সাহস হারালে চলবে না। করোনার বিরুদ্ধেও লড়তে হবে, আম্পানের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠে আবার সামনের দিকেও এগোতে হবে। সুখবরও তো পাচ্ছি। প্লাজমা পদ্ধতিতে চিকিৎসায় ঢাকাতেই সুফল মিলছে। করোনার চিকিৎসায় বেস্ট প্র্যাকটিস কী, তা আমরা জেনে যাব। আমরা আশা করি, খুব তাড়াতাড়ি টিকাও আবিষ্কৃত হয়ে যাবে এবং তা আমাদের দেশেও চলে আসবে। বেশি বেশি করে করোনার পরীক্ষা করা দরকার। বাংলাদেশ সবচেয়ে কম পরীক্ষা করা দেশগুলোর একটা, এটা শুনতে ভালো লাগে না, এটার ফলও ভালো আশা করা যায় না। আশা করি, করোনা পরীক্ষার সক্ষমতা বাড়ানোর যে কথা বলা হচ্ছে, তা বাস্তবায়িত হবে।

আপৎকালীন জরুরি কর্তব্যের কালটা অতিবাহিত করা গেলে আমাদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হবে স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানো। এটাকে গণমুখী করতে হবে। এটা বড় বেশি মুনাফাকেন্দ্রিক, ধনীতোষণকারী একটা ব্যবস্থা হয়ে আছে। সরকারি ব্যবস্থার মধ্যে যেমন আছে অপ্রতুলতা, বাজেটের, অবকাঠামোর, লোকবলের অভাব; তেমনি আছে দুর্নীতি, অব্যবস্থা, বিশৃঙ্খলা। এই খাতের আগাপাছতলা সংস্কার করতে হবে।

আমরা দীর্ঘদিন ঘরে বসে থাকতে পারব না। আমাদের দুর্বল অর্থনীতি তা সইতে পারবে না। আপাতত দেশপ্রেমিকের কর্তব্য হলো নিজেকে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা করা। এ ভাইরাস বড়ই ছোঁয়াচে। ঘন ঘন সাবান–পানিতে হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার করা, ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখা কর্তব্য। কিন্তু এই গরিব দেশে, ঘনবসতির দেশে, প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত দেশে কজন মানুষের পক্ষে এসব স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবে মেনে চলা সম্ভব, তাই–বা কে জানে! ঘরে থাকাই শ্রেষ্ঠ উপায় করোনামুক্ত থাকার। কিন্তু যাদের ঘর নেই, তাদের কী বলব?

আমাদের দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাতে হবে তাঁদের, যাঁরা বাইরে যাচ্ছেন আমাদের ভালো রাখতে। ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, ওষুধের দোকানের কর্মী, খাবারের দোকানের কর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, পুলিশ, সেনাবাহিনীর সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাংবাদিক, ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, জরুরি সেবাদানকারী, পণ্য পরিবহনকারী, পোশাকশ্রমিক, এমনি আরও অনেকে। স্যালুট আপনাদের।

সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করে জানাই ঈদ মোবারক।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক