'গাড়িওয়ালাদের' ঈদ ও গণমানুষের দুর্ভোগ

ফেরিতে উঠতে ঈদে ঘরমুখী মানুষের ঢল। গতকাল সকালে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ঘাটে। ছবি: সংগৃহীত
ফেরিতে উঠতে ঈদে ঘরমুখী মানুষের ঢল। গতকাল সকালে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ঘাটে। ছবি: সংগৃহীত

গত ১৪ মে যখন সাধারণ ছুটির মেয়াদ ৩০ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়, তখন সরকার সবাইকে কর্মস্থলে থাকার পরামর্শ দেয়। ছুটির প্রজ্ঞাপনে বলা হয়: সাধারণ ছুটি চলাচলে নিষেধাজ্ঞার মধ্যে কেউ কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবে না। এই সময় সড়কপথে গণপরিবহন, যাত্রীবাহী নৌযান ও রেলচলাচল এবং অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল বন্ধ থাকবে। জরুরি সেবায় নিয়োজিত যানবাহন ছাড়া অন্যান্য যানবাহন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে ঢাকার প্রবেশ ও প্রস্থানের প্রতিটি স্থানে পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়। ঢাকা ত্যাগ কিংবা প্রবেশের যৌক্তিক কারণ দেখাতে না পারায় অনেক নাগরিককে ফেরত পাঠানো হয়। ১৭ মে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা ঘোষণা দিলেন, ‘কাউকে ঈদে বাড়ি যেতে দেওয়া হবে না।’

শুধু ঘোষণা নয়, ঈদে মানুষের বাড়িযাত্রা ঠেকাতে ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার দুটি রুটে সরকার ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয়। তারপরও অনেক মানুষ যে যার মতো বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করেছে। জনস্রোত ঠেকাতে সরকার একপর্যায়ে পাটুরিয়া ও মাওয়া ফেরিঘাটের ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয়। সে সময় বাড়িমুখী অনেক মানুষকে ঢাকায় ফেরতও পাঠানো হয়। কিন্তু ফেরিঘাট পর্যন্ত যেতে দেওয়ার ফল হলো পুরো সড়কে ভিড় ও বিশৃঙ্খলা।

প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ার প্রেক্ষাপটে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে মানুষ মোটামুটি ইতিবাচকভাবেই নিয়েছিল। এখনো করোনাক্রান্ত রোগীদের বেশির ভাগ ঢাকার বাসিন্দা। তাই ঈদে বাড়ি যাত্রা মানে গ্রামগঞ্জে করোনার ঝুঁকি বাড়ানো। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বারবার হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। কেউ কেউ ঈদের সময় কারফিউ জারির পরামর্শ দিয়েছেন।
এরপর বৃহস্পতিবার রাতে সরকার হঠাৎ ঈদে ঘরমুখী মানুষের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ শিথিল করে দেয়। আগে বলা হয়েছিল, ঈদে কেউ বাড়ি যেতে পারবে না। এখন বলা হচ্ছে, বাড়ি যেতে পারবে, তবে ব্যক্তিগত গাড়ি বা মাইক্রোবাসে। সরকারের এই ঘোষণার পর ঢাকার প্রবেশ ও প্রস্থানপথের তল্লাশি কার্যত তুলে নেওয়া হয়। শুক্রবার ভোর থেকে হাজার হাজার মানুষকে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মাইক্রোবাসে করে ঢাকা ত্যাগ করতে দেখা যায়। অনেকে ভ্যানগাড়ি, মোটরসাইকেল এমনকি ট্রাকযোগেও যাচ্ছেন।

সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্তে বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, সরকার যখন বিধিনিষেধ তুলেই নেবে, এত নাটক করার কী প্রয়োজন ছিল? ফেসবুকে একজন লিখেছেন, ‘এ দেশটা কি বাড়ি আর গাড়িওয়ালাদের?’ আরেকজনের মন্তব্য, ‘কষ্ট করে গরিব মানুষ বাড়ি ফেরার পর কি ধনীদের জন্য উন্মুক্ত করা হলো গাড়িতে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ? তাহলে গণপরিবহন আটকে রেখে লাভ কী?’
সরকার যদি ঈদে মানুষকে কর্মস্থল ত্যাগ করতে বা বাড়ি যেতেই দেবে, তাহলে কেন গণপরিবহন বন্ধ রাখল? গণপরিবহন বন্ধ রাখা মানে সাধারণ মানুষের চলাচলে বাধা দেওয়া। আর ব্যক্তিগত গাড়ি বা মাইক্রোবাসে যেতে দেওয়ার অর্থ হলো যাঁদের এই সুবিধা আছে, তাঁরাই কেবল যেতে পারবেন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) জানিয়েছে, ‘পুলিশ সদর দপ্তর থেকে আমাদের কাছে নির্দেশনা এসেছে, যাঁরা বাড়ি যেতে চান, তাঁরা বাড়ি যেতে পারবেন। পুলিশ পথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় চেকপোস্টও থাকবে। তবে গণপরিবহন বন্ধ থাকবে।’
এ ধরনের বৈষম্যমূলক নির্দেশনা আইনের পরিপন্থী। সরকার বলেছে, গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। ফেরি কি গণপরিবহন নয়?

সরকার বিধিনিষেধ শিথিল করার পর মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ও মাওয়া ফেরিঘাট দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার ঈদে ঘরমুখী মানুষের চাপ বেড়েছে। প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, পিকআপ ভ্যান ও মোটরসাইকেল যোগে যাত্রীরা ঢাকা থেকে ফেরিঘাটে যাচ্ছেন। ফেরি পার হয়ে ওপার থেকে আবার রেন্ট–এ–কার, মাইক্রো বা অন্য কোনো বাহনে যাবেন। অনেকেই বলেছেন, যাঁদের গাড়ি আছে, তাঁরাই কি কেবল ঈদ করবেন? যেকোনো উপায়ে বাড়ি যেতেই হবে। এই যেকোনো উপায়ে বাড়ি যেতে গেলেই দুর্ঘটনা ঘটে মানুষ মারা যায়। কয়েক দিন আগে লোহার রডবোঝাই ট্রাকে লুকিয়ে রংপুর যাচ্ছিলেন ১১ জন শ্রমিক। গাইবান্ধায় ট্রাকটি উল্টে গেলে ১১ জনই মারা যান।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে বাস–মিনিবাস বন্ধ রেখেছে সরকার। একসঙ্গে অনেক মানুষ একত্র হলে মানুষ সংক্রমিত হতে পারে। কিন্তু ফেরিতে তো একসঙ্গে শত শত মানুষ নদী পার হচ্ছে। সেখানে কি সংক্রমণ প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থাই নেই? গণপরিবহন অর্ধেক খোলা রেখে অর্ধেক বন্ধ রেখে আসলে সরকার কী ফায়দা লাভ করতে চায়?

কোনটি ব্যক্তিগত গাড়ি আর কোনটি ভাড়া করা—নির্ণয় করাও কঠিন। পত্রিকায় খবর এসেছে, সরকার চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ শিথিল করার পর ঢাকায় রেন্ট–এ–কার ও মাইক্রোবাসের ভাড়া কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। এসব গাড়িতে গাদাগাদি করে যাত্রীরা গন্তব্যে যাবে। গণপরিবহন থেকে ঝুঁকির মাত্রা কোনো অংশে কম নয়।

গাড়ি বা মাইক্রোবাস ভাড়া করে যাওয়ার সামর্থ্য যাঁদের নেই, তাঁরা ঝুঁকি নিয়ে ভ্যান গাড়ি, অটোরিকশা, ইজিবাইক, এমনকি পণ্যবাহী ট্রাকে দূরের পথে যাত্রা করেছেন। এ রকম দৃশ্য আমরা আরেকবার দেখেছিলাম এপ্রিলের শুরুতে, যখন তৈরি পোশাকশিল্প খুলে দেওয়া হয়েছিল। হাজার হাজার শ্রমিক পায়ে হেঁটে, রিকশায়, ভ্যানে, অটোতে করে ঢাকায় এসেছেন। এই দরিদ্র মানুষগুলোর প্রতি সামান্য দরদ থাকলে কেউ এভাবে আসতে বলতে পারে না। শ্রমিকেরা অসহায়। তাঁদের কাছে করোনার ভয়ের চেয়েও ক্ষুধা অনেক বেশি ভয়ংকর।
সরকার কি তাহলে গাড়ি–বাড়িওয়ালাদেরই? গরিব মানুষের নয়?

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি।
[email protected]