কেরালা মডেলে দিল্লিরই নজর নেই

প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

ভারতের ১৩০ কোটি মানুষ যখন কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে টিকে থাকার সংগ্রাম করে যাচ্ছে, তখন এর ২৮টি রাজ্যের মধ্যে মাত্র একটি দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্য মহামারির সংক্রমণ মোকাবিলায় এতই সফল যে অনেকেই প্রশংসার সুরে ‘কেরালা মডেলে’র কথা বলছে।

জানুয়ারির শেষের দিকে চীনের উহান থেকে এক ভারতীয় মেডিকেল ছাত্র কেরালায় ফিরলে তাঁর কোভিড-১৯ সংক্রমণ ধরা পড়ে। এ দিক থেকে কেরালাই প্রথম রাজ্য যে প্রথম এই রোগ শনাক্ত করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মার্চের ২৪ তারিখে সারা ভারতে লকডাউন জারি করার সময় কেরালাতেই ছিল সবচেয়ে বেশি কোভিড রোগী। তারপরও এই রাজ্য থেকেই এখন সবচেয়ে কম সংক্রমণের খবর আসছে, সবচেয়ে বেশি সুস্থ হয়ে ওঠার রেকর্ডও এই রাজ্যের। ভারতের মধ্যে কেরালায় এই রোগে মৃত্যুর হার সর্বনিম্ন (শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ)। ভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে যে জনদুর্ভোগ অন্যান্য রাজ্যে দেখা গেছে, কেরালায় তা–ও দেখা যায়নি।

কেরালার সাফল্যের সূত্র অতি সরল। জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ব্যাপক টেস্ট, ট্রেসিং ও ২৮ দিনের কোয়ারেন্টিনের (অন্যান্য রাজ্য ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন মেনেছে) মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থাতেই রোগ নির্ণয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছে। কেরালা কোভিড-১৯ হুঁশিয়ারি জারি করেছে ১৮ জানুয়ারি। রাজ্যের চারটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যারাই এসেছে, তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছে। সন্দেহভাজনদের দ্রুতই হাসপাতালে বা কোয়ারেন্টিনে পাঠিয়েছে। ৪ ফেব্রুয়ারি রাজ্যপর্যায়ের দুর্যোগ ঘোষণা করে স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে, জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং মার্চের গোড়ার দিকেই লকডাউন কায়েম করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার কোনো ব্যবস্থা নিতে নিতেই কেরালা ৩০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীকে মাঠে নামিয়েছে এবং লাখো মানুষকে কোয়ারেন্টিনে রাখার ব্যবস্থা করেছে।

ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে কেরালা সবচেয়ে বেশি সম্পদ জনস্বাস্থ্য অবকাঠামোর পেছনে ব্যয় করেছে। গ্রামপর্যায়ে শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করেছে এবং তাদের দিয়েছে তহবিল। এবং এমন এক সামাজিক ব্যবস্থা তারা গড়ে তুলেছে, যেখানে সামাজিক অংশগ্রহণ ও সহযোগিতার সুযোগ অবারিত।

ভারতে শিক্ষিতের হার কেরালাতেই সবচেয়ে বেশি (৯৪ শতাংশ)। জন্মহার কমানো, আয়ু বাড়ানো ও নারীর অধিকতর ক্ষমতায়নেরও রাজ্যটি পথিকৃৎ। প্রান্তিক জনগণের জন্য রয়েছে জোরদার কল্যাণমূলক কর্মসূচি। কেরালায় কেউ ভিক্ষা করে না বা ক্ষুধার্ত থাকে না। অন্যান্য রাজ্যের মতো কাউকে প্রজার মতো করে দেখা হয় না। বর্তমান সংকটে কেরালার শিক্ষিত জনসাধারণের আচরণ দায়িত্বশীল, তারা কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করছে এবং কর্তৃপক্ষও দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে। ফলে সামাজিক সংক্রমণ অনেক কম হয়েছে।

এমন প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি এক দিনে তৈরি হয়নি। কেরালা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সামাজিক উন্নয়নের অবকাঠামো তৈরি করেছে। ফলে রাজ্যটি অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে অনেক সূচকে অনেক এগিয়ে গেছে। অধিকারভিত্তিক কল্যাণমূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি আছে সক্রিয় নাগরিক সমাজ, মুক্ত ও স্বাধীন গণমাধ্যম এবং প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। জোরদার সামাজিক গণতন্ত্র পালা করে চালিয়েছে কমিউনিস্ট ও কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট। বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা যেমন লক্ষ করেছেন, রাজ্যটির সামাজিক সংহতির প্রতিফলন ঘটে প্রতিষ্ঠান ও জনপ্রতিনিধিদের ওপর উঁচু মাপের আস্থার মাধ্যমে।

ফলে কেরালা মহামারি নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা আরোপ করেছে অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে অনেক মানবিকভাবে। হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা লোকেরা জানানো মাত্রই পুলিশ তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে। স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর যেসব মা-বাবা সন্তানের পুষ্টির জন্য স্কুল থেকে দেওয়া দুপুরের খাবারের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, তাঁরা বাসায়ই সেই খাবার পেয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের লকডাউন ঘোষণার আগেই কেরালা সরকার অভাবী নাগরিকদের জন্য ব্যাপক-বিস্তৃত অর্থনৈতিক সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।

এর মধ্যে লকডাউনের প্রথম মাসেই কুদুমবাশরী নামের এক স্থানীয় পর্যায়ের তৃণমূল সংগঠনের নেটওয়ার্ক ২ মিলিয়ন মাস্ক ও ৫ হাজার লিটার হ্যান্ড স্যানিটাইজার সরকারের হাতে তুলে দিয়ে রাজ্যের করোনা মোকাবিলা কার্যক্রমকে সফল করায় ভূমিকা রেখেছে। খোলা হয়েছে ১ হাজার ২০০ লঙ্গরখানা, কুদুমবাশরী একাই প্রতিদিন ৩ লাখ লোকের আহারের ব্যবস্থা করে।

কেরালা স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে নিয়মিতভাবে জনগণকে ওয়াকিবহাল করে গেছে, সরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে ভুয়া খবর বিষয়ে সজাগ করেছে। অন্যান্য রাজ্যের বিপরীতে কেরালার কাজকর্ম ছিল জনগণের অংশগ্রহণমূলক। তাই কাউকে জোরাজুরি করতে হয়নি। ভিন রাজ্যের অভিবাসী শ্রমিকেরা অস্থির হয়ে উঠলে তাঁদের বিনা মূল্যে খাবার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর এসব করা হয়েছে ওই সব অভিবাসীর নিজেদের ভাষায়। মানুষও সেসব নির্দেশ তখন মেনেছে। আর অন্যান্য রাজ্যে অভিবাসীদের একরকম দূর দূর করে তাড়ানো হয়েছে।

কেরালা ভারতের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এ জন্যই তাদের সাফল্য আরও বেশি দৃষ্টান্তমূলক। তা ছাড়া এই রাজ্যের ১৭ ভাগ মানুষ অন্য অঞ্চলে বাস করে বা কাজ করে। ফি বছর ১০ লাখের বেশি পর্যটক এই রাজ্য ভ্রমণ করে এবং শত শত কেরল ছাত্র চীনসহ বিদেশে অধ্যয়নরত। এসব কারণে কেরালা ব্যাপক সংক্রমণের ঝুঁকিতে বেশিই ছিল, অথচ কী সুন্দর করেই না তারা এসব সামাল দিয়েছে।

এই সাফল্যের কারণ বিকেন্দ্রীভূত সরকারব্যবস্থা, স্বচ্ছতা, জনসেবার মানসিকতা, নাগরিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সরকারের জবাবদিহি। কেরালা শুধু ভারতকেই নয়, অনেককেই আজ পথ দেখাচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কেরালা মডেলের দিকে দিল্লির কোনো নজরই নেই।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত
শশী থারুর: জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল, ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র ও মানবসম্পদমন্ত্রী, কংগ্রেসের একজন এমপি