পাখি হত্যা ও প্রকৃতির প্রতিশোধ

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ঘূর্ণিঝড় আম্পান যখন উপকূলে আঘাত হানতে শুরু করে তখন মানুষের প্রাণ যায় কি না, সম্পদের কত ক্ষতি হয় সেসবের দুর্ভাবনায় দেশবাসী উদ্বিগ্ন ছিল। করোনার মতো দুঃসহ সংক্রমণের কালে এসব হিসাব-নিকাশের মধ্যেই খবরে পড়লাম নাটোরের বড়াইগ্রামের বাজিতপুর গ্রামে ২০০ শামুকখোল পাখি খেয়ে নিয়েছে ওই গ্রামের অধিবাসীরা। কেবল সীমাহীন অজ্ঞতা কিংবা নির্দয় হলে এ কাজ করা সম্ভব। হয়তো দুটোর মিশেলেই এই কাজ করা হয়েছে।

আম্পানের ভয়াবহ বেগের কাছে পাখিগুলো নিজেরা টিকে থাকতে পারেনি। ভোরবেলা পাখিগুলো মাটিতে পড়ে গেছে। অসহায় পাখিগুলোর নিশ্চয়ই প্রাণপণে বাঁচার আকুতি ছিল। মানুষকে কাছে আসতে দেখে তারা আশ্রয় খুঁজেছিল কি না, জানি না। তবে অসহায় মৃত্যুপথযাত্রী ২০০ পাখির সন্ধান পেয়েছে মানুষ, এ কথা শুনলে যে কারও আশ্বস্ত হওয়ার কথা। ভাবার কথা, পাখিগুলো অন্তত এবার বাঁচার পথ পাবে। কিন্তু ভাবতে অবিশ্বাস্য মনে হয়, গ্রামবাসী পাখিগুলোকে নির্বিচার জবাই করে খেয়েছে

শামুকখোল পাখি দেখতে খুব সুন্দর; এখন বিরলও বটে। এ রকম ২০০ পাখি একসঙ্গে আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলে যে কারোরই মায়া হওয়ার কথা। অথচ কেউ সেই মায়ার বশবর্তী না হয়ে পাখিখেকো হওয়ার পৈশাচিক আনন্দ মেতে উঠল? হায় গ্রামবাসী! একজন মানুষ একা এটা করতে পারে না। কেউ কেউ পথ দেখালে তখন হুজুগে মেতে তারা এসব করে।

কল্পনা করুন তো, ২০০ শামুকখোল পাখি একসঙ্গে উড়ে যাচ্ছে দারুণ এক ছন্দ তুলে। আকাশে এই দৃশ্য তো যে কারও মনটাকে আনন্দে ভরিয়ে তুলবে। ওখানকার পাখিপ্রেমীরা খবর পাওয়ার আগেই ঝড়ে পড়ে যাওয়া পাখিগুলোকে জবাই করার কাজ শেষ করেছে গ্রামবাসী।

কয়েক দিন আগে দুটি দৃষ্টিনন্দন মায়াবী ডাহুক নিয়ে এক পাখি বিক্রেতা রংপুর শহরে এসেছিলেন। আমি পাখি দুটো ছাড়তে চাইলে বিক্রেতা পাখি ছাড়তে আপত্তি করেছিলেন। আমি পরে ওই পাখিশিকারিকে নিয়ে রংপুরের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে যাওয়ার পর ওই পাখি বিক্রেতা পাখি দুটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। হয়তো তাঁর জীবিকার কষ্ট হলো, কিন্তু যা করা সবার জন্য ক্ষতি, তা থেকে বিরত থাকাই উচিত।

পাখিদের নিজস্ব ভাষা আছে। তারাও আনন্দে উদ্বেলিত হয়, কষ্টে ছটফট করে। সঙ্গী পাখিরা পরস্পরকে খুব ভালো চেনে। একসঙ্গে ঘর বোনে। সেই বাসায় মেয়ে পাখিটি ডিম দেয়। পাখি দম্পতি মিলে সেই বাচ্চাকে লালনপালন করে। কয়েক দিন আগে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখছিলাম সন্তানকে মুখে নিয়ে একটি শালিক বাসার দিকে উড়ে যাচ্ছে। করোনার ভয়াবহ বাস্তবতায় যখন মাকে ফেলে সন্তানের পালিয়ে যাওয়ার করুণ কাহিনি পড়ছিলাম, মা-বাবার সন্তানকে ফেলে যাওয়ার রূঢ় বাস্তবতার কথা শুনছিলাম, তখন পাখিদের এই ভালোবাসার কাছে আমাদের শেখার আছে।

পাখিদের বিপদে পাখিরা ছুটে আসে। এই গুণটি আমাদের অনেকের মধ্যে অনুপস্থিত। একবার একটি কাকের পা জালে আটকা পড়েছিল, তখন যেন রংপুরের সব কাক এসে জমেছিল সেই কাকের পাশে। যতক্ষণ কাকটি জাল থেকে মুক্ত হয়নি, ততক্ষণ অন্য কাকেরাও যায়নি। তারই উল্টো চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি করোনাকালে অসহায় মানুষের জন্য বরাদ্দ ত্রাণের চাল-ডাল-তেল চুরি করছেন কিছু অসাধু ব্যক্তি। পাখি আর মানুষে বোধ হয় এখানে একটি বড় পার্থক্য। পাখিরা পাখিদের বিপদে বন্ধু আর অনেক মানুষ মানুষের বিপদের সুযোগ নেওয়ার কাজে থাকে।

আমাদের বাসার পাশে একটি কাঁঠালগাছ। গাছটি ছাদের চেয়েও উঁচু। করোনাকালে যেহেতু কোথাও যেতে মানা, তাই ছাদে যাই। ছাদে গেলেই দুটি কাক যেন আমাকে ছোঁ মারতে আসে। আমি বুঝতে পারি না কেন। দুদিন পরই আবিষ্কার করলাম সেখানে একটি কাকের বাসা। সেই বাসায় কাকের দুটি ছানা। সন্তানের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সে জন্য এই আকুতি। পাশেই একটি গাছে টিয়ার বাসা। একটি টিয়া সব সময়ই পাশে বসে যেন বাসা পাহারা দিচ্ছে। শালিক, কাকসহ কোনো পাখি এলেই ছোঁ মারছে। পাখিদের সন্তানের প্রতি পাখিদের ভালোবাসা এমনই তীব্র, গাঢ়, অকৃত্রিম। নাটোরের বাজিতপুর গ্রামের বাসিন্দারা এমন দায়িত্বশীল অসহায় পাখিদের খুন করল!

যখন ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রচণ্ড আঘাতে দেশের এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অনেক এলাকাই লন্ডভন্ড, তখন আমি ভাবছিলাম পাখিরা এই ঝড়ে কেমন আছে? আমাদের বাসার পাশেই একটি পাকুড়গাছে অন্তত ১০ হাজার চড়ুই থাকে। বলতে গেলে প্রতিটি পাতার আড়ালেই একটি করে পাখি রাত যাপন করে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে সেখানে অসংখ্য কাক, বুলবুলি, ফিঙে, শালিক, প্যাঁচা, কসাই, ঘুঘু বাসা বানিয়েছে। আমি ওই সব পাখির দুঃসহ রাত যাপনের কথা ভাবছিলাম। কারণ ঘূর্ণিঝড়ে মানুষের কষ্টটাও যে মনে পড়ে। ঝড়ের তাণ্ডবে তাদের বাসা কি টিকবে? প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করেই টিকে থাকতে হয় পাখিদের। তার ওপর আছে আরও কত পশুপাখির অত্যাচার। কিন্তু এই প্রতিকূলতার মধ্যে মানুষ পাখিদের সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হবে, এটা তো আশা করা যায় না।

বাঙালিদের বিভিন্ন রকম 'খেকো' উপাধি আছে। তারা বনখেকো, নদীখেকো, ত্রাণখেকো, সর্বোপরি নীতিখেকো। অমানুষের মতো তারা এগুলো সাবাড় করছে। বিলুপ্তপ্রায় পাখি শিকারে নিষেধ আছে। তার পরও মানুষ এ কাজ করেই চলেছে। নাটোরের ওই গ্রামে ২০০ পাখি জবাই করে খাওয়ার ঘটনা অনেককেই ভীষণভাবে অহত করেছে। পাখিরা মানুষের ভাষা না বুঝুক, মানুষ তো পাখির যন্ত্রণা কিংবা পাখির প্রতি অবিচার বুঝতে পারে। সুতরাং মানুষ যে মানুষ, সব মানুষ যে অমানুষ নয়, এটি প্রমাণ করার জন্য হলেও পাখিখেকোদের শাস্তি হওয়া চাই। বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী পাখিখেকোদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব। পাখিদের মিছিল-সমাবেশ-ধর্মঘট-হরতাল হবে না বলে কি তারা ন্যায়বিচার পাবে না? প্রকৃতির প্রতিশোধ কত ভয়াবহ হতে পারে, সেটি বুঝতে এখনো বাকি আছে?

শেষ খবর হলো, পুলিশ গ্রামবাসীর কাছ থেকে এই মর্মে মুচলেকা নিয়েছে, তারা আর কখনো পাখি শিকার করে খাবে না। অন্যরাও যাতে কথাটা মনে রাখেন।

তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এবং পরিচালক, রিভারাইন পিপল