আম্পানকবলিত মানুষের বিপন্নতা

প্রবল জলোচ্ছ্বাসে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের ঘরবাড়ি, হাটবাজার, ফসলের খেত, মাছের ঘের ইত্যাদি প্লাবিত করে চলে গেছে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আম্পান। তারপর প্রায় ১০ দিন পেরোতে চলল, তবু বিপলুসংখ্যক মানুষের দুর্ভোগ ও দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটেনি।

ঘূর্ণিঝড় আসার আগে সরকারি হিসাব অনুযায়ী প্রায় ২৪ লাখ মানুষকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নেওয়া হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ের পর তাদের অধিকাংশই নিজ নিজ ঘরবাড়িতে ফিরে গেছে। কিন্তু যেতে পারেনি, এমন মানুষের সংখ্যা এখনো অনেক। এই মানুষেরা ঘরে ফিরতে পারেনি; কারণ, তাদের ঘরগুলো থেকে এখনো পানি সরে যায়নি, সেগুলো বসবাসের উপযোগী হয়নি। অনেক মানুষের ঘর মাটির তৈরি, সেগুলো পানিতে জলমগ্ন থাকতে থাকতে ধসে যাচ্ছে।

আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে থেকে যাওয়া এসব মানুষ কীভাবে দিনাতিপাত করছেন, তার সামান্য আভাস মেলে শুক্রবার প্রথম আলোর শেষ পাতায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে। প্রতিবেদনে আট সদস্যের একটি পরিবারের কথা বলা হয়েছে, যাঁরা বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা আশ্রয়কেন্দ্রে আসার পর উপজেলা চেয়ারম্যান মাত্র একবার খিচুড়ি খাইয়েছিলেন। তাঁরা সরকারি কোনো ত্রাণ পাননি, এখন তাঁদের দিন চলছে অনেকটাই ‘চেয়ে–চিন্তে’। অবশ্য বাগেরহাট, ভোলা, পটুয়াখালী, খুলনা, সাতক্ষীরা, বরগুনা ও পিরোজপুরের দুর্যোগকবলিত এলাকাগুলোতে প্রথম আলো ট্রাস্টের ত্রাণ তহবিল থেকে প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্যরা চাল–ডাল, তেল–সাবান ইত্যাদি বিতরণ করেছেন। কিন্তু খাবারের সংকটে পতিত মানুষের সংখ্যার তুলনায় এসব ত্রাণ–সাহায্য নিতান্তই অপ্রতুল।

এসব দুর্গত মানুষের জীবন আরও দুর্ভোগময় হয়ে উঠেছে ঘূর্ণিঝড়–পরবর্তী বৈরী আবহাওয়ার কারণেও। গত বৃহস্পতিবার বরিশাল অঞ্চলে ১০৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে; নদ–নদীগুলোতে জোয়ারকালীন পানির উচ্চতা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৪ ফুট পর্যন্ত বেশি হচ্ছে। ফলে চরাঞ্চল ও নিচু এলাকাগুলোর জলমগ্নতা কাটছে না। বরিশাল বিভাগীয় প্রশাসনের ভাষ্য অনুযায়ী, আম্পানে ওই বিভাগের ছয় জেলায় প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলায় ৭০টি গ্রামের ১৫ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়েছে, আর লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দী জীবন যাপন করছে।

ঘূর্ণিঝড়–জলোচ্ছ্বাসের পর এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে উপকূলের বিপুলসংখ্যক মানুষের ঘরে ফিরতে না পারা, এবং যারা ঘরে ফিরেছে, তাদের দিনে দুবার জোয়ারের পানিতে ভাসার কারণ হলো, ওই সব অঞ্চলের অনেক বাঁধ ভেঙে গেছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে যখন জোয়ার আসে, তখন বাঁধের ভাঙা অংশগুলো দিয়ে পানি ঢুকে গ্রাম–জনপদ প্লাবিত করছে। ফলে সেসব জনপদের অনেক মানুষকে এখনো উচঁু রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে; এবং সেখানে তাদের খাদ্যসংকট শোচনীয় দুর্দশার কারণ হচ্ছে।

বিপুলসংখ্যক মানুষের এই দুর্দশার বিপরীতে সরকারি ত্রাণ–সহযোগিতা ও অবকাঠামো পুনরুদ্ধারের তৎপরতা নগণ্য। সমগ্র সরকারি প্রশাসন করোনা মহামারি মোকাবিলায় ব্যস্ত রয়েছে। কিন্তু সে জন্য এতসংখ্যক মানুষের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখা চলে না। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে ভেঙে যাওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলোর মেরামতের কাজ ঘূর্ণিঝড়ের পরের এক সপ্তাহেও শুরু করা হয়নি। অবিলম্বে তা শুরু করা উচিত; মানুষ ঘরে ফিরতে পারলে নানা পন্থায় খাবার জোগাড়ের চেষ্টা করতে পারবে। সরকারি তরফেও ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর জন্য পর্যাপ্ত খাবার ও অন্যান্য ত্রাণসামগ্রীর ব্যবস্থা করতে হবে।