সংক্রামক রোগ প্রান্তিক মানুষ চেনে

আমরা রোগের সংক্রমণের জন্য জীবাণুকে দায়ী করি। এ কারণে বর্তমানে মহামারিতে আমাদের কাছে সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কোভিড-১৯ ভাইরাস এবং আমাদের সার্বিক চেষ্টা হচ্ছে এই ভাইরাস থেকে নিরাপদে থাকা। এই মহামারি অনেকের কাছে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো এবং তাঁরা ভাবতে পারেন রোগটি যেকোনো মানুষকেই বিপদগ্রস্ত করতে পারে। আর এ কারণে তাঁদের মনে হতে পারে এই সংক্রমণের কোনো শ্রেণিভেদ নেই। যেকোনো মানুষ এ থেকে সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

বিশ্বব্যাপী এই রোগের তাণ্ডব, বিশেষত ধনী দেশ হিসেবে যে দেশগুলোকে আমরা জানি কিংবা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধনী বলতে যাদের আমরা দেখে অভ্যস্ত, তারাও যখন এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে; তখন আমাদের মনে হতে পারে, এই রোগ সংক্রমণের ক্ষেত্রে কোনো ভেদাভেদ নেই। যেকোনো শ্রেণি কিংবা পেশার মানুষ এতে সংক্রমিত হতে পারে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী সংক্রামক রোগের উপাত্ত দেখলে দেখা যায় সংক্রমণ ভীষণভাবে শ্রেণিকেন্দ্রিক। একটি সমাজে যদি অসমতা থাকে, মানুষের মধ্যেকার সক্ষমতার যদি অনেক পার্থক্য থাকে, তাহলে একটা বিশেষ জনগোষ্ঠী সংক্রামক রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। এই বিশেষ জনগোষ্ঠী হচ্ছে তারা, যারা অর্থনৈতিকভাবে শোষিত কিংবা সমাজের অন্য প্রান্তিক মানুষজন। আর তাই রোগের সংক্রমণ বুঝতে গেলে কেবল জীবাণুর সংক্রমণের আলোকে দেখলে সার্বিক পরিস্থিতিটা বোঝা সম্ভব নয়।

সংক্রামক রোগের যে উপাত্ত রয়েছে তাতে দেখা যায়, অর্থনৈতিকভাবে যারা খুব নিপীড়িত, মূলধারার সমাজের সঙ্গে যাদের জীবনযাপনের পার্থক্য থাকে, আদিবাসী এবং ধর্মীয়ভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সংক্রামক রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই এই নিপীড়িত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করতে পারে না। অর্থনৈতিক অক্ষমতা কিংবা মূলধারার সমাজের নিপীড়নের কারণে তাদের স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের সুযোগ খুব কম থাকে। ঢাকায় নিম্ন আয়ের মানুষজনের যে আবাসন, তারা যে খাবার খেতে পারে কিংবা যে পানি তারা পান করে, সেই বিষয়গুলোর সঙ্গে সামাজিক অসমতার সম্পর্ক রয়েছে। আমরা নানাভাবে তাদের বঞ্চিত করি, যার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে মজুরিতে বঞ্চনা। এর ফলে তারা যে ঠিকমতো খেতে পারে না বা ভালো একটা জায়গায় ঘুমাতে পারে না শুধু তা-ই না, সংক্রামক রোগেও তারা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। ঢাকার রিকশাচালক, পোশাকশ্রমিক, নির্মাণশ্রমিকদের মধ্যে যক্ষ্মার হার বেশি। যক্ষ্মার সংক্রমণের জন্য প্রধানত তাদের আবাসন এবং খাদ্যতালিকাকে আমরা দায়ী করতে পারি। অর্থনৈতিকভাবে তাদের বঞ্চিত করা কেবল অর্থনৈতিক থাকে না, এটা রোগের সংক্রমণকেও প্রভাবিত করে।

অর্থনৈতিক বঞ্চনার বাইরেও আমাদের সমাজের লিঙ্গভিত্তিক, ধর্মকেন্দ্রিক, জাতিগত, মতাদর্শকেন্দ্রিক সামাজিক অসমতাগুলো ক্রিয়াশীল থাকে। ফলে বিদ্যমান এই অসম সম্পর্কের কারণে যারা বঞ্চনার শিকার হয়, তারা যে কেবল সামাজিকভাবে বঞ্চিত, তা নয়। তারা অনেক বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতেও থাকে। সংক্রামক রোগেও বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। এইচআইভি-এইডস রোগের সংক্রমণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সামাজিকভাবে অবহেলিত ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠী মধ্যে এর সংক্রমণের হার বেশি।

কোভিড-১৯-এর সংক্রমণের ক্ষেত্রেও একটি শ্রেণিভিত্তিক চরিত্র লক্ষ করা যাবে। এই রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে যে ধরনের নিয়মের কথা বলা হচ্ছে, তাতে একটা বিশেষ শ্রেণির মানুষের পক্ষে সেই নিয়মগুলো মেনে চলা সম্ভব হবে। এ কারণে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণের শ্রেণি সম্পর্ককেন্দ্রিক উপাত্ত পেতে আমাদের কিছুটা সময় লাগলেও আমরা দেখছি, এই রোগটি সমাজের অসমতাকে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। আমরা দেখছি বিশেষ শ্রেণির মানুষের জীবিকা এই রোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যারা সংক্রমিত না হয়েও মারাত্মকভাবে বিপদগ্রস্ত। এই সংক্রমণের কারণে আমাদের সামনে প্রমাণিত হলো যে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ভীষণ অসমতা রয়েছে। এই অসমতা শহর ও গ্রামে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে ধনী ও গরিবের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে। যদিও বর্তমান সংকটে অনেকে মনে করতে পারেন, অনেক সামর্থ্যবান মানুষও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত। কিন্তু সেই সংকটগুলো সেই সামর্থ্যবানদের জন্য সাময়িক ও ব্যতিক্রমী।

কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ একসময় সম্ভব হবে। কিন্তু অন্য ভয়ংকর সংক্রামক রোগের মতো এই রোগটিও বিশেষ কিছু মানুষের মধ্যে থেকে যাবে। যারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার, তারা এই রোগে সংক্রমিত হতে থাকবে। যেভাবে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এত দিন ধরে চললেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক বঞ্চনার কারণে ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষ যক্ষ্মায় ভোগেন; ঠিক একইভাবে কোভিড-১৯-এর চিকিৎসা কিংবা প্রতিষেধক তৈরি হলেও পৃথিবীতে নিম্ন আয়ের মানুষ কিংবা সামাজিকভাবে বঞ্চিত মানুষেরা এই রোগে ভুগতেই থাকবেন।

সমাজের বিদ্যমান অসমতার সম্পর্কগুলোকে দূর করার চেষ্টা না করে রোগের সংক্রমণ ঠেকানোর পদ্ধতিগুলো এখন পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। মানুষের স্বাস্থ্য ভীষণভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। জীবাণু নয়, যেখান সামাজিক অসমতা থাকে, সংক্রমণ সেখানে ভর করবে। অসমতার সঙ্গে সংক্রামক রোগের রয়েছে ভীষণ এক মিতালি।

মুজীবুল আনাম: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। রিসার্চ ফেলো, ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন।