চিকিৎসা ও টিকা নিখরচে সবার চাই

রয়টার্স প্রতীকী ছবি
রয়টার্স প্রতীকী ছবি

মহামারি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় মন্ত্র হিসেবে উচ্চারিত হচ্ছে যে কথাটি, তা হলো—সবাই নিরাপদ না হলে, কেউই নিরাপদ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই মন্ত্র প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তাঁর ভক্তকুল ছাড়া বাকি বিশ্বের প্রায় সবাই গ্রহণ করে নিয়েছেন। ব্যক্তিগত দায়িত্বের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ঠিকই; কিন্তু কেউ যদি তা এড়াতে চায়, কারও যদি সামর্থ্য না থাকে, কেউ যদি ভয়ে মিইয়ে যায় এবং মহামারির সংক্রামক রোগের ছোঁয়া থেকে মুক্ত না হয়, তাহলে কী হবে? ঝুঁকির খড়্গ সবার ওপরেই ঝুলে থাকবে।

এই সংক্রমণ বন্ধের সব চেষ্টা তাই সব দেশেই সর্বজনীন হওয়ার কথা। স্বাস্থ্যসেবাকে সংবিধানে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হলেও গত ৫০ বছরে রাষ্ট্র তা উপেক্ষা করে এসেছে, বাজারের হাতে ছেড়ে দিয়ে পার পেয়েছে। মহামারির মতো কোনো সর্বনাশা জনস্বাস্থ্যসংকট মোকাবিলা করতে হয়নি। এখন মহামারি মোকাবিলাকে বাজারব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেওয়ার মতো পথ বেছে নেওয়ার মুখে সেটি কতটা আত্মঘাতী হতে পারে, তা ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শীর্ষে থাকা দেশগুলোতেও যেখানে বেসরকারি হাসপাতালগুলো সরকার সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে কোভিড–১৯ মোকাবিলায় যুক্ত করেছে, সে রকম ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি বাংলাদেশে শুরু থেকেই করা হয়েছে। কিন্তু তা করা হয়নি। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে বাধ্য করার নির্দেশনা জারি করতে পার হয়েছে তিন মাস। ইতিমধ্যে মন্ত্রীদের কেউ কেউ বলেছেন, বেসরকারি হাসপাতালের কোনো কোনোটি নাকি অস্বাভাবিক ভাড়া দাবি করেছে। অস্বাভাবিক ভাড়া দাবি করলেই কি সরকারের আর কিছু করার থাকে না? যে হাসপাতাল সরকার সাময়িকভাবে অধিগ্রহণ করবে, তার গত এক বছরের মাসিক আয়-ব্যয়ের হিসাব (আয়করের নথি অনুযায়ী) দেখে তার ভিত্তিতেই তো সরকার মালিকপক্ষের সাময়িক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে পারে। এর জন্য তো কোনো মূল্য নির্ধারণ কমিশন গঠনের প্রয়োজন হয় না।

দেশের বিত্তবান এবং ক্ষমতাধরদের অনেকে সর্বসাধারণের জন্য নির্ধারিত স্বাস্থ্যসেবা পছন্দ না–ও করতে পারেন এবং সে জন্য তাঁরা আয়েশি ও ব্যয়বহুল ব্যবস্থার সন্ধান করতে পারেন। সরকার সেই পথ খোলা রাখলে খুব জোরালো কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের সম্ভাবনা আপাতত নেই। যে কারণে, বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড–১৯ টেস্টের জন্য সরকারিভাবে ৩৫০০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও তারা (কথিত সার্ভিস চার্জ যুক্ত করে) ৪৫০০ টাকা করে আদায় করছে। কিন্তু এখন বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কোভিড–১৯ এর চিকিৎসাসেবা সম্প্রসারণে নেওয়া উদ্যোগের ব্যয়ের বোঝা সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা কী (খরচ বহন করতে হবে রোগীকেই, সমকাল, ৩০ মে ২০২০)?

করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর যে আর ধারণক্ষমতা নেই, সেটি মেনে নিয়েই সরকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সামর্থ্য ও সম্পদকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু উদ্দেশ্য যথার্থ হলেও কৌশলটি মোটেও ঠিক নয়। এমনকি সরকার যদি চিকিৎসার খরচ নির্ধারণ করেও দেয়, তাহলেও নয়। মহামারি মোকাবিলায় সবার জন্য চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার সর্বজনীন ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। সামর্থ্যহীনতার কারণে ইতিমধ্যেই বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর শিকার হয়েছেন এমন নজির রয়েছে।

হাসপাতাল-ভীতি আমাদের উপমহাদেশের একটি অত্যন্ত পুরোনো সমস্যা। অতীতে মুরব্বিজনেরা ছোটদের জন্য দোয়া করার সময় তাদের যেন কখনো হাসপাতালে যেতে না হয়, সেই কামনার কথা বলতেন। সরকারি হাসপাতালগুলোর এবং ক্ষেত্রবিশেষে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সেবার মান ও দৈন্য মানুষের এই ভয় তো কাটাতে পারেইনি, বরং বাড়িয়েছে। করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে সাধারণ রোগের চিকিৎসার জন্য রোগীদের যে হয়রানি আর দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, তাতে হাসপাতাল এড়াতে এই রোগীদের কেউ কেউ যে রোগ গোপন করবেন না, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।

বেশির ভাগ রোগী এমনিতেই ভালো হয়ে যান বলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই, এমন ভাবনা যতটা বিভ্রান্তিকর, তার চেয়ে বহুগুণে বেশি বিপজ্জনক। এমন বাস্তবতায় বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ রোগীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ভাবনা অবিলম্বে পরিত্যাগ করা উচিত। সামর্থ্যবান ও সম্পদশালীদের অনেকেই ইতিমধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা পেয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও যে পাবেন, তা মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়। হাসপাতালে শয্যাসংকট দেখা দিলে যাঁরা রাজনৈতিক-প্রশাসনিক প্রভাব খাটাতে সক্ষম, তাঁরা সেই সুবিধা আদায় করতে পারবেন। তাহলে বৈষম্যের শিকার হবেন কেবল তাঁরাই, যাঁরা সব সময়েই পিছিয়ে থাকেন—সমাজের দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

সবাই নিরাপদ না হলে কেউই নিরাপদ নয়—এটি শুধু কোনো একটি দেশের বিষয় নয়, বৈশ্বিকও। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোনো বলিষ্ঠ বৈশ্বিক নেতৃত্ব না থাকায় মহামারি মোকাবিলায় সেগুলোর মধ্যে তেমন একটা কার্যকর সমন্বয় নেই। উপরন্তু নজিরবিহীন এই সংকটকালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধের জেরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছেন। এই পটভূমিতে করোনার টিকা বা ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে যে দেশ এবং প্রতিষ্ঠানই সফল হোক না কেন, তাকে জনগণের টিকায় রূপান্তরের সম্ভাবনা গুরুতর অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে হতে পারে।

কোভিড–১৯ এর টিকা যাতে সবার জন্য বিনা মূল্যে পাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়, সে জন্য বেশ কিছু বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক তৎপরতা চলছে। এ রকম এক উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১৪০ জন নেতা ও বিশিষ্টজন এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, কোভিড–১৯ চিকিৎসায় উদ্ভাবিত যেকোনো টিকা হতে হবে জনগণের টিকা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালনা পরিষদ ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলির সাম্প্রতিক অধিবেশনের প্রাক্কালে এক চিঠিতে এসব নেতা বলেন, টিকা হতে হবে পেটেন্ট বা মেধাস্বত্ব মুক্ত, তা দ্রুত উৎপাদন করতে হবে এবং বিনা মূল্যে বিতরণ করতে হবে। টিকা পাওয়ার সারিতে কে কোথাকার বাসিন্দা বা কত আয় করেন, সেই বিবেচনায় কাউকেই পেছনে ঠেলে দেওয়া যাবে না।

ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলির সভায় হুবহু এ রকম কোনো প্রস্তাব গৃহীত না হলেও কাছাকাছি ধরনের একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে, যাতে এই ভাইরাস মোকাবিলায় সব অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যপ্রযুক্তি ও পণ্য সবাই ন্যায্যতার ভিত্তিতে পেতে পারে। তবে টিকার কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তার পরীক্ষা–নিরীক্ষা শেষ না হলেও সম্ভাবনার দিক থেকে এগিয়ে থাকা উদ্ভাবনগুলো পাওয়ার জন্য দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতিযোগিতা বেশ ভালোভাবেই শুরু হয়েছে। সম্ভাব্য একটি টিকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের মধ্যে অগ্রাধিকার প্রশ্নে টানাপোড়েনের সাময়িক নিষ্পত্তি হলেও অন্যগুলোর ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। অক্সফোর্ডের উদ্ভাবিত টিকা সফল হলে তার তিন কোটি ডোজ সবার আগে যুক্তরাজ্য কিনে ফেলেছে। ওই প্রকল্পে ভারত এবং আরও কয়েকটি দেশ যুক্ত থাকায় তারাও প্রায় কাছাকাছি সময়ে কিছু টিকা পেতে পারে। কিন্তু টিকা কূটনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়, তা এখনো স্পষ্ট নয়। চীন তার তৈরি টিকার ব্যাপারে যতটা আশাবাদী, বাংলাদেশ হয়তো তাতে কিছুটা আশান্বিত হতে পারে।

গেল সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধীনে একটি অভিন্ন উদ্যোগ আনুষ্ঠানিকভাবে সূচিত হয়েছে। শুধু ধনী দেশগুলো তাদের ক্রয়ক্ষমতার কারণে রোগ শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসার সরঞ্জাম, ওষুধ–পথ্য ও টিকা নিয়ে যাবে, আর অন্যরা পেছনে পড়ে থাকবে—তা যাতে না হয়, সে জন্য বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত বিনিময় এবং উদ্ভাবকদের মেধাস্বত্বের খরচ জোগানোই হচ্ছে এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য। সম্ভাব্য টিকা এবং চিকিৎসা প্রযুক্তির সক্ষমতা অর্জনের এই সুযোগ নিশ্চয়ই হাতছাড়া হবে না, সেটুকু কি আমরা আশা করতে পারি?

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক