করোনাকালে চাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর নিজস্ব উদ্যোগ

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

লকডাউন শুরু হওয়ার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকার কারণে আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে—এটি ভেবে অভিভাবক, নীতিনির্ধারকসহ আমরা সবাই চিন্তিত। এই ক্ষতি পোষানোর নানা চেষ্টা ও উদ্যোগ চলছে বিভিন্ন মহলে। এই পরিস্থিতিতে একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে ভাবার চেষ্টা করছি।

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এক জায়গায় বলেছিলেন, ষাটের দশকে তিনি ও তাঁর আড্ডার বন্ধুদের ক্লাসের পড়াশোনা করা হতো কম, তবে ফিজিকস ও ফিলোসফি, সাহিত্য ও চিত্রকলাসহ নানা বিষয় তাঁরা প্রবল আগ্রহ নিয়ে পড়তেন। পড়াশোনায় তাঁদের আগ্রহ ছিল যেমন গভীর, একে অন্যকে অ্যাপ্রিশিয়েট করার শক্তিও ছিল তেমনি প্রখর। তাঁদের উপন্যাসের চরিত্রের মতো তাঁরাও জীবনকে কোনো থিওরি থেকে দেখতেন না বরং দেখতেন অন্তর থেকে, যে দেখায় হঠকারিতা থাকত না, থাকত শতভাগ সততা।

আমরা বিজ্ঞান পড়ছি এবং পড়াচ্ছি, কিন্তু বিজ্ঞানের দর্শনকে সব সময় উপেক্ষা করছি। আমাদের যেসব তরুণ মৌলিক বিজ্ঞান কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন, তাঁদের খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ দর্শন, ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, নৃবিজ্ঞান কিংবা ইতিহাস পড়ছেন কিংবা পড়ার তাগিদ অনুভব করছেন। আবার যাঁরা সাহিত্য কিংবা সমাজবিজ্ঞান পড়েন, তাঁরা মৌলিক কিংবা ব্যবহারিক বিজ্ঞানে খুব অল্পই আগ্রহ অনুভব করেন। পাঠ্যপুস্তকের পড়ার বাইরে জ্ঞানের যে বিশাল ভান্ডার রয়েছে, তা অনেক তরুণের কাছেই অপরিচিত, অল্প জেনেই তাঁদের অনেকেই তৃপ্ত।

লকডাউন চালু করার কিছুদিন পর যখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস আরম্ভের চেষ্টা শুরু করল, তখন শিক্ষার্থীদের তরফে সবখানে পর্যাপ্ত নেটওয়ার্ক সুবিধার অভাব এবং সবার অনলাইন ক্লাসের টেকনিক্যাল ব্যয়ভার বহনের সামর্থ্য না থাকার বিষয়গুলো যৌক্তিকভাবেই উঠে এসেছে। তবে একই সঙ্গে দুঃখজনকভাবে বারবার শুনতে হয়েছে পরীক্ষা কীভাবে হবে, গ্রেডিং কীভাবে হবে? হ্যাঁ, আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার কথা চিন্তা করলে গ্রেড নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে একজন শিক্ষার্থী চিন্তিত হতেই পারেন। তবে সব সময় ভালো ফলাফল লাভই যদি পড়াশোনার মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে জাতির ভাগ্যে অনেক ভোগান্তি রয়েছে, এটি নির্দ্বিধায় বলা যায়। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে, আগামী দিনগুলোতে হয়তো বোঝা যাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে কার্যকরভাবে কী করে নির্দিষ্ট ডিগ্রির জন্য অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করা সম্ভব। তবে এই সংকটের সময়ে অনেক শিক্ষার্থীর অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের প্রাযুক্তিক সুযোগ না থাকায় শিক্ষক হিসেবে আমাদের বিকল্প কিছু চিন্তাভাবনা না করে হাত–পা গুটিয়ে বসে থাকা সমীচীন নয়।

আমাদের ছাত্রদের বোঝানো প্রয়োজন। বনিয়াদি, ফরমায়েশি, কাঠামোগত, গতানুগতিক পড়াশোনা তো কয়েক যুগ থেকে করছি। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও তা পুরোদমে করতে পারব, কিন্তু গতানুগতিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরেও তো কত কিছু শেখার বাকি, জানার বাকি রয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান, প্রকৌশল, স্থাপত্যসহ অনেক অনুষদের কারিকুলামে নতুন নতুন কোর্স অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সংকুচিত হচ্ছে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানোর জন্য জরুরি মানবিক বিদ্যা ও সামাজিক বিজ্ঞানের কোর্সগুলো। দীর্ঘ মেয়াদে এটি খুবই উদ্বেগের একটি বিষয় এবং এর নেতিবাচক পরিণাম আমাদের কাছে ইতিমধ্যে দৃশ্যমান। অথচ উন্নত বেশ কিছু দেশে যেকোনো অনুষদের পাঠ্যক্রমে মানবিক বিদ্যার বিষয়গুলোকে দিন দিন গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।

বৈশ্বিক এই দুর্যোগে স্কুল–কলেজের অল্প বয়সী বাচ্চাদের মনোজগৎ স্বাভাবিক রাখতে আমাদের করণীয় কী—তা নিয়ে গভীর ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। তবে এই দুর্দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অন্তত সঠিক পরামর্শ দিয়ে, পথ বাতলে দিয়ে সহজেই তাঁদের জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া সম্ভব। ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক ড. শাহদীন মালিক একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরও বুঝতে হবে যে তাঁদের জ্ঞান অর্জনের শতকরা ৮০ শতাংশ নির্ভর করে নিজের চেষ্টার ওপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাঁদের শুধু পথ বাতলে দেবেন।’

পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না হলে অনলাইনে চিরাচরিত শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলে সেখানে শুধু তাত্ত্বিক বিষয়গুলো পড়ানো সম্ভব হবে। ব্যবহারিক বিষয়ে ক্লাস নেওয়া প্রায় অসম্ভব হওয়ায় ছাত্রদের হাতে থাকবে নানা বিষয় পড়ার-জানার অফুরন্ত সময়। প্রয়োজনীয় এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যেগুলো কোর্স কারিকুলামে নেই বা থাকলেও বিভিন্ন কারণে শ্রেণিকক্ষের পড়াশোনা থেকে শিক্ষার্থীরা তা সঠিকভাবে আত্মস্থ করতে পারেন না। লকডাউনের এই সময়ে এই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা চালানো যেতে পারে। এই সংকটের মুহূর্তে বিষয়ভিত্তিক বই কিংবা আনুষঙ্গিক প্রবন্ধ ছাড়াও ছাত্রের চিন্তার দরজা উন্মুক্ত ও অন্তর্দৃষ্টি প্রখর করতে পারে এবং তাঁর সামগ্রিক দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে, এমন মানসম্মত রেফারেন্স বই, বইয়ের নির্দিষ্ট চ্যাপ্টার বা কোন লেখকের কোন প্রবন্ধ প্রাসঙ্গিক—এই বিষয়গুলো আমরা শিক্ষার্থীদের নজরে আনতে পারি। আমি নিশ্চিত, এটা করা গেলে বাকিটুকু ছাত্ররা নিজ দায়িত্বে পড়ে নেবেন। শিক্ষকেরা ছাত্রদের সঠিক পথ বাতলে দিলে শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন অনেক কিছু শিখবেন, অন্যদিকে মানসিকভাবে উৎফুল্ল থাকবেন।

আমাদের উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণায় অনেক সমস্যা বিদ্যমান রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ পদার্থবিজ্ঞান, বিশেষ করে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান, প্রকৌশল বিষয়সহ আরও কিছু বিষয়ের ছাত্রদের জন্য গণিতে বিশেষ দক্ষতা খুবই প্রয়োজনীয়। যেকোনো গবেষণায় সঠিক স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যানালাইসিসও খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে মনে করেন জীববিজ্ঞান গবেষণায় গণিতের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই, কিন্তু আধুনিক জীববিজ্ঞানে একটি জীবের অন্তর্নিহিত সব কার্যপ্রণালি ঠিকমতো বুঝতে দরকার বায়োইনফরমেটিকস, যার পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে জীববিজ্ঞানের দক্ষতার পাশাপাশি গণিত, পরিসংখ্যান এবং কম্পিউটার কোডিংয়ের দক্ষতার ওপর। মেন্ডেলিয়ান জেনেটিকস থেকে আজকের দিনের জিনোম সিকোয়েন্স অ্যানালাইসিস—সবকিছুতেই লাগে গণিতের ছোঁয়া। উন্নত মানের গবেষণায় আমাদের পিছিয়ে থাকার একটি বড় কারণ গণিতে দুর্বলতা, স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যানালাইসিসে অনীহা, উদাসীনতা।

আমাদের দেশের অনেক তরুণ গবেষক কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করে তা প্রবন্ধ আকারে প্রকাশ করেন। বিভিন্ন কনফারেন্সে গবেষণা ফলাফল উপস্থাপনের সময় যখন তাঁদের প্রশ্ন করা হয় নির্দিষ্ট ওই সিমুলেশনের কোডে কোন মেথড ব্যবহার করা হয়েছে, তখন অনেকেই এর সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারেন না। শুধু বলেন, ‘ওই বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করেছি।’ সফটওয়্যার প্যাকেজকে তাঁরা অনেকটাই ব্ল্যাক-বক্স হিসেবে ব্যবহার করেন এবং এর অন্তর্নিহিত বিষয়গুলো জানার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। ফলে ওই কোড ব্যবহার করে যে গবেষণা করেন, তার সীমাবদ্ধতা কতটুকু—এ বিষয়ে তাঁদের সম্যক ধারণা থাকে না।

করোনা মহামারি পরিষ্কার করে আমাদের অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ মানবিক গবেষক তৈরির এবং সঠিকভাবে গবেষণা করার প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন সভা, সেমিনার এবং কনফারেন্সে আমরা গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করি। প্রসঙ্গক্রমে গবেষণা পদ্ধতি নিয়েও অল্পবিস্তর আলোচনা করি। তবে গবেষণা সম্পাদন এবং প্রকাশনার সঙ্গে আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় নৈতিকতা বিষয়ে কোনো আলোচনা হয় না বললেই চলে। স্নাতক ডিগ্রি শেষ করেই আমাদের অনেক ছাত্র সরাসরি চাকরি ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, অথচ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পেশাগত নৈতিকতা বিষয়েও ছাত্রদের উল্লেখ করার মতো কিছু পড়ানো হয় না।

ওপরে উল্লিখিত এবং এতদসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রদের জ্ঞান এবং দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি, ন্যাশনাল ইয়াং একাডেমি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কেমিক্যাল সোসাইটি, বাংলাদেশ ফিজিক্যাল সোসাইটি, বাংলাদেশ সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজিস্ট, বাংলাদেশ গণিত সমিতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, বাংলাদেশ দর্শন সমিতি, ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ, ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশসহ বিভিন্ন অরগানাইজেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বছরে একটি কনফারেন্স আয়োজন করাই যেন তাঁদের একমাত্র দায়িত্ব না হয়। এই সংকটের মুহূর্তে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অভিজ্ঞ অধ্যাপক ও গবেষককে আমন্ত্রণ ও অনুরোধ করে এই সংগঠনগুলো বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নিয়মিত ওয়েবিনার (ওয়েবভিত্তিক সেমিনার) আয়োজন করতে পারে। ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলো জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এই মুহূর্তে চার্জ ন্যূনতম রাখতে পারে। একটি বিষয় পরিষ্কার করে উল্লেখ করতে চাই, এই ওয়েবভিত্তিক সেমিনারগুলোতে গতানুগতিক বিষয় আলোচনা না করে বরং কোনো একটি নির্দিষ্ট সমস্যা চিহ্নিত করে তার সমাধানের পথ শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করলে বেশি ফলপ্রসূ হবে।

করোনাভাইরাস কিছুটা হলেও তো আমাদের অস্তিত্বের সংকট হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। এ ধরনের সংকট ভবিষ্যতে আরও আসতে পারে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনের সংকট মোকাবিলা করার জন্য নিজের পরিণতিকে প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা যেমন থাকতে হবে, ঠিক তেমনই থাকতে হবে সমগ্র মানবজাতির পরিণতিকে নিজের মানসপটে প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা। মানবিক মনোজগতের গভীরে অন্তর্দৃষ্টি পৌঁছাতে হলে, সংকট সুষ্ঠুভাবে মোকাবিলা করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে গতানুগতিক পড়াশোনার বাইরে বিচিত্র বিষয়ে পড়াশোনা-জানাশোনার কোনো বিকল্প নেই।

মোহাম্মদ আব্দুল বাছিত: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক