এত আত্মহত্যা কি 'পরীক্ষার' বিষাক্ত ফল নয়?

মাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশের তিন–চার ঘণ্টার মধ্যে সাতজন কিশোর–কিশোরীর আত্মহত্যার ঘটনা সংবাদমাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছে। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, শরীয়তপুরের গোসাইরহাট, হবিগঞ্জের লাখাই, ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার এসব মর্মান্তিক খবর সর্বশেষ খবর নয়। আরও খবর হয়তো তৈরি হচ্ছে অথবা সত্যতা যাচাইয়ের অপেক্ষায় আছে। সব খবর সংবাদমাধ্যমে আসে না। আগের বছরগুলোতেও অপ্রত্যাশিত ফলাফলের কষ্টে আত্মহত্যার খবর আসত। কিন্তু এবার যেন মৃত্যুর স্রোতের তোড়টা অনেক বেশি। তবে কি করোনার কারণে সৃষ্ট মানসিক চাপে কিশোর–কিশোরীরা আগে থেকেই ক্লান্ত ছিল। ভুগছিল মানসিক শূন্যতায়? পরীক্ষার ফলাফলের সামান্য হেরফের তারা আর সহ্য করতে পারেনি অথবা সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব রক্ষার তাগিদে বন্ধুবান্ধব–শিক্ষকদের থেকে দূরে থেকে যে নিঃসঙ্গতার গহ্বরে ডুবে ছিল তারা, সেখানেই তারা তলিয়ে গেছে।

বছর কয়েক আগে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কলকাতার একজন শিশুমন বিশেষজ্ঞ সময়িতা ব্যানার্জি বলেছিলেন, ‘যে শিশু তার বাড়ির পরিবেশ নিয়ে খুশি, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটায় আনন্দে, মোটের ওপরে যার একটা “সুইট হোম” আছে, তার যদি কখনো পরীক্ষায় খারাপ ফল হয়, সেটা সে সহ্য করে নিতে পারে। কিন্তু যেসব বাড়ির বা স্কুলের পরিবেশটাতেই গন্ডগোল বা যারা ইলেকট্রনিক মিডিয়া-টিভি ইত্যাদি বেশি দেখে, এ রকম শিশুদের স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে কিছুটা সমস্যা তৈরি হয়।’ তবে কি করোনাবন্দী তিন মাসে শিশু–কিশোরেরা তাদের ‘সুইট হোম’ হারিয়ে স্নায়ুচাপে ভুগছিল?

নাকি করোনাজনিত অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, পাস না করলে আর তাদের খরচ বহনের ‘সৌখিনতা’ চালানো সম্ভব হবে না। অথবা মেয়েদের বেলায় বলা হয়েছিল, জিপিএ–৫ পেলে পালব, না পেলে পাঠাব শ্বশুরবাড়ি। প্রাপ্ত সাতটি মৃত্যুসংবাদের ছয়জনই মেয়ে। মৃত দুজনের আবার প্রায় জিপিএ–৫ অল্পের জন্য ফসকে গেছে। ফল বেরোনোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে যখন মৃত্যুর খবরগুলো আসছিল, তখন একজন মনোবিজ্ঞানীকে ফোন করলে তিনি জানান, ‘এখন সমাজটাই এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে ভালো চাকরি, ভাল বেতন—এগুলোই শিশুদের বা তাদের মা–বাবাদের লক্ষ্য হয়ে উঠছে। তাই ওই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য শিক্ষার্থীরা সব সময়ই একটা চাপের মধ্যে থাকে। আবার বাবা–মায়েরাও নিজেদের অসম্পূর্ণ স্বপ্নগুলো সন্তানদের মধ্য দিয়ে পূরণ করতে চায়। যেটা আমরা করতে পারিনি, সেটা যেন ওরা করে দেখায়। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্যে একটা ভয়ংকর অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে।’ তবে কিশোরীদের হার কেন বেশি? এ প্রশ্নের কোনো জুতসই উত্তর আমাদের কাছে নেই।

এর আগের বছরের পরিসংখ্যানগুলো ঘাটলে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে কিশোরীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ছবি খুবই পরিষ্কার। ২০১৭ সালে সারা দেশে যে ২১৩টি শিশু বা কিশোর বয়সী আত্মহত্যা করে, তাদের মধ্যে ৫৩ জন ছেলেশিশু এবং ১৬০ জন মেয়েশিশু। অর্থাৎ ২০১৭ সালে আত্মহত্যার শিকার শিশুদের ২৫ শতাংশ ছেলে এবং ৭৫ শতাংশ মেয়ে। আর তাদের ৬৮ শতাংশেরই বয়স ১৩ থেকে ১৮-এর মধ্যে।

গত তিন বছরে এসএসসি পরীক্ষার পর ১৫০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে আর ৩ হাজার ৭৫০ জনের কিছু বেশি আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এর মধ্যে ৪০০ জন আবার দ্বিতীয়বার চেষ্টা করেছিল। এগুলো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর। বলা বাহুল্য, আত্মহত্যার খবর প্রচার পেলেও আত্মহত্যার প্রচেষ্টার খবর তেমন জানা হয় না। অপ্রকাশিত কষ্টগুলো জানার কোনো উপায় নেই।

আত্মহত্যা নিয়ে যারা রাত–দিন গবেষণা করেন, তাঁদের তথ্য বলছে, প্রতি ২৫টি আত্মহত্যার চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত একজন মারা যায়। তাহলে যে সাতজনের নাম–ঠিকানাসহ খবর রাষ্ট্র হয়েছে, সেই সাতকে ২৫ দিয়ে গুণ করলে যে সংখ্যা আসে, সেটা ১৭৫। প্রথম দফায় বেঁচে যাওয়া অনেকেই দ্বিতীয়, তৃতীয়, আবার চেষ্টা করতে পারে। কারণ, ভাগ্যগুণে প্রথম দফায় বেঁচে যাওয়াদের প্রতি সমাজ-পরিবার আরও নির্মম, নির্দয় হয়ে ওঠে। আত্মহত্যার বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য পৃথিবীব্যাপী কাজ করে সুইসাইড অ্যাওয়ারনেস ভয়েস অব এডুকেশন, সংক্ষেপে এসএভিএ বা সেভ। এই সংস্থা জানাচ্ছে, ১০০ জন নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবলে তাদের মধ্যে গড়ে ২৫ জন শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে। সেই হিসাবে আত্মহত্যার চেষ্টায় বেঁচে যাওয়া আর আত্মহত্যার কথা ভাবাদের সংখ্যা নিয়ে শঙ্কার কারণ আছে বইকি।

আমাদের দেশে সংখ্যা আর শঙ্কা নিয়ে কখনো কেউ একমত হতে পারে না। শঙ্কার ভিত্তি রচনা করে সংখ্যা। আর আমাদের সব সংখ্যায় থাকে গড়মিল আর গোঁজামিলের রাজত্ব। তারপরও প্রশ্ন আসে, এই সংখ্যা রাখবে কোন মন্ত্রণালয়? রেখেই–বা কী করবে? যে মরার সে মরবে, যে বাঁচার সে বাঁচবে—এ রকম দায়সারা অবস্থানই তো আমাদের নীতি।

ভারত-পাকিস্তান প্রভৃতি রাষ্ট্র কিন্তু শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার তত্ত্বতালাশ রাখে। দেশগুলো এটাকে সমস্যা বলে স্বীকার করে সমাধানের পথ খুঁজছে। ভাবছে, এটা হ্রাসের জন্য কী করা যায়। আমরা হয়তো নির্দেশের অপেক্ষায় আছি। ইন্ডিয়ার তথ্য বলছে, সে দেশে প্রতি ৫৫ মিনিটে একজন ছাত্র বা ছাত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এদের একটা বড় অংশই পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়া, উচ্চশিক্ষার জন্য ভালো কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পাওয়া অথবা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ খুঁজে না পাওয়া—এসব নানা দৃশ্যমান বা অদৃশ্য কারণে চাপের মধ্যে ঘুরতে থাকে। এসবের কোনো একটা পর্যায়ে ব্যর্থ হলেই নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়।

স্কুল, বাড়ি, বন্ধুমহল, প্রতিবেশী—চাপ আসে নানা জায়গা থেকেই। অনেক আগে বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের করা এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ এবং প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৭ জন আত্মহত্যা করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কিশোরী বলে জানা গেছে। তাদের আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার অন্যতম একটি কারণ হিসেবে পরীক্ষায় ফেল করা কিংবা আশানুরূপ ফল না করাকে দায়ী করা হয়। কিন্তু পরীক্ষার কারণে কেন বাড়ছে আত্মহত্যা? এ প্রশ্নের জবাব অভিভাবকেরা জানেন। আগে বহুবার তাঁদের দিলে একটু রহম আনার জন্য কাকুতি–মিনতি করে লেখা হয়েছে, কিন্তু তাঁদের মনের পাটাতন বদলেছে বলে মনে হয় না।

যাদের নিয়ে এই লেখা, সেই কিশোর–কিশোরী জাদুমণিদের জন্য নিজের কয়েকজন ঘুরে দাঁড়ানো মানুষের অভিজ্ঞতা নিবেদন করলাম।

এক.
আমার এই বন্ধু তাঁর নাম উহ্য রাখতে বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘...২০০০ সালের কথা। পরীক্ষায় ফেল মেরেছিলাম। আমার বন্ধুরা অনেকেই স্টার মার্ক পেয়েছিল। প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের অনেক বিদ্রূপ শুনেছিলাম। আমিও আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। আম্মা আমাকে মানসিকভাবে শক্ত রেখেছিলেন। বাস্তবতা হচ্ছে, আজ আমি সেই সব বিদ্রূপকারী ও আমার স্টার মার্ক পাওয়া বন্ধুদের চেয়ে সমাজে অনেক ভালো অবস্থানে আছি। অহমিকা করছি না, তবুও মাফ চাইছি এটা অন্যভাবে নেবেন না দয়া করে। আমি যেটা বলতে চাই, এসএসসি বা এইচএসসি বা নামডাকের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারাটাই জীবনের সফলতা নয়। জীবন অনেক বড়, এটার অনেক রং, অনেক বাঁক। কোথায় কোন সাফল্য লুকিয়ে আছে কেউ বলতে পারে না। মা–বাবাকে বলব, সমাজের অসুস্থ প্রতিযোগীদের দিকে না তাকিয়ে নিজের সন্তানের দিকে তাকান। তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা দিন। তাদের জীবনটাও অকৃত্রিম সফলতায় আলোকিত হবে...।’

দুই.
আমাদের সিনিয়র বন্ধু বাংলদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অন্যতম সংকলক বিশিষ্ট লেখক এবং অধ্যাপক আফসান চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘... আমি ভাগ্যবান ছিলাম। আমার পরীক্ষা ভালো হয়নি। অঙ্ক খারাপ হয়েছিল। কিন্তু আমার মা–বাবা খুব চেষ্টা করেন আমার মন ঠিক রাখতে ...।’

তিন.
বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম সফল ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন আরও মজার খবর, ‘... আমি এসএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগ পাই যখন আমার স্কুলের চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চ সবাই প্রথম বিভাগ পায়। আমার কেন জানি না কোনো কষ্ট হয়নি। আমার এক স্বল্প ঘনিষ্ঠ সহপাঠী (প্রথম বিভাগ পাওয়া) আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল, তাতেও আমার কান্না পায়নি। কান্না না পেলেও কষ্টটা পেলাম পরে, যখন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ভর্তির ফরম দিল না। পরে অনেক প্রথম ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করার পর দ্বিতীয় দফায় যখন ফরম ছাড়ে তখন ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। মমতাজ স‌্যার (বাংলা), রণজিত স‌্যার (ইংরেজি) ভাইভা বোর্ডে ছিলেন। আমার সঙ্গের প্রথম বিভাগের ৫০ জন এইচএসসিতে ঝড়ে বা ঝরে পড়ে। শেষমেশ বিশ্ববিদ‌্যালয় সমাপ্ত হলো সময়মতো সম্মানজনকভাবে চারজনের। সেই আমি স্কুলে কিন্তু আগাগোড়া পঞ্চম থেকে দশম পর্যন্ত “প্রথমই” ছিলাম। জীবনে প্রথমের মোহ সেই যে কাটল, আর ফিরে আসে না।’

চার.
দেশের বিশিষ্ট বেতারকর্মী সুলেখক হাসান মীর জানিয়েছেন, ‘... প্রথম হতে পারা ভালো, তারচেয়েও ভালো—ভালো হতে পারা। যাঁরা পরীক্ষায় প্রথম হন না কিংবা প্রথম বিভাগও পাননি, পরে জীবনের পরীক্ষায় তাঁদের অনেকেই ভালো করেছেন, সফল হয়েছেন। শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জ্ঞানার্জন এবং সেই সঙ্গে অবশ্যই কিছুটা ভালো ফল করা, কেবল জিপিএ-৫ পাওয়া নয়। এই ফাইভধারীদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করে।’

আত্মহত্যা কোনো কিছুর জবাব নয়। পুনশ্চ, লেখা শেষ করতে না করতে খবর এল, ২০২০ সালে ৩১ মে এসএসসির ফলাফল প্রকাশের পর মোট ১২ শিক্ষার্থী (নয়জন মেয়ে, তিনজন ছেলে) আত্মহত্যা করেছে এবং একজন চেষ্টা চালিয়েছে। হা খোদা।

লেখক: গবেষক
[email protected]