ডা. জাফরউল্লাহকে নিবেদিত

ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী
ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী

জাফরউল্লাহ চৌধুরীকে শ্রদ্ধা করি। শ্রদ্ধার চেয়েও ভালোবাসি বেশি। একজন মহিরুহসম মানুষকে ‘ভালোবাসি’ বললে এক ধরনের স্পর্ধা প্রকাশ পায়। তাই ভালোবাসাকে ‘শ্রদ্ধা’র মোড়কে ঢেকে রাখি। শ্রদ্ধার সঙ্গে সমপরিমাণ ভালোবাসা মিশালে তাকে কী নামে ডাকা যায়? আমাদের ভাষাভান্ডে কোনো শব্দ আছে কি? নিশ্চয় আছে, হয়তো আমি জানি না। বাংলা ভাষায় আমার জন্ম। কিন্তু নিজের ভাষা জানার ক্ষেত্রে এই দৈন্যে প্রতিনিয়ত অধোমুখী হই। একটি দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী সম্পর্কে উপলব্ধি বর্তমান অবস্থানে উপনীত হয়েছে।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এক তরুণ বীরের নাম ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ডা. এম এ মোবিনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ভারতের আগরতলায় একটি হাসপাতাল স্থাপন করেন। মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ হাসপাতালটির নাম দেন ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হসপিটাল’। মূলত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম হাসপাতাল এটি। স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু এই হাসপাতালের নামকরণ করেন ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’।

১৯৭২ সালে সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যাত্রা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু দেন ২৩ একর জমি। আরও ৫ একর জমি দান করেন জোহরা বেগম, এম এ রব ও লুৎফর রহমান। গণস্বাস্থ্য স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নতুন ধারণার প্রবর্তক। সেটা হলো ‘সমাজভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা’। স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসাসেবার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। একজন মানুষের দৈহিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ভালো থাকার সুসমন্বয় হলো স্বাস্থ্য। শুধু রোগ না থাকাই সুস্থতা নয়। তাই দৈহিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ভালো রাখার জন্য দেওয়া সেবাগুলো হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। কেউ রোগাক্রান্ত হলে রোগটি দূর করার জন্য যে সেবা দেওয়া হয়, সেটা হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। চিকিৎসাসেবা মূলত স্বাস্থ্যসেবার একটি অংশমাত্র। স্বাস্থ্যসেবা কখনোই ব্যক্তিভিত্তিক হতে পারে না, একে সমাজভিত্তিক হতেই হবে।

পক্ষান্তরে চিকিৎসাসেবা প্রধানত ব্যক্তিভিত্তিক। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সমাজভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা মূলত এ দেশের মানুষের স্বাস্থ্য অধিকার কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তার একটি বাস্তব প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস। এ ক্ষেত্রে ডা. চৌধুরী বাংলাদেশে ‘পথ নির্মাণকারী’। তিনি ‘মানুষের জন্য স্বাস্থ্য’ স্বাস্থ্য-দর্শনের সফল বাস্তবায়নকারী। অথচ এই প্রসঙ্গটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার সব প্রসঙ্গে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাজাখস্তানের আলমাআতায় ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য ২০০০ সালের মধ্যে’ এই ঘোষণা গৃহীত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই বৈশ্বিক স্বপ্ন নির্মাণের প্রাণপুরুষদের অন্যতম একজন ছিলেন ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী।

১৯৮২ সাল। দেশে তখন সামরিক শাসন চলছে। সে সময় সামরিক অধ্যাদেশ জারি করে আইন প্রণয়ন করা হতো। ১৯৮২ সালের ৮ নম্বর অধ্যাদেশ অনুযায়ী ঔষধ নিয়ন্ত্রণ পরিষদ এবং জাতীয় ঔষধ উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়। এ বছরেই সামরিক সরকার একটি ওষুধনীতি প্রণয়ন করে। এরশাদ সরকার এটি ঘোষণা করলেও আমরা সবাই জানতাম এর মূল কারিগর হলেন ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী। সাধারণভাবে এটাকে ‘জাফরউল্লাহর ড্রাগ পলিসি’ নামে ডাকা হতো। সে সময় আমরা মেডিকেল কলেজের স্বাপ্নিক তরুণ। আমাদের চোখে বিপ্লবের স্বপ্ন। হাতের স্টেথেস্কোপকে মানুষের স্বাস্থ্য বদলে দেওয়ার হাতিয়ার ভাবি।

বাম আদর্শে দীক্ষিত আমাদের প্রথমত মনে হলো ‘এই ওষুধনীতিটি সত্যিকারের একটি বৈপ্লবিক নীতি। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরেই এ রকম একটি নীতি প্রণীত হওয়া অতি আবশ্যক ছিল। এটি গণমানুষের পক্ষে এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষাকারী।’ আমরা তরুণ মেডিকেল ছাত্রকর্মীরা অভিনন্দন জানিয়ে ওষুধনীতি পক্ষে জনমত গঠন করতে কাজে নামতে চাইলাম। তখন কতগুলো বিশাল বাধা সামনে এসে দাঁড়াল। প্রথমটি হলো সামরিক শাসকের কোনো কাজ আমরা সমর্থন করতে পারি কি না? এই প্রশ্নটি আমাদের দ্বিধায় ফেলে দেয়। দ্বিতীয় হলো চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) এই ওষুধনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। এ বিষয়টি আমাদের অনেককে হতবুদ্ধি করে দেয়। তখন বিএমএর মূল নেতা (মহাসচিব) ছিলেন ডা. সারোয়ার আলী। আমরা তখন একই দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি অনুগত। আমি ও আমার এক বন্ধু (তখন মেডিকেল কলেজ ছাত্ররাজনীতির উজ্জ্বল সক্রিয়বাদী, বর্তমানে অধ্যাপক) এক বিকেলে ডা. সারোয়ার আলীর সঙ্গে বিএমএ অফিসে দেখা করতে যাই। ওষুধনীতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি যা বললেন, তাতে চূড়ান্ত অসন্তোষ নিয়ে আমরা বিএমএ অফিস ত্যাগ করি। মস্তিষ্ক-বন্ধক-রাখা রাজনীতি সম্পর্কে তখন থেকেই ধারণা পাওয়া শুরু হয়। তৃতীয় ছিল তৎকালীন মেডিকেল কলেজগুলোর সিনিয়র অধ্যাপকদের অবজ্ঞামিশ্রিত প্রত্যাখ্যান। তাঁদের অনেকে অত্যন্ত বাজে ভাষায় অবৈজ্ঞানিকভাবে ওষুধনীতির সমালোচনা করতেন। আমরা সম্মিলিতভাবে ওষুধনীতিটির পক্ষে জোরালোভাবে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। এই যন্ত্রণায় এখনো পীড়িত হই।

১৯৯৮ সালে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ১৯৭২ সালের সমাজভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের কর্মভাবনার আরেকটি অগ্রগতি। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্বাস্থ্য–দর্শন আত্মস্থ করে দলে দলে চিকিৎসক মেডিকেল কলেজ থেকে বের হচ্ছে। মানুষকে সুস্থ রাখার ব্রত নিয়ে এরা সারা দেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। শুধু স্বপ্ন দেখা নয়, সেটাকে বাস্তবায়নের জন্য আজীবন নিবেদিত থাকা একটি বিরল বিষয়।

২০২০ সালে ডা. জাফরউল্লাহ করোনার বৈশ্বিক মহামারির মহাদুর্যোগের সময়ে ড. বিজন কুমার শীল ও তাঁর দলকে করোনা পরীক্ষা কিট উদ্ভাবনে প্রবল পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। ড. শীলের আবিষ্কার নিঃসন্দেহে ‘দৃশ্যপট বদলে দেওয়ার’ ক্ষমতা রাখে। অপরিমেয় চিন্তার দারিদ্র্যের জন্য সেই কিটকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্যবহারের অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে অবহেলায় সময়ক্ষেপণ করা হলো। চিরকাল মানবকল্যাণের বিপক্ষে কতিপয় ক্ষুদ্র স্বার্থলোভী মানুষই দাঁড়িয়েছে।

আশিতে পা রাখা এই কর্মবীর কিডনির অসুখে ভুগছেন। সম্প্রতি কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত। এই মানুষটির জীবনী লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। তাঁকে নিয়ে প্রশস্তি রচনা করছি না। তাঁর সব কাজের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠাও আমার উদ্দেশ্য নয়। মানুষটির জীবনভ্রমণকে প্রত্যক্ষ করে আমার ভেতর তাঁকে নিয়ে যে বোধের অবয়ব তৈরি হয়েছে, আমি শুধু সেটুকু লিখছি।

আমরা জানি, সমাজে চার প্রকারের মানুষ থাকে। এরা হলো উদগাতা বা পথ নির্মাণকারী, অগ্রগামী, অধিকাংশ ও পশ্চাৎপদ। সব কালে সব সমাজে ‘পথ নির্মাণকারী’ মানুষের সংখ্যা স্বল্প থাকে। এ রকম একজন উদগাতা মানুষের যুগে আমি বাস করছি। তাঁর সঙ্গে আমার রাজনৈতিক ভাবনার বিস্তর ফারাক ছিল। সমাজতন্ত্রের চৈনিক ভাবাদর্শের দিকে ছিলেন তিনি এবং আমি সোভিয়েতের দিকে। তাঁকে গ্রহণ নয়, সমালোচনা করতে আমার উৎসাহ ছিল। ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে যাওয়ার সুযোগ ঘটেনি। হাতে গোনা কয়েকটি অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। আমার দিক থেকে কুশল জিজ্ঞাসা ব্যতিরেকে তেমন কোনো আলাপ হয়নি। জীবনপথের শেষাংশে হাঁটছি। এ রকম সময়ে মানুষ আত্ম-আবিষ্কারে সচেষ্ট থাকে। এ প্রয়াস থেকেই নিজের সব বোধ ও বুদ্ধি মন্থন শেষে বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করলাম ‘আমি ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরীর ছাত্র (Disciple)’। আমার অজান্তেই তাঁর থেকে পাঠ গ্রহণ করছি, তাঁর ভাবনাধারাকে অনুসরণ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যজগৎকে মানবমুখীন করার লক্ষ্যে নিবেদিত এই স্বাপ্নিক, দার্শনিক ও কর্মবীর মানুষটিকে আমি অসীম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

(লেখক-শিশু অধিকার, স্বাস্থ্য ও পরিবেশকর্মী, choudhurybd 16 @gmail. com)