ক্যাসিনো-কাণ্ডের মামলা

গত বছর সেপ্টেম্বরে যখন সরকার ক্যাসিনো–কাণ্ড তথা দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে, তখন নীতিনির্ধারকেরা এই বার্তাই দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন যে অন্যায় করে এখন আর কেউ পার পাবে না। সব দুর্নীতিবাজ-চাঁদাবাজকে আইনের আওতায় আনা হবে। সরকারের শুদ্ধি অভিযান ও নেতাদের আওয়াজ শুনে সাধারণ মানুষের মধ্যেও আশাবাদ দেখা দিয়েছিল যে বিলম্বে হলেও সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেবে। কেননা ক্ষমতাসীন দলের এত বেশি চাঁই একসঙ্গে ধরা পড়ার নজির খুব নেই।

মামলার প্রাথমিক তদন্তে দুর্নীতির যেসব উপাখ্যান বের হচ্ছিল, তা রূপকথাকেও হার মানায়। সে সময়ে ক্ষমতাসীন দলের ভেতরেও শুদ্ধি অভিযানের আওয়াজ উঠেছিল এবং বেশ কয়েকজন পদাধিকারীকে সরিয়েও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমরা হতাশার সঙ্গে দেখলাম, একটা পর্যায়ে এসে শুদ্ধি অভিযান থেমে গেল। সব দুর্নীতিবাজকে ধরা হলো না। গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকার শুদ্ধি অভিযান চালায়। এই কয়েক মাসেই ঘুষ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির সঙ্গে যুক্ত সবাইকে জালে আনা গেছে, এটা নিশ্চয়ই সরকারের নীতিনির্ধারকেরা দাবি করবেন না। তাহলে অভিযানটি হঠাৎ করে থেমে যাওয়ার বা থামিয়ে দেওয়ার পেছনে কী  উদ্দেশ্য আছে?

তারপরও প্রত্যাশা ছিল, যাঁদের ধরা হয়েছে অন্তত তাঁদের বিচার হবে। কিন্তু মামলার তদন্তে যে মন্থরগতি চলছে, তাতে এর ভবিষ্যৎ অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ক্যাসিনো–কাণ্ড ও শুদ্ধি অভিযানে দায়ের করা ৪৫টি মামলার মধ্যে ২৯টির তদন্তই আটকে আছে। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনেরই ১২টি। অথচ মামলা দায়ের করার পর দুদক চেয়ারম্যান বলেছিলেন ক্যাসিনো–কাণ্ডে আরও যেসব রাঘববোয়ালের নাম এসেছে, সবার বিরুদ্ধে মামলা হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, দুদকের মামলার তদন্তই এগোচ্ছে না।

দুদকসহ সংশ্লিষ্টদের জানা উচিত যে দুর্নীতি বা অন্য কোনো অপরাধের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বিচার বা অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে যথাসময়ে প্রতিটি মামলার সুষ্ঠু তদন্ত হবে। বিলম্বিত তদন্ত মানে অভিযুক্তদের সুবিধা করে দেওয়া।

ক্যাসিনো–কাণ্ড ও ঘুষ, চাঁদাবাজি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে যে ১৫ ব্যক্তিকে আট করা হয়েছিল, তঁারা খুবই প্রভাবশালী। গ্রেপ্তার হওয়ার  আগে বিভিন্ন সরকারি অফিস ও দলীয় কার্যালয়ে তাঁদের দাপট দেখা গেছে। ফলে আটক হওয়ার পরও যে তাঁরা নানাভাবে মামলা প্রভাবিত করার চেষ্টা করবেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যে আটক দুজন জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। আটক অপর দুজন অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে মাসের পর মাস হাসপাতালে অবস্থান করছেন। একই সঙ্গে কোনো কোনো আটক নেতার মুক্তির পক্ষে শহরে পোস্টার ছাড়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রচার চালানো হচ্ছে। এসব করছেন সরকারি দলের লোকজনই। 

সরকার সব দুর্নীতিবাজকে ধরার যে অঙ্গীকার করেছিল, সম্ভবত সেখান থেকে পিছু হটেছে। এখন দায়ের করা মামলার তদন্তে গাফিলতি ও অহেতুক বিলম্ব, একের পর এক আসামির জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসা ভুল বার্তাই দিচ্ছে।

আমরা মনে করি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার যে শূন্য সহিষ্ণুতার কথা বলছে তা দূরে থাক, যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ন্যূনতম অঙ্গীকারও থাকে, তাহলে ক্যাসিনো–কাণ্ড ও শুদ্ধি অভিযানে দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্তকাজ দ্রুতই শেষ করা উচিত। তদন্তই যদি শেষ না হয়, বিচারিক কাজ এগোবে কীভাবে? প্রয়োজনে দ্রুত বিচার আইনের মতো এই মামলার তদন্তের সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হোক।