সাদা গাড়ির কালো চাকা যত দিন থাকবে তত দিন বর্ণবাদ থাকবে!

ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডে বিক্ষুব্ধ যুক্তরাষ্ট্র। নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে হাঁটু গেড়ে বসে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। ছবি: রয়টার্স (ফাইল ছবি)
ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডে বিক্ষুব্ধ যুক্তরাষ্ট্র। নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে হাঁটু গেড়ে বসে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। ছবি: রয়টার্স (ফাইল ছবি)

‘বর্ণবাদ তত দিন থাকবে, যত দিন সাদা গাড়িগুলোর চাকা কালোই থাকবে। দুর্ভাগ্য বোঝাতে কালো, আর শান্তি বোঝাতে সাদার ব্যবহার যত দিন থাকবে, তত দিন থাকবে বর্ণবাদ। বিয়ের পোশাক সাদা, আর শবযাত্রায় কালো পোশাকের চল যত দিন থাকবে, তত দিন থাকবে বর্ণবাদ। করখেলাপি বা মন্দ লোকেদের যত দিন সাদা নয়, কালোতালিকাভুক্ত করা হবে, তত দিন বর্ণবাদ থাকবে। এমনকি স্নুকার খেলায়ও কালো বলটিকে গর্তে না ফেলা পর্যন্ত কেউ জিততে পারে না, আর সাদা বলটিকে বরাবর টেবিলের ওপরই থাকতে হয়।’

ওপরের উক্তিটি চমকে যাওয়ার মতো। উক্তিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জিম্বাবুয়ের প্রয়াত নেতা রবার্ট মুগাবের হিসেবে প্রচার করা হলেও এর উৎসটি পাওয়া যায়নি। উৎস যা-ই হোক, যে-ই এই কথা বলে থাকুন না কেন, উক্তিটি নিঃসন্দেহে ভাবনার দাবি রাখে। নিত্যদিনের জীবনে অজস্র সাদা-কালোর বিন্যাস কত নিরীহভাবে থেকে যাচ্ছে। এই বিন্যাস কত দারুণভাবে প্রাত্যহিক জীবনে বর্ণবাদী আচার ও মনের পরিচয় বহন করে চলেছে।

এই উক্তিটির কথা এভাবে সামনে আসত না, যদি জর্জ ফ্লয়েড নামের কোনো ব্যক্তি হঠাৎ করে বিখ্যাত হয়ে না উঠতেন। নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে তবে কালো আর ধলোর আকার খুঁজতে বেরও হতো না মানুষ। জর্জ ফ্লয়েডকে বিখ্যাত হওয়ার জন্য এই করোনা-স্তব্ধ সময়ে মরে যেতে হয়েছে। এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাঁটুর নিচে দম বন্ধ করা এক মৃত্যুকে অনিচ্ছায় বরণ করতে হয়েছে। তাঁকে বারবার বলতে হয়েছে, ‘আই কান্ট ব্রিদ’ (আমি শ্বাস নিতে পারছি না)। এই উজ্জ্বল আলোর চমকানো সময়ে আকর্ষণীয় ব্যানার ও ফেস্টুন রচনার স্বার্থেই কি তিনি এই কাঁপিয়ে দেওয়া তিনটি শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন থেমে থেমে? নাকি এই করোনাকালের চিহ্ন নিজের শেষ কয়েকটি কথায় রেখে যেতে চাইছিলেন তিনি? মহামারির কবল থেকে বেঁচে যাওয়া জর্জ ফ্লয়েড কি তবে নিজের শ্বাসকষ্টের মৃত্যুকেই তিরস্কার করছিলেন? কে জানে।

সামাজিক সাম্যের দাবিতে নিউইয়র্কে ট্রাম্প ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের সামনে হাজারো মানুষের বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স (ফাইল ছবি)
সামাজিক সাম্যের দাবিতে নিউইয়র্কে ট্রাম্প ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের সামনে হাজারো মানুষের বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স (ফাইল ছবি)

ফ্লয়েড বলছিলেন, ‘আই কান্ট ব্রিদ’। এই করোনাকালে কেই-বা শ্বাস নিতে পারছে? ফ্লয়েড বোঝেননি সাদা-কালোয় বিভাজনের পৃথিবী এখনো অতীত নয়। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, মাত্র কয়েক মাস আগে ফেব্রুয়ারিতে একই তরিকায় নিহত আহমদ আরবেরির কথা। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন ব্রেয়না টেইলরের কথা। ফ্লয়েড এমনকি এই যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত ও মৃত্যুতে অশ্বেতাঙ্গ মানুষের অনুপাতটির কথাও ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, কেন এখনো অপেক্ষাকৃত দরিদ্র অঞ্চলগুলোতেই কৃষ্ণাঙ্গদের আবাস বেশি হয়। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন শার্লোৎসভিলের কথা, যেখানে বর্ণবাদী অতীত রয়েছে এমন শ্রদ্ধেয় নেতাদের ভাস্কর্য অপসারণের দাবিতে সমবেত হওয়া মানুষের ভিড়ে গাড়ি তুলে দেওয়া হয়েছিল, আর তাকে পরোক্ষ সমর্থন জানিয়েছিলেন গদিনশিন প্রেসিডেন্ট।

ফ্লয়েড হঠাৎ করেই মিনিয়াপোলিসের উজ্জ্বল পথে দাঁড়িয়ে নিজের গাত্রবর্ণটির কথা ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন বিশ্ব শাসনের অহংকার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুক্তরাষ্ট্রে এই ইতিহাস এখনো পুরোনো হয়ে যায়নি। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, একজন বারাক ওবামার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সব ওলট-পালট হয়ে যায় না। নিজের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখটি তিনি হয়তো দেখতে পাননি। তাহলে হয়তো তিনি দেখতে পেতেন, তাঁর মৃত্যুর পর বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নামা মানুষকে শায়েস্তা করতে তাঁরই দেশের প্রেসিডেন্ট সেনা মোতায়েন করতে চান।

হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে সমবেত সাংবাদিক। প্রেসিডেন্ট আসবেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে কিছু বলবেন। বাইরে তখন হাজারো জনতা ক্রমাগত স্লোগান দিচ্ছে। এই সময়ে জনতার ভয়ে বাংকারে আশ্রয় নেওয়া প্রেসিডেন্ট বের হয়ে এলেন। নির্ধারিত সময়ের আগেই হোয়াইট হাউসের পাশের রাস্তায় সমবেত জনতার ওপর ছোড়া হলো কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট। জনতা ছত্রভঙ্গ। তারপর প্রেসিডেন্ট তাঁর পাত্র-মিত্র-অমাত্য নিয়ে হেঁটে গেলেন পাশের গির্জায় ছবি তুলতে। গির্জার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বাইবেল হাতে ছবি তোলার সময় তাঁর করা নানা কসরত নিয়ে ‘সাধু সাধু’ বলে মুহুর্মুহু শোর তুললেন তাঁর পাত্র-মিত্ররা—এমন দৃশ্য কত জন্মের ভাগ্য হলে তবে দেখা যায়। বিপাকে পড়েই তাঁর মনে পড়ল সেই সব রক্ষণশীল সমর্থকের কথা, যাদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে অভিযোগ উঠেছে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনকে বিতর্কিত করতে লুটপাট ও ভাঙচুরের রেওয়াজ ছড়িয়ে দেওয়ার।

বিক্ষোভকারীদের সামনে নিউইয়র্ক পুলিশের অবস্থান। ছবি: রয়টার্স (ফাইল ছবি )
বিক্ষোভকারীদের সামনে নিউইয়র্ক পুলিশের অবস্থান। ছবি: রয়টার্স (ফাইল ছবি )

এই সময় তো গত শতকের ষাটের দশকের সঙ্গে তুলনীয়। আরও ভালো করে বললে ১৯৬৮ সালের সঙ্গে, যে বছর নিহত হলেন বর্ণবাদবিরোধী মার্কিন নাগরিক আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র।

এখনকার মতো এমনই এক ভাইরাসের প্রকোপ ছিল সে বছর। মানুষ মারা যাচ্ছিল। অ্যাপোলো-৮–এর উৎক্ষেপণ নিয়ে উত্তেজনা ছিল শ্বাসরুদ্ধকর দশায়। কিন্তু তাও কি জর্জ ফ্লয়েডের শ্বাসরুদ্ধকর দশার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে? না, তবু বারবার এই তুলনাই চলে আসছে। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র যে ড্রিমের বা স্বপ্নের কথা বলেছিলেন, যা বারবার করে উচ্চারণ করেছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, তা স্বপ্নই থেকে গেছে। সেই ১৯৬৮ সালের এপ্রিলে গুলিবিদ্ধ কিংয়ের জন্য লাখো মানুষের যে ঢল নেমেছিল, ফ্লয়েডের মৃত্যুও সে ঢল নামিয়েছে। কই সব তো একই আছে। এমনকি মাঝের এই সময়টাতে এমন হাজারো ফ্লয়েডের দেখা মিলবে, যাঁরা শুধু মৃত্যুর মধ্য দিয়েই বিখ্যাত হতে পেরেছিলেন, যাঁরা সমাজকে বর্ণবাদের দায় কাঁধে নেওয়ার জন্য বাধ্য করতে পেরেছিলেন, তবু কিছুই বদলাতে পারেননি।

জর্জ ফ্লয়েডদের মৃত্যু বারবার বর্ণবাদ ও বর্ণবাদী নিপীড়নের বিদ্যমানতার কথা প্রমাণ করে। তার আগ পর্যন্ত কেউ একে দেখেও দেখে না। অথচ ভুক্তভোগী মাত্রই জানে যে, ভদ্রবেশী বর্ণবাদ মানেই ‘পান থেকে চুন খসলেই খুন’। কোনো বেনিফিট অব ডাউটের সুযোগ ওই গোষ্ঠী বা শ্রেণি পাবে না। এ কারণেই মাত্র ২০ ডলারের জাল নোট বহন ও ব্যবহারের চেষ্টার অভিযোগে জর্জ ফ্লয়েডকে হাঁটু চাপা পড়ে মরতে হয়। ভেন্টিলেটরের মর্ম বোঝা এই সময়ে তাঁকে মরতে হয় ‘আই কান্ট ব্রিদ’ কাকুতি জানাতে জানাতে। এই শ্বাসরুদ্ধকর মৃত্যুর চোখের দিকে তাকাতে তাকাতে ফ্লয়েডের হয়তো মনে পড়েছিল, গাড়িগুলো এখনো সাদা, আর তার চাকার রং কালোই রয়ে গেছে।

নিউইয়র্কে ২ জুন রাত ১২টার মধ্যেই বিক্ষোভ থেকে দুই শতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেছে। ছবি: রয়টার্স (ফাইল ছবি))
নিউইয়র্কে ২ জুন রাত ১২টার মধ্যেই বিক্ষোভ থেকে দুই শতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেছে। ছবি: রয়টার্স (ফাইল ছবি))

না, এই সাদা-কালোর উপমা মানুষের গায়ের রং থেকে আসেনি। এই উপমা বরং প্রকৃতি থেকে চেপে বসেছে মানুষের গাত্রবর্ণের ওপর। দিন ও রাতের প্রতীক হিসেবেই সাদা ও কালোর ব্যবহারের শুরু বলা যায়। এই রাতের অনিশ্চয়তা ও দিনের স্বস্তিই পরে চেপে বসেছে এই দুই রঙের ওপর। আর এই প্রতীকায়িত দুই রং পরে ঔপনিবেশিক শক্তি হয়ে দেশে দেশে সাম্রাজ্য বিস্তার করা শ্বেতাঙ্গরা ব্যবহার করেছে অন্য জাতিগোষ্ঠীকে দমন করতে। হাজার বছর ধরে সাহিত্য, শিল্প, বয়ানসহ নানাভাবে এই আরোপণ হয়েছে। এই আরোপণের কারণেই স্থূলকায় ও কৃষ্ণাঙ্গ শরীরের সৌষ্ঠবধারী মাদার গডেস উইলেনডর্ফকে নাম নিতে হয় শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব ও নন্দনের উপমা ভেনাসের। তারপর বিদ্রোহ হয়েছে। বিশ্ব লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা, মুগাবেদের উত্থান দেখেছে। আশ্বস্ত হয়েছে, কিন্তু স্বস্তি পায়নি। কারণ, এককালের আরোপণই এখন উৎসের হয়ে ওকালতি করছে। তা না হলে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরপাক খাওয়া বিখ্যাত সেই উক্তিটিকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখার ফুরসত অন্তত পাওয়া যেত। যত দিন ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বিভাজন সৃষ্টিকারী নেতা বিশ্বের দেশে দেশে থাকবেন, তত দিন এই ফুরসত মিলবে না।

এই বর্ণবাদকে মোকাবিলার জন্য মিথ্যার ঘরে বাস করা নেতাদের চেনাটা খুব জরুরি। রবার্ট মুগাবের কাছেই ফেরা যাক। বর্ণবাদকে মুগাবে দেখেছেন ‘মিথ্যার সন্তান’ হিসেবে। আর একে মোকাবিলার পথও তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। মুগাবে বলছেন, ‘বর্ণবাদকে বর্ণবাদ দিয়ে নয়, ঐক্য দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে।’ এই ঐক্যের পথই এখন দেখাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রসহ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে রাস্তায় প্রতিবাদ করতে নামা মানুষেরা।