মানব পাচার

বাংলাদেশের মানব পাচারের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়েই সাত বছর আগে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান করা হয়েছিল। অথচ বিচারকের স্বল্পতা এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকার কারণেই এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা সম্ভব হয়নি। তবে সরকার ও হাইকোর্টের বিশেষ উদ্যোগ থাকলে বিদ্যমান বিচারব্যবস্থার আওতায় আরও বেশি মানব পাচারের মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব ছিল। ২০ এপ্রিল ইউএনডিপির সহযোগিতায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আয়োজিত একটি সেমিনারে গত সাত বছরে মানব পাচারের মাত্র ৫ শতাংশ মামলার নিষ্পত্তির একটি চিত্র ফুটে উঠেছে, যা দুর্ভাগ্যজনক।

মানব পাচারের ব্যাপকতা রোধ করতে হলে প্রথমত দেশেই কর্মসংস্থানের বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। দক্ষ ও আধা দক্ষ শ্রমিকেরা এখনো ঋণ বা জমিজিরাত বিক্রি বা বন্ধক রেখে অনিশ্চয়তা আছে জেনেও আদম পাচারকারীদের শরণাপন্ন হন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, প্রলুব্ধ হয়ে কেউ যাতে দেশ না ছাড়ে, সেটা নিশ্চিত করতে সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে। আমরা তাঁর এই অভিমতের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।

বেকারত্বের যন্ত্রণা অসহনীয়, দেশেও ভালো একটি চাকরি পাওয়া সোনার হরিণ, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে বিপদ জেনেও তাঁরা প্রলুব্ধ হবেন। এ রকম অসচেতন কিংবা অপরিণামদর্শী মানুষকে নিবৃত্ত করার সামাজিক দায় প্রত্যেক নাগরিকের। কিন্তু সরকার যদি দাবি করে যে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের কারণে প্রলুব্ধ হয়ে পাচারের সংখ্যা কমে আসছে, তাহলে সেটা মানা কঠিন। এই দাবিকে বিশ্বাসযোগ্যতা দিতে হলে গত ১০ বছরে দেশে কতটা নতুন শিল্পকলকারখানা এবং তাতে কত বেকার মানুষের চাকরি হয়েছে, তার একটি বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যান তুলে ধরা দরকার।

সম্প্রতি আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলেও আমাদের উন্নতির ভিত্তি এখন পর্যন্ত তৈরি পোশাক রপ্তানি এবং জনশক্তি রপ্তানিকেন্দ্রিক রয়ে গেছে। শুধু ওই অবস্থা বজায় রাখার বাস্তবতা বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টির পথে একটি বড় বাধা হয়েই থাকছে। কারণ, দুটি খাতেই কর্মসংস্থানের বড় ধরনের সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টি বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল। আর আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার অব্যাহতভাবে সংকুচিত থাকছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছে। ভূমধ্যসাগরে চাকরিসন্ধানীদের সলিলসমাধির খবর এসেছে। এসব করুণ উপাখ্যানের হতভাগ্য বাংলাদেশিদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু দেখার বিষয় হলো এসব রূঢ় বাস্তবতা সত্ত্বেও মানব পাচারের প্রকোপ কমছে না। মানব পাচার নিশ্চয় আর দশটি অপরাধের মতোই ঘৃণ্য। কিন্তু এই অপরাধের সঙ্গে দেশে অসহনীয় বেকারত্বের যে যোগসূত্র, রাষ্ট্র তা অস্বীকার করতে পারে না। গত ১০-১৫ বছরে দেশ থেকে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার হওয়া অন্তত এই ইঙ্গিত স্পষ্ট করে যে মুষ্টিমেয় যাঁরা টাকা বানিয়েছেন, তাঁরাও দেশে বিনিয়োগ করতে ভরসা পান না।

২০১৫ সালে বিবিসি বাংলাদেশ সংলাপে এসে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছিলেন, মানব পাচারের ঘটনা সরকার গুরুত্বসহকারে নিয়েছে বলেই ‘এনকাউন্টারে’র মতো ঘটনা ঘটছে। গত কয়েক বছরে সন্দেহভাজন মানব পাচারকারীদের অনেককেই কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হতে হয়েছে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয় না।

বিচারহীনতা রোধে হাইকোর্টের নিবিড় তদারকি দরকার। নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালকে মানব পাচার মামলা নিষ্পত্তির এখতিয়ার দেওয়া হলেও ট্রাইব্যুনালগুলোকে অনেক সময় সব ধরনের মামলা নিষ্পত্তিতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এর অবসান দরকার। যেমন এই মুহূর্তে ৬৪ জেলায় ৪ হাজারের বেশি মামলার মধ্যে তিন শতাধিক মামলা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন। এতটা পুরোনো মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুরাহায় নিম্ন আদালতকে বাধ্য করতে পারেন হাইকোর্ট।