বাজেটে পাঁচটি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে

বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
>

বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। এই করোনা পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে কোন কোন খাতে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, প্রণোদনা প্যাকেজ, স্বাস্থ্য খাতসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহাঙ্গীর শাহ

প্রথম আলো: এখন একটি বিশেষ পরিস্থিতি চলছে। এমন করোনা প্রেক্ষাপটে আগামী বাজেটে অর্থমন্ত্রীকে কোন খাতে বেশি নজর দেওয়া উচিত?

ফাহমিদা খাতুন: করোনা অর্থনীতিতে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে, সেখান থেকে আগের অবস্থায় ফিরে যেতে তিন থেকে পাঁচ বছর লেগে যাবে। তবে তার জন্যও পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। সেগুলোকে তাৎক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদি ও মধ্যমেয়াদি—এই তিন ভাগে ভাগ করে নিতে হবে। সেগুলোর জন্য কোন কোন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ কী ধরনের প্রস্তুতি নেবে, সেটিরও বিস্তারিত কার্যক্রম প্রস্তুত করতে হবে। তারপর এই কার্যক্রমের জন্য কী ধরনের অর্থ প্রয়োজন হবে, তার হিসাব করতে হবে। আগামী অর্থবছরের বাজেট যেহেতু এই করোনা ক্রান্তিকালের প্রথম বাজেট, তাই এই বাজেটের গুরুত্ব অতীতের অন্য বাজেটগুলোর চেয়ে ভিন্ন। এই বাজেটে নজর দিতে হবে তাৎক্ষণিক এবং স্বল্পমেয়াদি দিকগুলোর দিকে, যেহেতু বাজেটের মেয়াদকাল মাত্র এক বছর। তবে এক বছর মেয়াদকাল হলেও বাজেটকে দিকনির্দেশনা দিতে হবে সামনের বছরগুলোতে কীভাবে অর্থায়ন এবং সম্পদ সঞ্চালন করতে হবে। আগামী ২০২১ অর্থবছরের বাজেটে পাঁচটি খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। এগুলো হচ্ছে স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি, কর্মসংস্থান ও শিক্ষা।

প্রথম আলো: করোনার প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ নিয়ে নানা সমালোচনা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের পাশাপাশি আগামী বছরগুলোতে (মধ্য মেয়াদে) স্বাস্থ্য বাজেট কেমন হওয়া উচিত?

ফাহমিদা খাতুন: স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ খুবই কম। এত কম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই অর্থ দিয়ে স্বাভাবিক সময়েই ভালো স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যায় না। কয়েক বছর ধরেই এই খাতে বরাদ্দ জিডিপির মাত্র দশমিক ৯ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দবিষয়ক মধ্যমেয়াদি কৌশলপত্র রয়েছে। যেমন ২০১২ থেকে ২০৩১ সাল পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা অর্থায়নের কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, ২০৩২ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য বাজেট জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। আমাদের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাও একটি মধ্যমেয়াদি কর্মকৌশল। এই কৌশলে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ১ দশমিক ১২ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলা আছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২০ সালে। কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যায়নি। ২০২১ সাল থেকে শুরু হচ্ছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, যেটি আগামী ২০২৫ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। আমরা আশা করছি, করোনার আলোকে স্বাস্থ্য খাতে এখানে অধিক অর্থের প্রয়োজন বিবেচনায় রাখা হবে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে এই খাতে বরাদ্দ জিডিপির ৫ শতাংশে উন্নীত করা হবে।

প্রথম আলো: করোনার কারণে ব্যবসা–বাণিজ্য সহসাই আগের জায়গায় বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে না বলে অনুমান করা হচ্ছে। এমন অবস্থায় রাজস্ব আদায়েও ভাটা দেখা দিতে পারে। তাহলে বাজেটের অর্থের জোগান কীভাবে হবে?

ফাহমিদা খাতুন: করোনার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে যাওয়ায় আয়ও কমে গেছে। তাই রাজস্ব আদায় কমে যাবে। অন্যদিকে অর্থনীতিতে চাঙাভাব ফিরিয়ে আনতে সরকারি ব্যয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। যেকোনো বড় অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে সরকারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। করোনার কারণে বাংলাদেশ সরকারও বেশ কিছু প্রণোদনা এবং ত্রাণ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। প্রণোদনা প্যাকেজের প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যাংকের মাধ্যমে যাবে। কিন্তু ত্রাণের সবটাই সরকারের কোষাগার থেকে যাবে। করোনার স্থায়িত্বকাল আর ক্ষয়ক্ষতি বাড়লে ত্রাণের পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। রাজস্ব আদায় যেহেতু অনেক কম হবে, তাই সরকারকে কয়েকটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, কর খাতের সম্প্রসারণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে যাদের উৎসে কর কাটা হয়, বছর শেষে তাদের কর পর্যালোচনা করে সবার পুরো কর আদায় করতে পারলে করের পরিমাণ অনেক বাড়বে। তৃতীয়ত, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ইউনিটের কাছে কর ফাঁকিসহ নানা তথ্য থাকে। সেই তালিকা অনুযায়ী, কর ফাঁকিবাজদের কাছ থেকে কর আদায় করতে পারলেও করের পরিমাণ অনেক বাড়বে। চতুর্থত, বাংলাদেশে অনেকেই আছেন, যাঁরা আয় দেখান কম, কিন্তু তাঁদের জীবনযাত্রার ব্যয় সেই তুলনায় বেশি। সে ক্ষেত্রে ব্যয়ের জায়গাগুলো ধরে তাঁদের কর নির্ধারণ করা গেলে কর আদায় বাড়বে। সুপারমার্কেট, ব্যক্তি খাতের হাসপাতাল, ব্যক্তি খাতের বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি জায়গায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ব্যবহার করে মানুষের ব্যয় বের করা যাবে। পঞ্চমত, দেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে।

ব্যয়ের ব্যাপারেও চিন্তাভাবনা থাকতে হবে। নতুন কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প এখনো কাজ শুরু হয়নি বা সম্প্রতি শুরু হয়েছে, সেগুলো আপাতত স্থগিত করা যেতে পারে। এডিপিতে থোক বরাদ্দ বাতিল করা উচিত। প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস করতে হবে। সরকারের উচিত সব বিভাগকে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ খরচ কমানোর নির্দেশ দেওয়া। অনুৎপাদনশীল খাতের ব্যয় কমিয়ে উৎপাদনশীল খাতের ব্যয় বাড়ানো এখন একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।

করোনার প্রণোদনার জন্য যেহেতু ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর অনেক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাই ব্যাংকের ওপর সরকারের চাপ কম রাখতে পারলেই ভালো। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কম হওয়ায় যে সাশ্রয় হবে, তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আর বিদেশি সাহায্যের ক্ষেত্রে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে। বাজেট সহায়তা হিসেবে সাহায্য আসবে।

প্রথম আলো: করোনার প্রেক্ষাপটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে গুরুত্বের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটে। করোনার পরিস্থিতিতেও একই অভিযোগ আছে। এটা সামাল দেওয়ার পথ কী?  

ফাহমিদা খাতুন: করোনার পরিপ্রেক্ষিতে দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। তাদের সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে। কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। প্রথমত, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সুবিধাভোগী নির্বাচনে সমস্যা অনেক দিনের। যাদের সাহায্য প্রয়োজন তারা বাদ পড়ে যায়, আবার যাদের প্রয়েজন নেই, তাদের নাম স্বজনপ্রীতির কারণে তালিকায় ওঠে। জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে সুবিধাভোগীদের তালিকাভুক্ত করা হলে সমস্যা কিছুটা কমবে। যাঁরা বাদ গেছেন, তাঁরা যাতে নিজেই নাম লেখাতে পারেন, সে জন্য টেলিফোন করে নাম অন্তর্ভুক্ত করার বন্দোবস্ত রাখতে হবে। তালিকাটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে রাখতে হবে। ভাতা দেওয়ার জন্য ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সেবার মাধ্যমে অর্থ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। হতদরিদ্রদের তালিকা প্রস্তুত এবং অর্থ পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য তদারকি ব্যবস্থার মধ্যে স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। সদিচ্ছা থাকলে ভাতা নিয়ে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি বন্ধ করা কঠিন নয়।

প্রথম আলো: অনেকেই বেকার হয়ে গেছেন, দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী?

ফাহমিদা খাতুন: অর্থনীতিতে কর্মযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব সমস্যা দূর করা সম্ভব। উৎপাদনশীল খাতে সরকারের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তবে ব্যক্তি খাতেই কর্মসংস্থান বেশি হয়। ব্যক্তি খাত যত তাড়াতাড়ি তাদের কর্মকাণ্ড শুরু করতে পারবে, ততই মঙ্গল। সব রকম স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সেটা করতে হবে। কিন্তু কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটি কথা মনে রাখতে হবে। করোনা আমাদের কাজের প্রকৃতি এবং যোগ্যতা দুটোই পরিবর্তন করে দিয়েছে এবং সামনে আরও দেবে। ব্যবসা–বাণিজ্য এবং কাজকর্মের বিরাট অংশ হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। তাই এ ধরনের কাজে যুক্ত হতে হলে আমাদের জনগোষ্ঠীকে প্রস্তুত করতে হবে। কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে সবাই চাকরি পাবে না। কারণ, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লে জনবল কম লাগবে। তাই অনেককে স্বনিয়োজনের কথা ভাবতে হবে। সেখানেও প্রশিক্ষণ দরকার হবে এবং মূলধনের দরকার পড়বে। সহজ শর্তে ক্ষুদ্রঋণের সুবিধা দিতে হবে। তা ছাড়া ঘরে বসেই অনেক কাজ করা যাবে। সে জন্য আরও দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা সবাইকে দিতে হবে। সরকারকে প্রযুক্তি খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

ফাহমিদা খাতুন: আপনাকেও ধন্যবাদ।