ছয় দফা প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ

তাজউদ্দীন আহমদ: জন্ম‍: ২৩ জুলাই ১৯২৫, মৃত্যু: ৩ নভেম্বর ১৯৭৫

১৯৬৬ সাল। ৭৫১ সাত মসজিদ রোডের বাড়ির সামনের অফিসঘরটিতে এক ব্যক্তি নিবিষ্ট মনে লিখে চলেছেন।

তাঁর মুক্তার মতো হাতের লেখনীতে নির্মিত হচ্ছে একটি জাতির পথনির্দেশনা।

একটি পরাধীন জাতির স্বাধিকারের সনদ। তিনি লিখছেন, ‘একটি রাষ্ট্রের উন্নতি, অগ্রগতি, সংগতি ও নিরাপত্তা নির্ভর করে উহার অভ্যন্তরীণ শক্তির উপর। সেই শক্তির উৎস সন্তুষ্ট জনচিত্ত।

আঠারো বছর পূর্বে পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। আজও ইহার রাষ্ট্রীয় কাঠামো গণসমর্থনের মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড়াইতে পারে নাই।

পাকিস্তানের মূল ভিত্তি ১৯৪০ সালের যে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তান অর্জনের জন্য মানুষকে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল, পরবর্তীকালে ঐ মূল ভিত্তি হইতে বিচ্যুতিই এই অবস্থার আসল কারণ।’ দুই পৃষ্ঠাব্যাপী ছয় দফা দাবিনামার মুখবন্ধ লিখছেন ছয় দফার অন্যতম রূপকার, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ।

পরবর্তী পাতায় ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান।

ওই একই বছর তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক ও শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি নির্বাচিত হন।

এই দুই তরুণ নেতৃত্বের চিন্তা ও চেতনার মিলনের ফলেই আওয়ামী লীগ সেদিন হতে পেরেছিল জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী একটি সার্থক রাজনৈতিক সংগঠন।

ছয় দফাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আইয়ুব সরকার ৮ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, জহুর আহমেদ চৌধুরী, রাজশাহীর মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, নূরউল ইসলাম প্রমুখ নেতা ও পরবর্তী সময়ে আরও নেতা ও কর্মীকে কারাবন্দী করলেও ছয় দফার আন্দোলন কিন্তু থেমে থাকেনি।

সামরিক জান্তার ১৪৪ ধারা, নির্যাতন, নিষ্পেষণ ও গুলিবর্ষণ উপেক্ষা করে দেশব্যাপী ছয় দফার দাবিতে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, মজুরসহ আপামর জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে ও শ্রমিকনেতা মনু মিয়াসহ ১১ জন শহীদের রক্তে রঞ্জিত ৭ জুন অমরত্ব লাভ করল। ৭ জুন স্বীকৃতি অর্জন করল বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফার দিবস রূপে।

দীর্ঘ ছয় বছর পর মুক্ত বাংলাদেশের মাটিতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম এগোয় সর্পিল গতিতে।

আঁকাবাঁকা পথ ধরে। রক্তপিচ্ছিল এই পথ। বাধা এখানে অসংখ্য। পার হতে হয় অনেক চড়াই-উতরাই। সংগ্রামের একেকটা মোড় পরিবর্তনে ইতিহাসে সংযোজিত হয় নতুন অধ্যায়।

৭ জুন আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এমনি একটি যুগান্তকারী মোড় পরিবর্তন। ৭ জুনকে এক অর্থে বলা যায় ৬ দফার দিবস।

এই দিনে ৬ দফার দাবিতে বাঙালি রক্ত দিতে শুরু করে। স্বাধিকারের এই আন্দোলনই ধাপে ধাপে রক্ত নদী পেরিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে গিয়ে শেষ হয়েছে। কাজেই বাঙালি জাতির স্বাধীনতাসংগ্রামে ৭ জুন অমর।

অবিস্মরণীয় এক ঐতিহাসিক দিন ৭ জুন।’ (দৈনিক বাংলা, ৭ জুন, ১৯৭২)

৭ জুন উপলক্ষে সাংবাদিকের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাজউদ্দীন আহমদ ৬ দফার নেপথ্য যে ঘটনাবলি ব্যক্ত করেছিলেন তার ঐতিহাসিক মূল্য ব্যাপক।

তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর আইয়ুব খান আসলেন ঢাকায়।

জনাব নুরুল আমিন (মুসলিম লীগ নেতা, পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ১৯৪৮-১৯৫৪) উদ্যোগ নিলেন তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাদের সাক্ষাৎ ঘটানোর। আমাদের সঙ্গে আইয়ুব খানের সে সাক্ষাৎ হয়েও ছিল।

কিন্তু এর আগে আমরা তৎকালীন স্থানীয় সমস্যাসহ পাকিস্তানের রাজনৈতিক পটভূমিকায় তৈরি করি একটি দাবিনামা। তাতে ছিল ১৩টি দফা।

নুরুল আমিন সাহেবকেও তার একটি কপি আমরা দিয়েছি। কিন্তু তিনি সেই কপির দফা দেখেই চমকে উঠলেন। তাহলে তো আর আলোচনা হতেই পারে না আইয়ুব খানের সঙ্গে। আমরা অনড় রইলাম। তবুও সাক্ষাৎকার হলো।

‘সম্ভবত নুরুল আমিন সাহেব তার কপিটা আইয়ুব খানকে দিয়েছিলেন। তারপর এল ১৯৬৬ সাল। লাহোরে বসল সর্বদলীয় কনফারেন্স।

...আমরাও সে সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেলাম। যাওয়ার আগে শেখ সাহেব বললেন, লাহোর কনফারেন্সের জন্য বাঙালিদের পক্ষ থেকে কিছু তৈরি করে নিতে।

আমরা তখন সেই ১৩ দফার স্থানীয় কিছু বাদ দিয়ে তৈরি করলাম এক দাবিনামা।

তাতে অনেক উপদফা বাদ দিয়ে মোট দাবি হলো ৬টি। তাই নিয়ে আমরা গেলাম লাহোরে, তা পেশ করা হলো সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে।

কিন্তু সাবজেক্ট কমিটি আমাদের দাবিনামা দিল নাকচ করে। পরদিন প্রতিবাদে আমরা বর্জন করলাম সর্বদলীয় সম্মেলন।
‘দাবিনামায় যে ৬টি দফা ছিল তার ওপর আমরা তেমন গুরুত্ব দিইনি।

কিন্তু সম্মেলন বর্জনের পরদিন পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রে ব্যানার হেডিংয়ে বের হলো শেখ সাহেবের ছয় দফা।

অথচ সে সময় পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে কোনো সম্মেলনের খবর প্রকাশ করা ছিল নিষিদ্ধ। তবুও ছয় দফার খবর বের হলো খবরের কাগজে।

সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদের অপবাদ দিয়ে লেখা হলো সম্পাদকীয়। ছয় দফা দাবি ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র।

সে বছর মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বসল আওয়ামী লীগের বার্ষিক কাউন্সিল সভা।

আমরা ছয় দফাকে অন্তর্ভুক্ত করলাম আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতে। মার্চের কাউন্সিল অধিবেশনের তৃতীয় ও শেষ দিনে ২০ মার্চ পল্টনে হলো আমাদের বিরাট জনসভা।

শেখ সাহেব ব্যাখ্যা দিলেন ছয় দফা কর্মসূচির। শুরু হলো ছয় দফার আন্দোলন। শেখ সাহেব সফর করলেন সারা বাংলা।

সভা করে আমরা প্রচার শুরু করলাম ছয় দফার।’
ছয় দফার প্রথম দাবিটিই ছিল ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ফেডারেশন ভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ ও পার্লামেন্টারি সরকার।

এই দাবিটির সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টারি সরকারপদ্ধতির মিল লক্ষ করা যায়। দ্বিতীয় দাবিতে ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি সীমাবদ্ধ থাকবে এবং বাকি সব নীতি অঙ্গরাষ্ট্রগুলো প্রণয়ন ও পরিচালনা করবে।

বাকি দাবিগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ হলো, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য অবাধে বিনিময়যোগ্য পৃথক দুটি মুদ্রা চালু অথবা এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, যাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার না হতে পারে।

অঙ্গ রাষ্ট্রগুলোর কর ধার্য করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ ক্ষমতা, বৈদেশিক বাণিজ্যর ক্ষেত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা; বাণিজ্যিক চুক্তি প্রণয়ন, আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষার জন্য অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর নিজ কতৃত্বাধীন আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা।

ছয় দফার বাণী পরিণত হয় বাঙালির হৃদয়ের দাবিতে। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক চক্র বিচলিত হয়ে ওঠে।

নেতাদের জেলে পুরে ছয় দফার আন্দোলনকে নিঃশেষ করার আগে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, জনসমক্ষে ছয় দফাকে অযৌক্তিক ও অবাস্তব প্রমাণ করার।

সেই অনুসারে স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিদেশমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ছয় দফাকে অসার ও অযৌক্তিক প্রমাণ করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় তর্কযুদ্ধের আহ্বান জানান।

তাজউদ্দীন আহমদ ও শেখ মুজিব একত্রে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন যে শেখ মুজিব ভুট্টোর চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করবেন।

বার্কলে ও অক্সফোর্ডের তুখোড় ছাত্র ভুট্টো ঢাকায় এলেন এক বিরাট উপদেষ্টার দল নিয়ে।

বিশদ প্রমাণপত্রের মাধ্যমে ছয় দফার যৌক্তিকতাকে অভেদ্য নিশ্চিত করে শেখ মুজিবের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে ভুট্টোর সঙ্গে দেখা করলেন তাজউদ্দীন।

ভুট্টো তাঁরই প্রায় সমবয়সী তাজউদ্দীনের কাছে ছয় দফার তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ শুনে বুঝতে পারলেন যে তর্কযুদ্ধে শেখ মুজিবকে হারানো মুশকিল হবে। তিনি তাজউদ্দীন সম্পর্কে মুসলিম লীগের নেতাদের কাছে মন্তব্য করেছিলেন, ‘হি ইজ ভেরি থরো।

শেখের যোগ্য লেফটেন্যান্ট আছে দেখছি।’ (আবদুল গাফফার চৌধুরী, ‘একজন বিস্মৃত নেতার স্মৃতিকথা’। ঢাকা।

যায়যায়দিন, ১১ জুন ১৯৮৫) তর্কযুদ্ধের দিন পল্টনের জনসভায় যোগদানের জন্য যখন বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ সমাগম হতে শুরু করেছে ঠিক সেই দিন সকালবেলাতেই ভুট্টো তাঁর বিজ্ঞ উপদেষ্টার দলসহ চুপিসারে ঢাকা ত্যাগ করলেন। ঢাকার একটি কাগজ শিরোনাম দিল ‘ভুট্টোর পলায়ন’।

উল্লিখিত ঐতিহাসিক বিবরণ আবারও প্রমাণ করে যে নেতৃত্বের মধ্যে যখন মেধা, জ্ঞান, দক্ষতা, দেশপ্রেম ও আন্তরিকতার সংমিশ্রণ ঘটে, তখনই সম্ভব হয় সব অসম্ভবকে জয় করা।

শারমিন আহমদ: তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা