আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে

মুশতাক হোসেন।
মুশতাক হোসেন।
>

মুশতাক হোসেন। ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর) অন্যতম উপদেষ্টা। এর আগে এই প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমিত রোগীর সন্ধান মেলে। আজ এর তিন মাস পূর্তি হয়েছে। এই সময়ের অভিজ্ঞতা ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে জুমের মাধ্যমে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে প্রথম কোভিড সংক্রমণের তিন মাস পূর্ণ হলো। এদিকে দ্য ইকোনমিস্ট–এর একটি প্রতিবেদনে ঢাকায় সাড়ে সাত লাখ আক্রান্তের বিষয়ে তথ্য দেওয়া হয়েছে। এই তথ্যের সূত্র হিসেবে আইসিডিডিআরবি তার ব্যাখ্যা দিয়েছে। কিন্তু ৬ জুন ‘প্রাণঘাতী স্রোত’ শিরোনামে পত্রিকাটি আরেকটি রিপোর্টে বলেছে, জুলাইয়ের শেষে ভারত, বাংলাদেশ ও
পাকিস্তানে আক্রান্ত ৫০ লাখ ও মৃতের সংখ্যা দেড় লাখে পৌঁছাতে পারে।

মুশতাক হোসেন: আমি সেটি দেখিনি। তবে রোগতাত্ত্বিক মডেলিংয়ের ওপর ভিত্তি করে এটা হয়েছে। সংবেদনশীলতার কারণে আগে এ ধরনের রিপোর্ট প্রকাশ করা হতো না। তবে আমরা পেরুকে বিবেচনায় নিতে পারি। বাংলাদেশের চেয়ে যদিও মাথাপিছু আয় তাদের বেশি। কিন্তু লকডাউনের এক মাসের মধ্যেই মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। সামাজিক দূরত্বের শর্ত শ্রমজীবীদের দ্বারাই বেশি লঙ্ঘিত হয়। সেখানে সংক্রমণ (প্রায় দুই লাখ আক্রান্ত, ৫ হাজারের বেশি মৃত্যু) বাড়ে। তার  প্রতিবেশী ব্রাজিল সরকার তো তার ঔদাসীন্যের (৩৫ হাজার মৃত্যু) জন্য বেশ সমালোচিত। আপনি যেটা বললেন, সেখানে দেখার বিষয় হলো তিন দেশেই প্রান্তিক মানুষদের ঘর থেকে বেরোতে হচ্ছে। তাই পেরু ও ব্রাজিলের মতোই এই অঞ্চলের ঘনবসতিপূর্ণ শ্রমজীবীদের এলাকাগুলো ঝুঁকিতে থাকবে। আমাদের দেশে যাতে তেমনটা না ঘটে, সে জন্য সরকার, স্বেচ্ছাসেবী ও এনজিওগুলোর তরফে সতর্কতা কাম্য। একজন ফিলিপাইনের স্বাস্থ্যকর্মী এক জুম সভায় বলছিলেন, তাঁরা সতর্ক থাকছেন, ইতালি বা যুক্তরাষ্ট্রের সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় যেভাবে স্পাইক (এক লাফে সংক্রমণ অনেক উঁচুতে ওঠা) হয়েছে, সেটা যাতে না ঘটে। আমরা যদি প্রান্তিক মানুষকে খাদ্য দিই, স্বাস্থ্যসচেতন রাখি, তাহলে আমরা উল্লম্ফন রোধ করতে পারব।

প্রথম আলো: আপনি সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেছেন, কোভিড-১৯ ভিকটিম সংখ্যা সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে প্রকৃত অবস্থা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ বেশি। এটা মৃতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য?

মুশতাক হোসেন: হিসাবটা রোগতাত্ত্বিক। সোয়াইন ফ্লুর সময়ও বলা হয়েছিল, ল্যাবে যারা সংক্রমিত বলে প্রমাণিত, তার বাইরে আছে কমপক্ষে ১০ ভাগ। সেটার হার ছিল ১.৫ ভাগ। এটাকে বলে রিপ্রডাকটিভ ফ্যাক্টর। উহানে কোভিডে এই হার ছিল ২.৫ ভাগ। বাংলাদেশে এটা এখনো ১.২৫ ভাগ। তবে এটা বাড়ছে। তাই বাংলাদেশে মৃদু লক্ষণযুক্ত রোগীর সংখ্যাটি, ল্যাবে যা শনাক্ত হয়েছে তার থেকে ১০ গুণ বেশি। অবশ্য মৃতের ক্ষেত্রে এই সূত্র খাটবে না। মৃতের সংখ্যা বাংলাদেশে লুকানো কঠিন। কোভিডের লক্ষণ নিয়ে যাঁরা মারা গেছেন, শুধু প্রথম আলোতে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, তাদের সংখ্যা ৫০০–এর নিচে। তাহলে আপনি ৮৮৮ এর সঙ্গে আরও ৫০০ যোগ করুন। আবার এর মধ্যে যাঁরাই এমন লক্ষণ নিয়ে মারা গেছেন, তাঁদের সবাই কোভিড পজিটিভ, এমন তো নয়। অবশ্য অনেকে লুকাতে চাইছেন। কিন্তু শ্বাসকষ্ট হলে তঁাকে হাসপাতালে আসতেই হবে। কিন্তু হাসপাতালগুলোতে যে উপচে পড়া ভিড়, সেটা আমরা দেখছি না।

প্রথম আলো: রোববার পর্যন্ত মৃত ৮৮৮ এবং আক্রান্ত বলা হয়েছে, ৬৫,৭৬৯। কিন্তু আপনি যে হিসাব দিলেন তাতে তো আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ৬ লাখের বেশি দাঁড়াল? আর মৃতের সংখ্যা সরকার যা বলছে, সেটাই? আপনি নিশ্চিত?

মুশতাক হোসেন: আমি ১০ গুণ বেশি আক্রান্ত বলেছি, তার মধ্যে মৃদু লক্ষণযুক্তরাও আছেন। আর মৃতের সংখ্যার ব্যাপারে বলতে পারি, আইইডিসিআর ২–৩ সপ্তাহ আগে স্থানীয় সরকার ও হাসপাতালগুলোর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে। যঁারা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন, তাঁদের নিরূপণ করা এর লক্ষ্য। এটাকে আমরা বলছি ‘ভারবাল অটোপসি’ (মৌখিক ময়নাতদন্ত)।  

প্রথম আলো: বিশ্বব্যাংক আপনাকে কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর তিন মাস হলো। কী ভাবছে তারা?

মুশতাক হোসেন: তারা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারের সামর্থ্য বাড়াতে নানাভাবে সহায়তা দিচ্ছে। তারাও আশঙ্কা করছে, যাতে বিস্ফোরণ এড়ানো যায়। বাংলাদেশ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যা মত, সেই মত তাদেরও। সরকার ও বিশ্বব্যাংক কোভিড-১৯ মোকাবিলায় তিন বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প নিয়েছে।

প্রথম আলো: তার মানে সরকার ও বিশ্বব্যাংক কি ধরেই নিয়েছে, এটা তিন বছর পর্যন্ত চলবে?

মুশতাক হোসেন: না, না, তা নয়। একনেকে যেটা
পাস হয়েছে, সেটা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। তবে আনুষঙ্গিক কিছু বিষয় রয়েছে, যে জন্য তিন বছর
মেয়াদ নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এর মধ্যে আশু বাস্তবায়ন অংশের মধ্যে টেস্ট বাড়ানো, জরুরি চিকিৎসাসামগ্রী,
মাস্ক ও পিপিইর সরবরাহ বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণের মতো বিষয় আছে।

প্রথম আলো: আইইডিসিআরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমাদের দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে বেশি টেস্টের দরকার হবে না। উপসর্গ দেখে চিকিৎসা দিলেই চলবে। সরকার কি এ রকম মত দ্বারা প্রভাবিত?

মুশতাক হোসেন: সেটা হয়তো তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সার্ভিল্যান্স টেস্টের (যেমন কোন এলাকায় কতটা বাড়ছে বুঝতে) কথা বলে থাকবেন। এখানে একটা বোঝার ভুলও থাকতে পারে। সরকার টেস্ট চেয়েছে ডায়াগনসিসের
জন্য। আইইডিসিআর টেস্ট চেয়েছে গবেষণার জন্য। তবে কথা হলো যখন আমরা টেস্ট শুরু করি, তখন শনাক্তের সংখ্যা শতকরা ২০ ভাগের নিচে ছিল। ২৪ মে থেকে দেখছি যে প্রতি ৫ জন টেস্টে একজন শনাক্ত হচ্ছে। এটা একটা ছোট লাফ। 

প্রথম আলো: দৈনিক ১৫ হাজার টেস্ট করানোর অবস্থায় পৌঁছাতে ৩ মাস লাগল। আরও অন্তত ১৫ হাজার টেস্ট সংখ্যা বাড়াতে অর্থাৎ দৈনিক ৩০ হাজার টেস্টে পৌঁছানো কবে? আর এভাবে বাড়ালেই তো হবে না, নমুনা সংগ্রহে দক্ষতা লাগবে। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ হচ্ছে না। আজ (রোববার) মহাখালীতে তাঁরা আপনাদের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করলেন। তাহলে?

মুশতাক হোসেন: এখন থেকে ৩০ হাজারে পৌঁছাতে অত বিলম্ব হওয়ার কথা নয়। কারণ, এই প্রক্রিয়া তো ইতিমধ্যে একটা গতি পেয়েছে। টেকনোলজিস্ট নিয়োগে বিলম্ব দুঃখজনক। চলমান জনবলসংকট কাটানো এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, যাদেরই ল্যাব আছে, তাদের যুক্ত করতে পারলে আগামী এক মাসে প্রতিদিন ৩০ হাজার টেস্ট করানো সম্ভব।

প্রথম আলো: আগের অভিজ্ঞতা থেকে দেখলে, বর্তমানে কোথাও রোগী ৩০ ছাড়ালেই রেড জোন বা আবার লকডাউন করার মতো সিদ্ধান্ত কার্যকর করা সম্ভব হবে? পুলিশ যখন বেশি আক্রান্ত?

মুশতাক হোসেন: ঢাকার টোলারবাগ ও মাদারীপুরের শিবচরের সফল উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। সেখানে পুলিশ নয়, স্থানীয় মানুষ সম্পৃক্ত হয়েছিল বলেই সম্ভব হয়েছিল। সামনেও তেমনটাই করতে হবে। এ কারণে স্থানীয় সরকার ও স্বেচ্ছাসেবীদের সম্পৃক্ত করে স্থানীয় কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় যাঁরা বাসায় থাকতে পারবেন না, তঁারা কমিউনিটি আইসোলেশনে থাকবেন। এটা ঠিক যে
দেশের প্রতিটি শহর অঞ্চলে আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।

প্রথম আলো: তিন মাস পেরোনোর সন্ধিক্ষণে আগামী তিন মাসের দিকে চোখ রাখুন এবং দুটি আশাবাদ আর দুটি মুখ্য উদ্বেগের কথা বলুন। সরকার ও বিশ্বব্যাংক উভয়ে যখন আপনার কাছ থেকে ‘রিস্ক’ বুঝতে চাইছে।

মুশতাক হোসেন: প্রধান আশাবাদ হলো এখন পর্যন্ত সংক্রমণটা ধীরগতিতে রয়েছে। দ্বিতীয়ত সরকারের জোনভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ কৌশল। এতে সফল হলে আমরা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব। আর উদ্বেগের বিষয় হলো সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে যদি খাদ্যসহ পর্যাপ্ত সহায়তা দিতে না পারি এবং সারা দেশে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারি, তাহলে এখন যা সংক্রমণ এবং ক্ষয়ক্ষতির হার, সেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তখন আমাদের একটা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হতে পারে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মুশতাক হোসেন: ধন্যবাদ।