তামাকের এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়

অনেকটা এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করার মতো। সরকার চাইলেই করানোয় আক্রান্ত স্বাস্থ্য খাত ও অর্থ খাত দুটোকেই একসঙ্গে সুরক্ষা প্রদান করতে পারে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আসন্ন বাজেটে কেবল তামাকপণ্যের দাম বাড়িয়েই অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জন এবং তামাক ব্যবহারজনিত স্বাস্থ্যব্যয় কমানো সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, তামাকাসক্তরা করোনায় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বর্তমানে বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন এবং প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিজ বাড়িতেই পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তামাকের ক্ষতির শিকার এই বিপুল প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী বর্তমানে মারাত্মকভাবে করোনা ভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। তামাকের সহজলভ্যতা এবং ত্রুটিপূর্ণ করকাঠামোই এর প্রধান কারণ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডসসহ ছয়টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সম্মিলিত গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশ যদি আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে সিগারেটের বিদ্যমান চারটি মূল্যস্তর বিলুপ্ত করে দুটি নির্ধারণ, সম্পূরক শুল্কের একটি অংশ সুনির্দিষ্ট কর আকারে আরোপ এবং সব তামাকপণ্যের কর ও দাম তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী বৃদ্ধি করে, তাহলে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জিত হবে।

অধিকন্তু, সব তামাকপণ্যের খুচরা মূল্যের ওপর ৩ শতাংশ হারে সারচার্জ আরোপ করা হলে আরও এক হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয় অর্জন সম্ভব। অতিরিক্ত এই অর্থ সরকার করোনা মহামারিসংক্রান্ত স্বাস্থ্যব্যয় এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যয় করতে পারে। একই সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে ছয় লাখ বর্তমান ধূমপায়ীর অকালমৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে এবং প্রায় ২০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী ধূমপান ছেড়ে দিতে উৎসাহিত হবেন, যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনকে ত্বরান্বিত করবে। তামাকবিরোধী সাংবাদিক জোট ইতিমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গ্রুপের এই তামাক কর প্রস্তাব বিবেচনার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে পাঠিয়েছে।

বাংলাদেশে তামাকপণ্য খুবই সস্তা এবং দিন দিন আরও সস্তা হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের তথ্যমতে, বিশ্বের ১৫৭টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কমদামে সিগারেট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১০২তম এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিয়ানমারের পরেই বাংলাদেশে সবচেয়ে কম দামে সস্তা ব্রান্ডের সিগারেট পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য আরও সস্তা। প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) কর্তৃক রিলেটিভ ইনকাম প্রাইস (আরআইপি) পদ্ধতির মাধ্যমে সিগারেটের স্তরভিত্তিক সহজলভ্যতা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৫-১৬ সালে একজন ধূমপায়ীর প্রিমিয়াম, উচ্চ এবং মধ্যম স্তরে এক হাজার শলাকা সিগারেট কিনতে যেখানে মাথাপিছু জিডিপির যথাক্রমে ৯ দশমিক ৩২, ৬ দশমিক ৪৬ ও ৪ দশমিক ১৫ শতাংশ ব্যয় হতো, সেখানে ২০১৮-১৯ সালে একই পরিমাণ সিগারেট কিনতে ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮৪, ৪ দশমিক ৮৮ ও ৩ দশমিক ১৩ শতাংশ। নিম্নস্তরে এই হার প্রায় একই রয়েছে।

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭–এর ফলাফল বলছে, ২০০৯–এর তুলনায় ২০১৭ সালে সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ বৃদ্ধি পেয়েছে। তার মানে সিগারেটের প্রকৃত মূল্য ক্রমে হ্রাস পাওয়ায় কারণেই সিগারেটের ব্যবহার কমছে না। অন্যান্য তামাকপণ্য, যেমন: বিড়ি, গুল, জর্দা প্রভৃতি প্রতিনিয়ত সস্তাতর হয়ে পড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকের ওপর কার্যকরভাবে করারোপ করলে তামাকের ব্যবহার হ্রাস পায় এবং রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পায়।

জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবাতে অনুষ্ঠিত ‘উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন’ শীর্ষক বিশ্ব সম্মেলনে তামাক করকে রাজস্ব আহরণের একটি কার্যকর ও সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে তামাক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করেন। বাস্তবতা হলো মোট তামাক রাজস্বের মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ (২০১৭-১৮ অর্থবছর) আসে ধোঁয়াবিহীন তামাক থেকে। সুতরাং ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য থেকে সরকারের বাড়তি রাজস্ব আয়ের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।

সাউথ আফ্রিকায় ১৯৯৩ থেকে ২০০৯ সালে সিগারেটের প্রকৃত মূল্য ৩২ শতাংশ থেকে ৫২ শতাংশে বৃদ্ধি করা হয়, এ কারণে সেখানে একদিকে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাথাপিছু দিনপ্রতি সিগারেট সেবনের পরিমাণ ৪টি থেকে কমে ২টিতে নেমে আসে, অন্যদিকে এ সময়ে সরকারের রাজস্ব আয় ৯ গুণ বৃদ্ধি পায়। ফিলিপাইন, তুরস্ক ও মেক্সিকোও এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের উচ্চ প্রবণতা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৪৮ শতাংশ, যেখানে অতি উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই হার মাত্র ২৪ শতাংশ। বাংলাদেশে গৃহস্থালি ব্যয়ের ক্ষেত্রে তামাকের পেছনে ব্যয়ের ক্রাউডিং আউট প্রভাববিষয়ক গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক ব্যবহারকারী পরিবারগুলোকে তামাকমুক্ত পরিবারের তুলনায় শিক্ষা, বস্ত্র, বাসস্থান, জ্বালানি ও যাতায়াতের চেয়ে চিকিৎসায় অনেক বেশি ব্যয় করতে হয়। এ ছাড়া তামাকের ব্যবহার স্বাস্থ্যব্যয় বৃদ্ধি, আয় ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং একই সঙ্গে পুষ্টি ও শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যয় সীমিত করার মাধ্যমে পরিবারগুলোকে ক্রমে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর করে ফেলে (টোব্যাকো অ্যান্ড পভার্টি, টোব্যাকোনমিকস পলিসি ব্রিফ, ২০১৮)।

বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৯ দশমিক ২ শতাংশ (গ্লোবাল স্কুল-বেইজড স্টুডেন্ট হেলথ সার্ভে, ডব্লিউএইচও, ২০১৪), যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ: আ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসাব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা একই সময়ে (২০১৭-১৮) তামাক খাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের (২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা) চেয়ে অনেক বেশি।

কেবল করোনা সংক্রমণে নয়, তামাকের ব্যবহার নানাভাবে আমাদের স্বাস্থ্য খাত ও অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। কাজেই তামাকের সব ধরনের ক্ষতি থেকে সুরক্ষা পেতে সরকার অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির এই পরীক্ষিত হাতিয়ার, অর্থাৎ তামাকপণ্যে বর্ধিত হারে কর ও দাম বাড়িয়ে স্বল্প মেয়াদে ব্যাপক পরিমাণে রাজস্ব আয় অর্জন করতে পারে। তামাকপণ্যের দাম বাড়লে এর ব্যবহার কমবে এবং তামাক ব্যবহারজনিত স্বাস্থ্যব্যয়ও হ্রাস পাবে। এতে স্বাস্থ্য খাত ও অর্থ খাত উভয়ই সুরক্ষা পাবে।

*এ বি এম জুবায়ের, নির্বাহী পরিচালক, প্রজ্ঞা, ই–মেইল: [email protected]