কৃষি প্রযুক্তি ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের প্রসার জরুরি

কৃষি খাতে কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত এখনো পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত প্রধান খাদ্যশস্য, ফলমূল, শাকসবজি ও মাংসের সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, পরিবহন ও বাজারজাতকরণ সংকুচিত হওয়ার ফলে ইতিমধ্যে ফসল সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তবে স্বস্তির খবর হলো রেকর্ড পরিমাণ বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে (প্রায় ২০৪ লাখ টন)। আশা করা যায়, ২০১৯-২০ মৌসুমে আউশ ও আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হবে (যথাক্রমে প্রায় ৩৪ লাখ ও প্রায় ১৬৩ লাখ টন)। এ ছাড়া গম, ভুট্টা, আলুসহ অন্যান্য খাদ্য উৎপাদনও গত বছরের চেয়ে বেড়েছে।

করোনা সংকটকালেও কৃষি উৎপাদনের এই ধারা অব্যাহত রাখতে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ৪ শতাংশ সুদে কৃষিঋণের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ, যেমন কৃষি পুনর্বাসন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ক্ষতিপূরণ ও সমবায়ভিত্তিক চাষাবাদের জন্য বরাদ্দ, ফসলের নতুন জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের জন্য বরাদ্দ, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, বীজ, সেচ ইত্যাদি খাতে সহায়তা বাবদ মোট বরাদ্দ ৩৯৫ কোটি টাকা। ভর্তুকি মূল্যে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ বাবদ ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এর ফলে এবার করোনা সংকটে হাওরের বোরো ধান শতভাগ ঘরে তোলা সম্ভব হয়েছে। 

২০১৯-২০ অর্থবছরে সার ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য নয় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান করা হয়েছে। দেশের মোট জনশক্তির প্রায় ৪১ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত। আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রতিবছর প্রায় পৌনে ১ শতাংশ হারে কমছে। তা সত্ত্বেও গত এক দশকে কৃষি খাতে গড় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এখন দেশের মোট জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান প্রায় ১৪ শতাংশ। আইএমএফের হিসাবে অবশ্য ১৩ দশমিক ০৭ শতাংশ, এই হিসাবে আমাদের কৃষি খাতের মোট জিডিপির পরিমাণ হয় ৪১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আবাদি কৃষিজমির পরিমাণের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। এখনো মোট ভূমির প্রায় ৬০ শতাংশ কৃষি এবং পল্লির উন্নয়নে ব্যবহৃত হচ্ছে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভারত (প্রায় ৫৩ শতাংশ), পাকিস্তানের অবস্থান তৃতীয় (প্রায় ৪০ শতাংশ) এবং পরের অবস্থান থাইল্যান্ডের (প্রায় ৩৩ শতাংশ)। 

বাংলাদেশ আবাদি কৃষিজমি ব্যবহারের সর্বাগ্রে থাকলেও কৃষি জিডিপিতে কৃষির অবদান আশানুরূপ নয়। অথচ চীন মাত্র ১৩ শতাংশ আবাদি জমি ব্যবহার করেও জিডিপিতে তাদের কৃষির অবদান সর্বোচ্চ। 

এখন প্রশ্ন হতে পারে, কেন বাংলাদেশ অনেক বেশি পরিমাণ আবাদি জমি ব্যবহার করেও জিডিপিতে আমাদের কৃষি খাতের অবদান এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে বেশি হওয়া সত্ত্বেও মোট কৃষি জিডিপির আয়তনে পিছিয়ে আছে। এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এবং বাংলাদেশের পরিসংখ্যানের দিকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ কৃষি-অকৃষি সব পণ্য রপ্তানি করে আয় করেছে ৪০ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। শুধু তৈরি পোশাক খাত থেকেই আয় হয়েছে প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ। কৃষিপণ্যের মধ্যে চিংড়ি, জীবন্ত ও হিমায়িত মাছ, কাঁকড়া, শাকসবজি, তামাক, চা, মসলা, ফুল, ফল, শুকনা খাবার ও অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করে আয় হয় মাত্র ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রপ্তানি আয়ের মাত্র ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

যদিও সরকারি পরিসংখ্যানে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য এবং কাঁচা চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যকে শিল্পজাত পণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তথাপি এই দুই উপখাতের রপ্তানি আয়কে (যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৮২ এবং ১ দশমিক ০২ বিলিয়ন ইউএস ডলার) কৃষিপণ্যের তালিকায় যুক্ত করে বিবেচনা করলেও কৃষিপণ্য রপ্তানির মাধ্যমে মোট আয় দাঁড়ায় মাত্র ৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার, যা মোট দেশজ আয়ের মাত্র ৮ শতাংশ। 

সুতরাং উপরিউক্ত বিশ্লেষণে এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে রপ্তানি আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। অপর দিকে বিশ্বের ১০টি প্রধান কৃষিপণ্য রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় এশিয়ার চারটি দেশ রয়েছে। এখানেও শীর্ষে আছে চীন, যার রপ্তানি আয় প্রায় ৭৩ বিলিয়ন ডলার, ইন্দোনেশিয়া ৩৯ বিলিয়ন ডলার, থাইল্যান্ড ও ভারত যথাক্রমে ৩৬ ও ৩৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এই দেশগুলোর চেয়ে কত পিছিয়ে আছে, তা সুস্পষ্ট। অথচ কৃষি প্রবৃদ্ধি বা মোট দেশজ জিডিপিতে কৃষির অবদান বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশ উল্লিখিত দেশগুলোর তুলনায় যথেষ্ট এগিয়ে।

এই পরিস্থিতিতে কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের করণীয় কী? দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় এটাই স্বাভাবিক যে অব্যাহতভাবে কৃষিজমি অকৃষি খাতে ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় জিডিপিতে কৃষির অবদান দিন দিন কমবে এবং শিল্প ও সেবা খাতের অবদান বাড়বে। তা ছাড়া আমাদের কৃষিপণ্যের অভ্যন্তরীণ বাজার বেশি, আন্তর্জাতিক বাজার সীমিত। কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক এবং অনেক কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এতে দেশ প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানির মাধ্যমে শতভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুফল পায় না।

তাই দেশের কৃষিজ জিডিপির পরিধি বাড়াতে হলে কৃষক পর্যায়ে মানসম্পন্ন উচ্চমূল্য ফসলের উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং অধিক মূল্য সংযোজন করে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হবে। মূল্য সংযোজন করার ক্ষেত্রে কাঁচামালের আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশেই সেগুলোর উৎপাদন ও পর্যাপ্ত জোগান নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের কৃষি আজ উৎপাদন পর্যায়ে বেশ স্বাবলম্বী। অনেক মৌসুমি ফসল এখন উদ্বৃত্ত উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু উত্তম কৃষিপদ্ধতি এবং আধুনিক প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার অভাবে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না। অপর্যাপ্ত সংরক্ষণব্যবস্থা, অদক্ষ কৃষিবাজার, সীমিত বৈদেশিক চাহিদা, প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের অভাব ইত্যাদি কারণে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের উল্লেখযোগ্য অংশ দেশের কৃষি জিডিপির আয়তন বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারছে না। 

কৃষি জিডিপির আয়তন বাড়াতে হলে উত্তম কৃষিপদ্ধতির দিকে নজর দিতে হবে। এর জন্য কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণের বিকল্প নেই। সম্প্রসারিত বাজারে প্রবেশ করতে হলে প্রয়োজন কৃষক পর্যায়ে রপ্তানিযোগ্য নিরাপদ ফসল উৎপাদন এবং শিল্প পর্যায়ে অধিক মূল্য সংযোজিত কৃষিপণ্য উৎপাদন। এটা এককভাবে সরকারি পর্যায়ে সম্ভব নয়, বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে উৎপাদন করতে হবে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্য।

কিন্তু বৃহৎ কৃষি খাতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের ভিত্তিতে শিল্পকারখানার বড় অভাব। তাই এই কৃষিপ্রধান দেশের অর্থনীতির কাঠামো মজবুত ও টেকসই করতে হলে ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের শিল্প খাতে বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে বিনিয়োগে কেন্দ্রীভূত না থেকে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণশিল্পে আরও বিনিয়োগে আগ্রহী হতে হবে। 

শেখ মো. বখতিয়ার বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান