বাজেটে জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি

>সরকারি ব্যয়ে চিকিৎসা খাতে কোনো বৈদেশিক ব্যয় নয়, অর্থাৎ ১০০ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব। এটা স্বাস্থ্য খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনবে। সরকারের উন্নয়ন বা অনুন্নয়ন যেকোনো বাজেট থেকেই যানবাহন ক্রয়ের ওপর এক বছরের নিষেধাজ্ঞা জারি করা। সরকারি খরচে বিদেশে ভ্রমণ ব্যয় ৮০ শতাংশ কমানো যেতে পারে। বৈঠক, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের ক্ষেত্রে ভিডিও কনফারেন্স বা ওয়েবিনারের মাধ্যমে অংশগ্রহণ উৎসাহিত করা। মন্ত্রী, সচিবসহ প্রজাতন্ত্রের সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আধিকারিকের বেতন ও ভাতাদির ৩০ শতাংশ হ্রাস করা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি থেকে ৩০ শতাংশ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেওয়া। বাকি ৭০ শতাংশ প্রকল্পের ব্যয় ৩০ শতাংশ হ্রাস করা।

কোভিড-১৯ মহামারিতে পরিবর্তিত বৈশ্বিক ও দেশীয় বৈরী জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতাটি বিশেষ আগ্রহের সঙ্গে পড়েছি।

বাজেট বক্তৃতায় যা আছে

সামষ্টিক অর্থনীতি বিষয়ে বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, বর্তমান অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হবে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে তা বেড়ে হবে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার হবে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। বর্তমান অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ২৯ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা হ্রাস করে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা এবং রাজস্ব ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ২১ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা হ্রাস করে ৫ লাখ ১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমান অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয় ৯ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা হ্রাস করে ১ লাখ ৯২ হাজার ৯২১ কোটি টাকায় পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়াবে।

আগামী অর্থবছরে বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা এবং রাজস্ব ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে, বাজেট ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে জিডিপির ৬ দশমিক শূন্য শতাংশে দাঁড়াবে।

কোভিড–পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় চারটি কৌশলের কথা বলা হয়েছে: এক. বিলাসবহুল ব্যয় পরিহার ও অগ্রাধিকারভিত্তিক সরকারি ব্যয়ের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি। দুই. শিল্প ও ব্যবসার জন্য রেয়াতি সুদে ঋণ প্রদান। তিন. সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সম্প্রসারণ করে মহামারির কারণে অনানুষ্ঠানিক খাতের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা প্রদান। চার. মূল্যস্ফীতির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি।

কর প্রস্তাবগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো করমুক্ত ব্যক্তির আয়ের সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা নির্ধারণ ও করপোরেট করের হার ৩৫ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ। এর ফলে ব্যক্তির হাতে ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে নগদ সরবরাহ কিছুটা বাড়বে। এ ছাড়া মানি লন্ডারিং মোকাবিলায় আয়কর আরোপের অস্পষ্ট প্রস্তাব করা হয়েছে।
গতানুগতিক অপ্রত্যক্ষ কর প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে মোবাইল ফোন ব্যবহার ও তামাকজাত পণ্যের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ। এর মধ্যে প্রথমটির আপতন দরিদ্র মানুষের ওপর বেশি হবে।
ব্যয় প্রস্তাবগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্বাস্থ্য খাতের জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ এবং আপৎকালীন ব্যবহারের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা। এ ছাড়া বাজেটে ইতিপূর্বে ঘোষিত সামাজিক সুরক্ষা সহায়তাও ব্যবসা ও শিল্পের জন্য প্রণোদনার উল্লেখ আছে।

বাজেটে উল্লিখিত লক্ষ্যমাত্রার বাস্তবতা

প্রতিবেশী দেশ ভারত, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশে বর্তমান বছরে ঋণাত্মক অথবা যৎসামান্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে বলে সেসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংকও কদিন আগে বর্তমান অর্থবছরে ৩ দশমিক ৮ ও আগামী অর্থবছরে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করেছিল। হঠাৎ কোন তথ্যের ভিত্তিতে তা বেড়ে বর্তমান অর্থবছরে ৫ দশমিক ৫ ও আগামী অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়াল, তা বোধগম্য নয়।

করোনাভাইরাস–জনিত লকডাউন ও ব্যবসায় শ্লথগতি অব্যাহত থাকায় বর্তমান বছরের পুনর্নির্ধারিত ও আগামী বছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এর ফলে বাজেট ঘাটতি বর্তমান অর্থবছরে জিডিপির ৬-৭ শতাংশ এবং আগামী অর্থবছরে ৭-৮ শতাংশে বাড়তে পারে, যা মূল্যস্ফীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। উল্লেখ্য, একশ্রেণির ব্যবসায়ী নেতৃত্ব কিছুদিন ধরেই বাজেট ঘাটতির সুবিবেচনাপ্রসূত সীমা (জিডিপির ৫ শতাংশ) তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে।

বাজেট বক্তৃতায় যা নেই

বর্তমান অর্থবছরের বাজেটের প্রেক্ষিতটি সাদামাটা ভাষায় এ রকম। করোনাভাইরাসের কারণে অপ্রত্যাশিত ব্যয় বাড়বে এবং অর্থনীতির ধীরগতির কারণে রাজস্ব আয় কমবে। তাই বাজেটের প্রধান কৌশল হতে হতো কৃচ্ছ্রসাধন। আমরা জানি, সারা দেশের সাধারণ মানুষ নানা ধরনের কৃচ্ছ্র, এমনকি কম খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। সরকারের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হবে কেন? কথা উঠবে, সরকার কৃচ্ছ্রসাধন করলে তো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। জবাবে বলা যায়, এ মুহূর্তের অগ্রাধিকার প্রবৃদ্ধি নয়, বরং মানুষের জীবন বাঁচানো এবং অর্থনীতি যাতে খাদে না পড়ে যায়, তা নিশ্চিত করা। কিন্তু কৃচ্ছ্রসাধন বলা যতটা সহজ, কার্যকর করা ততটা নয়। সম্ভবত তাই অর্থমন্ত্রী সে পথ না মাড়িয়ে সহজ পথ বেছে নিয়েছেন। কৃচ্ছ্র শুরু হতে হবে মাথা থেকে। জনগণ বাজেটে নিম্নরূপ কৃচ্ছ্র আশা করেছিল।

১০০ শতাংশ হ্রাস: সরকারি ব্যয়ে চিকিৎসা খাতে কোনো বৈদেশিক ব্যয় নয়। এটা স্বাস্থ্য খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনবে। সরকারের উন্নয়ন বা অনুন্নয়ন যেকোনো বাজেট থেকেই যানবাহন ক্রয়ের ওপর এক বছরের নিষেধাজ্ঞা জারি করা। ৮০ শতাংশ হ্রাস: সরকারি খরচে বিদেশে ভ্রমণ ব্যয় ৮০ শতাংশ হ্রাস করা যেতে পারে। বৈঠক, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের ক্ষেত্রে ভিডিও কনফারেন্স বা ওয়েবিনারের মাধ্যমে অংশগ্রহণ উৎসাহিত করা। ৩০ শতাংশ হ্রাস: মন্ত্রী, সচিবসহ প্রজাতন্ত্রের সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আধিকারিকের বেতন ও ভাতাদির ৩০ শতাংশ হ্রাস করা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি থেকে ৩০ শতাংশ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেওয়া। বাকি ৭০ শতাংশ প্রকল্পের ব্যয় ৩০ শতাংশ হ্রাস করা। বিশ্ববাজারে কম মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানি তেলের দাম ৩০ শতাংশ হ্রাস করা। এর ফলে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ও করব্যবস্থাবহির্ভূত ব্যক্তি ও প্রণোদনাবহির্ভূত ব্যবসায়ীরা উপকৃত হতেন। ফলে পরিবহন ভাড়া বাড়াতে হতো না। সার্বিক অর্থনীতি একটি কার্যকর প্রণোদনা লাভ করত।

কয়েকটি সুপারিশ

এক. মেগা প্রকল্প আসক্তি থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর অগ্রাধিকার স্থির করে কোনোটি স্থগিত ও কোনোটি বাতিল করতে হবে। একবার প্রকল্প নিলেই তা স্থগিত বা বাতিল করা যাবে না, এমন কোনো নীতি নেই। উদাহরণস্বরূপ, বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এ খাতের কোনো কোনো প্রকল্প স্থগিত বা বাতিল করলে তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

দুই. করোনাভাইরাস–পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেখা গেছে যে আমাদের ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সঞ্চয় অত্যন্ত কম। তাই সংকট শুরুর এক সপ্তাহ না যেতেই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সাহায্যের জন্য সরকারের দ্বারস্থ হতে দেখা গেছে, যার মধ্যে আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পও রয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবার জন্য কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ডের মতো বিষয়ে ভাবা প্রয়োজন। বাজেটে তার উল্টোটা, অর্থাৎ ব্যাংক আমানতের ওপর মূসক বৃদ্ধি করা হয়েছে।

তিন. সম্প্রতি দেখা গেছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল প্রধানত রাজনীতি–সংশ্লিষ্টরাই পেয়েছেন। রাজস্ব আয় বাড়াতে হলে এঁদের করজালের আওতায় আনতে হবে। তাই ইউনিয়ন থেকে সংসদ পর্যন্ত সব জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের কমিটির সদস্যদের জন্য করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর বাধ্যতামূলক করা যায়।

চার. প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ বি এম আবদুল্লাহ সম্প্রতি বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি বন্ধ না হলে বাজেট বাড়িয়ে লাভ নেই। এ জন্য স্বাস্থ্য খাতে ক্রয়কে আলাদা করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও চিকিৎসকেরা প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও যন্ত্রপাতির মান নির্ধারণ করবেন এবং তা বুঝে নেবেন। একটি স্বতন্ত্র সংস্থা ক্রয় ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে।

একটি হতাশা ও একটি দুঃখ

দীর্ঘ ১৩৬ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতায় কোভিড ও করোনাভাইরাস শব্দ দুটি ৬২ ও ৩৬ বার ব্যবহার করা হলেও এর ফলে দেশে উদ্ভূত জনস্বাস্থ্য ও আর্থিক পরিস্থিতির কোনো বিশ্লেষণ নেই। অথচ একটি সুলিখিত ৫০ পৃষ্ঠার বক্তৃতাতেই তা করা যেত। যেমনটি আছে অন্যান্য দেশের অর্থমন্ত্রীদের বক্তৃতায়। দুঃখের বিষয়, করোনাভাইরাস টেস্টিং, হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে যেতে ও সেখানে অক্সিজেন, আইসিইউ, চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবীদের স্বল্পতার কারণে রোগী ও তাদের স্বজনদের ভোগান্তি ও অপমৃত্যুর জন্য সামান্য সমবেদনাটুকুও বাজেট বক্তৃতায় নেই। এ জন্য আমি অর্থমন্ত্রীকে দায়ী করব না। কারণ, জবাবদিহি আমাদের সংস্কৃতিবিরুদ্ধ।

এম ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ