হঠাৎ সাহসী নেপাল

সাতটি দেশের সঙ্গে ভারতের স্থলসীমানা রয়েছে। এর মধ্যে চীন ও পাকিস্তান সীমান্তে স্থায়ীভাবে অশান্তির আগুন জ্বলছে। বাংলাদেশ সীমান্তে ভূমিবিরোধ নেই বটে, তবে বেসামরিক মানুষের রক্ত ঝরে হামেশা। নেপাল সীমান্ত এসব বিবেচনায় ভারতের জন্য কিছুটা স্বস্তির ছিল। তবে সেই স্বস্তিও হুমকিতে পড়েছে। নেপালি রক্ষীদের গুলিতে সর্বশেষ একজন ভারতীয় শ্রমিক মারা গেলেন। সংখ্যার বিচারে এই মৃত্যু নগণ্য হলেও উভয় দেশের চলমান সীমান্ত উত্তেজনার গভীরতায় বিষয়টি পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য উদ্বেগের।

‘নেপাল লক্ষণরেখা অতিক্রম করেছে’
নেপাল-ভারত সীমান্ত প্রায় ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার। সীমান্তের কিছু এলাকার মালিকানা নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে বিবাদ ছিল। নেপালের একেবারে উত্তর-পশ্চিম সীমানার শেষ বিন্দু ‘কালাপানি’ এলাকা এ রকম এক বিবাদিত অঞ্চল। তারপরও ভারত-নেপাল সীমান্ত এশিয়ার অন্যতম শান্ত এবং উন্মুক্ত সীমান্ত ছিল।

সর্বশেষ উত্তেজনা শুরু হয়, যখন গত বছর ভারত তার নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র প্রকাশ করে। যেখানে বিতর্কিত কালাপানি এলাকাকে তাদের উত্তরাখন্ডের পিথোরাগড় জেলার অন্তর্ভুক্ত দেখানো হয়। এরপর গত ৮ মে একই এলাকার লিম্পুলেখে ভারত প্রায় ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটা সড়ক নির্মাণ শুরু করলে নেপাল আপত্তি তোলে তাতে। এই সড়কের অন্তত ১৭ কিলোমিটার তাদের এলাকায় পড়েছে বলে নেপালের দাবি। ভারত এই আপত্তি অগ্রাহ্য করে। নেপাল তাতে অচিন্তনীয়ভাবে জবাব দেয়। ক্ষুব্ধ নেপাল পুরো কালাপানি তাদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত দেখিয়ে জাতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে সেটা অনুমোদন করিয়ে নিয়েছে এ সপ্তাহে।

নেপালের তরফ থেকে ভারতের জন্য এটা একটা অবিশ্বাস্য বার্তা। ভারতের কয়েকটি প্রচারমাধ্যম এও বলছে: ‘নেপাল লক্ষণরেখা অতিক্রম করেছে।’

সীমান্তবিরোধ: কার দাবি কতটা যৌক্তিক
নেপালের নতুন মানচিত্রকে ভারত ইতিমধ্যে ‘অগ্রহণযোগ্য’ হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ভারত বলছে, বিতর্কিত যে এলাকা নেপাল নিজের দাবি করেছে, তার পক্ষে ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ নেই। কিন্তু নেপাল বরাবরই কালাপানি তাদের এলাকা জেনে এসেছে। নেপালের দাবি ঐতিহাসিকভাবেই এলাকাটি তাদেরই। আবার ব্রিটিশদের সঙ্গে ১৮১৬-এর ঐতিহাসিক চুক্তিও তার সপক্ষে সাক্ষ্য দেয়।

দক্ষিণ এশিয়ার সব সীমান্তবিরোধই মূলত ঔপনিবেশিক শাসনামলের একধরনের ঐতিহাসিক জের। নেপাল-ভারত সীমান্তও এর ব্যতিক্রম নয়। নেপাল ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল না। কিন্তু যে সীমান্ত নিয়ে বর্তমান বিরোধ, তার সৃষ্টি ব্রিটিশদের সঙ্গে নেপালিদের ১৮১৬ সালের চুক্তি থেকেই। ওই চুক্তিতে স্থানীয় কালী নদীকে উভয় দেশের সীমান্ত ধরা হয়েছিল। তাতে ৩৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কালাপানি নেপালের হওয়ার কথা।

ভারতীয়রা বলছেন, ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি কালীর শাখা নদী লিম্পিয়াধৌরাকে মূল নদী ধরে ভুল করেছিল এবং ১৮৭৯ সালে অপর এক জরিপের মাধ্যমে এই ভুল সংশোধনও হয়ে গেছে। নেপালের পূর্ববর্তী শাসকেরা সেটা জানতেন। ফলে কালাপানি আসলে ব্রিটিশ আমল থেকে ভারতেরই। এমনকি চীন তিব্বত দখলের পর ভারত এই অঞ্চলে ১৭ থেকে ১৮টি সামরিক ফাঁড়ি স্থাপন করেছিল বলেও রেকর্ড দেখানো হচ্ছে নয়াদিল্লির তরফ থেকে। এসব ফাঁড়ি স্থাপনের সময় নেপালের তরফ থেকে কোনো প্রতিবাদ ছিল না। তাদের জ্ঞাতসারেই এটা করা হয়।

ভারতের এসব দাবি সত্য। আবার এও সত্য, ওই সব সামরিক চৌকির অনেকগুলোই ১৯৬৯ সালে তখনকার নেপালি শাসকদের অনুরোধে প্রত্যাহারও হয়। তবে প্রত্যাহার করা এসব চৌকির তালিকায় কালাপানি ছিল না। এও ভারতের একটা যুক্তি। তার উত্তরে নেপাল বলছে, রাজা মহেন্দ্র তখন ভারতের অনুরোধে কালাপানির চৌকি রাখতে দিয়েছিলেন ভারতকে। এর অর্থ এই নয়, অঞ্চলটি ভারতের। বহুকাল থেকে এটা নেপালের দারচুলা জেলার অন্তর্ভুক্ত। এই জেলাটি এখন নেপালের ‘সুদূর-পশ্চিম’ প্রদেশের মধ্যে পড়েছে। এ পর্যায়ে ভারতের দাবি, ১৯৬১ সালে চীনের সঙ্গে নেপাল যে চুক্তি করেছে, তাতে কালাপানিকে ছাড় দিয়েই তার ‘সর্ব পশ্চিমের শেষ সীমানা’ (‘পিলার-ওয়ান’) চিহ্নিত করেছিল।

এসব দাবি–পাল্টা দাবি এবং তার বিশ্লেষণে ভারত ও নেপালের কূটনীতিবিদেরা এই মুহূর্তে মহাব্যস্ত। তবে নেপালের সঙ্গে আগে আলোচনা না করে কেন বিরোধপূর্ণ এলাকায় এত বড় প্রকল্প নেওয়া হলো,Ñসে বিষয়ে ভারতে কেউ ক্ষমতাসীনদের প্রশ্ন তোলার সাহস দেখাচ্ছে না। স্পষ্টত, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সর্বত্র কূটনীতিক দূরদর্শিতার শূন্যতাকে জাতীয়তাবাদী আবেগ দ্বারা পূরণের চেষ্টা চালু হয়েছে।

বিরোধে চীনের ভূমিকা কতটা?
নেপালের সঙ্গে ভারতের বিবাদ চলেছে যে এলাকা নিয়ে, সেটা একই সঙ্গে চীনেরও সীমান্ত। কালাপানির ‘লিম্পুলেখ পাস’ তিব্বতের সঙ্গে যুক্ত। বলা যায় ত্রিদেশীয় একটা সংযোগস্থল এটা। হিমালয়ের এই স্থানটির কৌশলগত গুরুত্ব অনেক। সন্দেহ তৈরি হয়েছে, এই বিবাদে চীনের কোনো ইন্ধন আছে কি না। এই সন্দেহের কারণ নেপালের হঠাৎ সৃষ্ট শক্ত অবস্থান। ভারতের বিবেচনায়, চীনের পরোক্ষ ইন্ধন ছাড়া নেপালের নেতৃত্ব ভূমিবিরোধে এত সাহসী অবস্থান নিতে পারত না।

ভারতের এই অনুমান একদম অমূলক নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীন-নেপাল সম্পর্ক ক্রমে কেবল উন্নতি হচ্ছে। চীন ইতিমধ্যে নেপালে বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রধান দেশে পরিণত হয়েছে। ২০১৬ সালের এক চুক্তিবলে স্থলবন্দী নেপাল চাইলে চীনের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারে এখন, যা নেপালের ভারতীয় বন্দরনির্ভরতা কমাতে পারে। নেপালে একটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর গড়ছে চীন। ২০০৭ থেকে তারা তিব্বতের লাসা থেকে নেপাল সীমান্ত পর্যন্ত ৭৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ তৈরি শুরু করেছে। এসবই নেপাল-চীন বিকাশমান ভূকৌশলগত সম্পর্কের স্মারক, যা ভারতের ওপর নেপালের পুরোনো নির্ভরতা ধীরে ধীরে কমাচ্ছে।

তবে ভারতকে অবজ্ঞা করারও সুযোগ নেই নেপালের। প্রায় ১০ লাখ নেপালি প্রতিবেশী ভারতে বিভিন্ন কাজে যুক্ত। এ ছাড়া দেশটির রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে ভারতের রয়েছে ঐতিহাসিক প্রভাব। ফলে নেপালের বর্তমান শাসকদের পক্ষে চীনের ইন্ধনে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খুব খারাপ করার ঝুঁকি নেওয়া আত্মঘাতী হবে। বরং দুই বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের রাস্তা খুঁজে পাওয়াই তার জন্য যথোপযুক্ত। তারপরও যে নেপাল কালাপানি নিয়ে ভারতের জন্য বিস্ময় তৈরি করতে পারল, তার বড় এক কারণ দেশটির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি।

নেপালের পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনে ১০ জুন যখন নতুন মানচিত্র অনুমোদন হয়, তখন ২৭৫ জন সদস্যের মধ্যে ২৫৮ জনই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। একজন জনপ্রতিনিধিও প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেননি। সপক্ষে ভোটদাতাদের মধ্যে ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে বিবেচিত নেপালি কংগ্রেস দলের ৬৩ জন সদস্যের অনেকেও রয়েছেন। ভোটের এই অঙ্ক বলে দেয়Ñবিষয়টিকে ঘিরে জাতীয়তাবাদী আবেগ প্রবলভাবে যুক্ত হয়ে গেছে সেখানে। দেশটির নাগরিক সমাজের তরফ থেকে কেপি শর্মা অলি সরকারের ওপর সীমান্তবিরোধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার জন্য চাপ ছিল।

সামাজিক এই চাপের কারণ রয়েছে। ২০১৫ সালে নতুন সংবিধান তৈরির সময় ভারত কয়েক মাস অবরোধ দিয়ে ফেলে রেখেছিল নেপালকে। এতে সাধারণ নেপালিদের জ্বালানিসংকটে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। নেপাল বরাবরই জ্বালানি আমদানির জন্য ভারতের ভূমি ব্যবহার করে। অবরোধের ফলে নেপাল কার্যত অচল হয়ে যায় তখন। কয়েক মাস পর এই অবরোধ শিথিল করা হলেও এরপর থেকে ভারতীয় শাসকদের সম্পর্কে সাধারণ নেপালিদের মধ্যে একরূপ স্থায়ী আস্থাহীনতা তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক স্বার্থের জায়গা থেকে ভারতের জন্য নেপাল এখনো জরুরি এক প্রতিবেশী হয়েই আছে। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে উত্তেজনার কারণে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের প্রভাবের বলয় অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে।

ফলে নেপালের সঙ্গে সৃষ্ট উত্তেজনা প্রশমনে ভারতকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। ভারতের এই কূটনীতিক ভবিতব্যই হয়তো নেপালকে সাহসী করে তুলেছে চলতি লড়াইয়ে। নেপালের নতুন মানচিত্র পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে অনুমোদন এবং প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরের আগেই ভারতকে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হবে। নেপালের শাসকজোটের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা পুষ্প কুমার দাহাল প্রচণ্ড সেই আলোচনারও ডাক দিয়েছেন।

নেপালের নতুন মানচিত্রসংক্রান্ত বিলটিতে প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর হয়ে গেলে তা নেপালের সংবিধানের অংশ হয়ে যাবে। তখন কোনো সরকারের পক্ষে এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে আপস-আলোচনা রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হবে। ফলে দ্রুতই কাঠমান্ডুকে শান্ত করার দায় তৈরি হয়েছে ভারতের জন্য। যদিও নেপালের রাজনীতিবিদদের শান্ত করা ভারতের জন্য যতটা সহজ, দেশটির জনগণের মন জয় ততোধিক কঠিন হয়ে গেছে। পাঁচ দশক আগের নেপাল এবং আজকের নেপাল মানসিকভাবে প্রায় ভিন্ন দেশ।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক