পুলিশের গোপন তথ্য ফাঁসের তদন্তে সাংবাদিক হয়রানি নয়

করোনাকালে পুলিশ জনগণকে সেবা দেওয়ায় মানুষের প্রশংসা, সমর্থন পেয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ (যাঁরা পুলিশের সমালোচনা করতেন, তাঁরাও আজ পক্ষে বলছেন, ইত্তেফাক, ১৫ জুন ২০২০)। তাঁর এই কথায় কিছুটা সত্যতা যে আছে, তা মানতেই হয়। কিন্তু একই সঙ্গে এ কথাও বলতে হবে যে তাঁর কথায় তিনি পরোক্ষে স্বীকার করে নিয়েছেন এত দিন তাঁর বাহিনীর এ ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল।

কী কী কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছিল, মহামারির কালে সেই অপ্রিয় আলোচনা তুলতে চাই না। বরং বাহিনীটির যাঁরা দায়িত্ব পালনের সময়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই এবং যে কয়েক হাজার সদস্য অসুস্থ হয়েছেন, এখনো চিকিৎসাধীন, তাঁদের প্রতি সহানুভূতি ও দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। তবে এই সংকটকালেও তাঁদের যেসব পদক্ষেপ নিবর্তন বা হয়রানিমূলক এবং আইনসম্মত নয়, সেগুলোর বিষয়ে নীরব থাকা সম্ভব নয়। এ রকম একটি পদক্ষেপ, যাকে হয়রানি বা ভীতি প্রদর্শনও বলা চলে, তা হচ্ছে খবরের সূত্র জানার জন্য সাংবাদিকদের পুলিশের দপ্তরে তলব করা।

সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামের কাছে একজন সদ্য সাবেক যুগ্ম কমিশনার ইমাম হোসেনের ঘুষের অনৈতিক প্রস্তাবের বিষয়ে আইজিকে দেওয়া একটি চিঠির কথা বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলে শিরোনাম হয়েছে। আইজির কাছে ডিএমপি কমিশনারের লেখা ৩০ মের চিঠির বিষয়টি খবর হিসেবে প্রকাশ পায় ৫ জুন। একজন পদস্থ কর্মকর্তার অনৈতিক ও অপরাধমূলক কাজের খবর পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর, সন্দেহ নেই। সুতরাং, অপরাধের বিচারের বদলে পুলিশ কর্তাদের কাছে এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে অপরাধের তথ্য কীভাবে ফাঁস হয়েছে, তা খুঁজে বের করা। ইংরেজি প্রবাদ ‘শুটিং দ্য মেসেঞ্জার’ অনুসরণের মতো তাঁরা এখন বার্তা প্রদানকারীকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন। যে সাংবাদিকেরা খবরটি প্রকাশ করেছেন, তাঁদের এখন পুলিশি তদন্ত কমিটি তলব করেছে। আগামীকাল ও পরশু ডিএমপি সদর দপ্তরে যুগ্ম কমিশনারের (অপরাধ) নেতৃত্বাধীন কমিটির সামনে হাজির হওয়ার জন্য অন্তত অর্ধডজন সাংবাদিককে চিঠি পাঠানো হয়েছে। একজনকে এরই মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলেও জানা যাচ্ছে।

পুলিশ এখনো এমন কোনো দাবি করেনি যে খবরটি মিথ্যা বা ভিত্তিহীন। বরং অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে ডিএমপি থেকে মহাপরিদর্শকের কার্যালয়ে বদলি করা হয়েছে। এই বাহিনীতে কারও বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘন ও অপরাধ করার অভিযোগ উঠলে তা তদন্তের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিকভাবে সাময়িক বরখাস্ত বা বিনা বেতনে ছুটিতে পাঠানোর মতো ব্যবস্থা নিতে প্রায় কখনোই দেখা যায় না। অন্য দপ্তরে বদলি বা দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহারই হচ্ছে ঊর্ধ্বতন কর্তাদের পছন্দ। আর বাহিনীর বাইরের কেউ এসব অভিযোগের তদন্ত করুক, তা তাঁরা হতে দিতে রাজি নন। অথচ অধিকাংশ গণতন্ত্রে এ ধরনের অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব পালন করে পুলিশ বাহিনীর বাইরের স্বাধীন প্রতিষ্ঠান—পুলিশ কমপ্লেইন্টস কমিশন বা স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি।

সাংবাদিকদের কাছে পাঠানো চিঠিতে ‘গোপন পত্রের তথ্যাদি’ প্রকাশের বিষয়ে ‘সুষ্ঠু অনুসন্ধানের নিমিত্তে’ নির্ধারিত সময়ে হাজির হতে বলা হয়েছে। গোপন তথ্য কীভাবে প্রকাশ পেল, সে বিষয়ে পুলিশ বাহিনী অভ্যন্তরীণ তদন্ত করতেই পারে। তাতে আমাদের আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু সেই তদন্তে সাংবাদিকদের তলব করা এবং জিজ্ঞাসাবাদের পদক্ষেপ স্পষ্টতই পুলিশের আইনবহির্ভূত ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ছাড়া অন্য কিছু নয়। প্রথমত, পুলিশের এত উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতির অভিযোগের জনস্বার্থ-সম্পর্কিত গুরুত্ব অপরিসীম। সুতরাং, খবর হিসেবে ওই তথ্য প্রকাশের যৌক্তিকতা প্রশ্নাতীত। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকেরা পেশাগত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন ছাড়া কোনো অপরাধ করেননি। সুতরাং, তাঁদের কোনো ধরনের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা ভীতি প্রদর্শনের চেষ্টা ও হয়রানি বৈ অন্য কিছু নয়।

দ্বিতীয়ত, দেশের প্রচলিত আইনে সাংবাদিকদের কাছে তথ্যের সূত্র জানতে চাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। সূত্রের গোপনীয়তা রক্ষা একজন সাংবাদিকের মৌলিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা বিষয়ে তদারকিমূলক অথবা আইনগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া আছে যে প্রতিষ্ঠানকে, সেটি হচ্ছে প্রেস কাউন্সিল। এমনকি, সেই প্রতিষ্ঠানটিকেও বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯৭৪-এ তথ্যের সূত্র জানতে চাওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘনের সম্ভাব্য অভিযোগ তদন্ত ও বিচারের বিধানগুলো ওই আইনের ১৩ ধারায় বিস্তারিত আছে। সেই ১৩-এর ২ উপধারায় স্পষ্ট করা বলা আছে, কোনো সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা, সম্পাদক ও সাংবাদিককে প্রকাশিত তথ্যের সূত্র প্রকাশে বাধ্য করা যাবে না। ১৩-এর ৩ ধারায় বলা আছে, কাউন্সিলের তদন্ত ও বিচারকাজ বিচারিক কার্যক্রম হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং, বিচারিক কার্যক্রমে যা নিষিদ্ধ, সে রকম কিছু দেশের অন্য কোনো সংস্থার জন্য বৈধ হতে পারে না।

এই বাস্তবতায় আমাদের প্রত্যাশা, ডিএমপি সাংবাদিকদের তদন্তে হাজির হওয়ার যে চিঠি দিয়েছে, তা প্রত্যাহার করে নেবে। সাংবাদিকদের বৈশ্বিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স, আরএসএফ মাত্র গেল সোমবার বিশ্বজুড়ে করোনাকালে সাংবাদিকতার জন্য নিগৃহীত ৩০ জন সাংবাদিককে করোনাকালের তথ্য-নায়ক হিসেবে ঘোষণা করেছে, যাঁদের মধ্যে দুজন বাংলাদেশি। একজন হলেন কার্টুনিস্ট কিশোর, যাঁকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক রাখা হয়েছে। অপর বাংলাদেশি সেলিম আকাশ অবশ্য আটক আছেন জর্ডানে মহামারির সময়ে লকডাউনে প্রবাসীদের জীবন কীভাবে কাটছে, সেই খবর দেওয়ার অভিযোগে।

সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে প্রায় দুই মাসের অজ্ঞাতবাসের পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক রাখার বিষয়েও দেশের ভেতরে-বাইরে প্রতিবাদ অব্যাহত আছে। দেশের আরও কয়েকটি জেলায় কথিত মানহানির মতো ঠুনকো অভিযোগে আটক হয়ে আছেন আরও বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। মুক্ত গণমাধ্যমের বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫১ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে। আশা করি, মহামারির কালে পুলিশ বাংলাদেশকে শীর্ষ সাংবাদিক নিপীড়ক দেশে রূপান্তরের পথে ঠেলে দেবে না।

কামাল আহমেদ
, সাংবাদিক