করোনা ও ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিত

পরিযায়ী শ্রমিকেরা ঘরে ফেরার জন্য অপেক্ষায় আছেন। দিল্লির কাছে নয়ডায়। (রয়টার্সের ফাইল ছবি)
পরিযায়ী শ্রমিকেরা ঘরে ফেরার জন্য অপেক্ষায় আছেন। দিল্লির কাছে নয়ডায়। (রয়টার্সের ফাইল ছবি)

কোভিড–১৯–এর বিপর্যয়ের আঁচ গোটা বিশ্বের ওপরেই পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবজাতির ওপর এমন বিপর্যয় আর আসেনি। এই মহাপ্রলয়কে মোকাবিলার উদ্দেশ্যে ভারত সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতোই লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অত্যন্ত অপরিকল্পিতভাবে, মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে ভারতের মতো একটি জনবহুল দেশে এই লকডাউনের সিদ্ধান্ত করোনা বিপর্যয়ের পাশাপাশি মানুষের জীবন–জীবিকাকে চরম সংকটে ফেলে দিয়েছে। এই সংকটই ভারতীয় সমাজে অত্যন্ত জটিল এক সামাজিক সংকটের ও অবতারণা করেছে।

ভারত সরকারের পরিচালক আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। হিন্দু-মুসলমানের ভেতর আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক বিরোধকে চরম বিদ্বেষে রূপান্তরিত করে ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে বিজেপি। দ্বিতীয় দফায় তারা ক্ষমতায় আসার পর আরএসএস নির্ধারিত ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ স্থাপনই এখন তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির ধ্যানজ্ঞান। এই লক্ষ্যেই এনআরসি, সিএএ, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০,৩৫ এ ধারার অবলুপ্তি।

২০১৯ সালের শেষ দিক থেকে আন্তর্জাতিক দুনিয়াতে করোনাজনিত বিপদকে ঘিরে সতর্কবার্তা উচ্চারিত হয়েছে। ভারতে না কেন্দ্রীয় সরকার, না কোনো অঙ্গ রাজ্যের সরকার আসন্ন বিপদ ঘিরে এতটুকু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন করোনা রোগীর সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে, এমন একটা সময়ের ভেতরেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তাঁর নিজের রাজ্য গুজরাটে জামাই আদর করে সংবর্ধনা দিয়েছে। এ উপলক্ষে ব্যাপক জনসমাগম ঘটেছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন করোনা মোকাবিলার উদ্দেশ্যে লকডাউন শুরু হয়ে গেছে, তখনও ভারত সরকারের ভেতরে তেমন কোনো হেলদোল দেখা যায়নি। কারণ মধ্যপ্রদেশে নির্বাচিত সরকারকে ফেলে বিধায়ক কেনাবেচার ভেতর দিয়ে বিজেপি তখন সেই রাজ্যে সরকার তৈরিতে ব্যস্ত ছিল।

মধ্যপ্রদেশে কার্যত আইনসভাকে এড়িয়ে নিজেদের দলের সরকার তৈরির পর দেশের নাগরিকদের খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান, পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা, কোনো কিছুর চিন্তা না করে, মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে লকডাউন ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। তার আগে অবশ্য ‘জনতার কারফিউ’ নামক একটা অবাস্তব, অবৈজ্ঞানিক কর্মসূচি ভারতের জনগণের ওপরে চাপিয়ে দিয়েছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। জনতার কারফিউ—এ ঘটনাক্রমের নাম করে শাঁখ বাজানো, হাততালি দেওয়া, বাসনকোসন বাজানো, এরপর নিষ্প্রদীপ রাখা—এমন বেশ কিছু অবৈজ্ঞানিক, উদ্ভূতুড়ে কর্মসূচির আড়ালে নরেন্দ্র মোদি নিজের এবং তাঁর দল বিজেপির জনসমর্থন মাপার চেষ্টা করে গিয়েছে।

মোদি প্রশাসন একদিকে অপরিকল্পিত লকডাউনের ভেতর দিয়ে আপামর ভারতবাসীকে একটা ভয়ংকর রকমের বিপদের ভেতরে ঠেলে দিচ্ছেন। সে রকম সময়েই মোদির দল বিজেপি এবং তাদের মস্তিষ্ক আরএসএস দিল্লির নিজামুদ্দিনে তবলিগ জামাত ঘিরে এই অতিমারিকে কেন্দ্র করে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচি, পোলারাইজেশনের রাজনীতিকে সর্বাত্মক করে তুলতে আত্মনিবেদিত।

করোনাজনিত লকডাউনকে ব্যবহার করে, নিজামুদ্দিনের ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে সামাজিক বিভাজনের ফসল, এই ক্রান্তিকালের সময়ে কেবল বিজেপিই একা ঘরে তোলেনি। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস, অন্ধ্র-তেলেঙ্গানার তেলেগু দেশম, ওডিশার বিজু জনতা দল, পাঞ্জাবের আকালি দলের মতো সংঘ-বিজেপির কখনো দৃশ্যমান, কখনো মেঘনাদের মতো আড়ালে থাকা বন্ধুরাও সেই ফসল ঘরে তুলেছে। এভাবেই তারা নিজেরা বলবান হতে চেষ্টা করেছে। বল জুগিয়েছে তাদের স্বাভাবিক মিত্র সংঘ-বিজেপিকে।

মধ্যপ্রদেশে সরকার তৈরির তাগিদে বিধায়ক কেনাবেচায় ব্যস্ত ভারতের শাসক দল বিজেপি কেন আন্তর্জাতিক দুনিয়াতে করোনা মহামারির আকারে দেখা দেওয়ার পরও লকডাউনের ঘোষণা করতে গড়িমসি করল? কেন ট্রাম্পকে তৈল মর্দনের উদ্দেশ্যে এত বিদেশি-দেশি মানুষের সমাগম ঘটাল গুজরাটে? অপরিকল্পিত লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের গোটা ভারতব্যাপী অবর্ণনীয় দুরবস্থার জন্য দায়ী কে?

পরীক্ষামূলকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে করোনাকালে সীমান্ত–বাণিজ্য শুরু করার ভাবনার পর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ‘এর ফলে জেহাদি বাড়বে’ বলেও মন্তব্য করেছেন। তাঁর কথার ভেতর দিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশের মানুষদের প্রতি চরম অসম্মান দেখানো হয়েছে। নিজামুদ্দিনের তবলিগ জামাতের ঘটনাকে বিজেপি রাজনৈতিক রং দিলেও সেই প্রচারের বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। এ নিয়ে বামপন্থীদের ভেতর প্রথম সরব হলেন অনলবর্ষী মোহাম্মদ সেলিম। সেলিম সামাজিক গণমাধ্যমে সরব হওয়ার প্রায় দেড় দিন পর তাঁর দল সিপিআইয়ের (এম) পলিটব্যুরো এ সম্পর্কে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিল। তারও পরে সোশ্যাল মিডিয়াতে মুখ খুললেন সীতারাম ইয়েচুরি।

হিন্দু-মুসলমানের ভেতরে সামাজিক বিভাজনটিকে ভারতীয় জনজীবনের প্রাত্যহিক অভ্যাসের ভেতরে একদম পার্থেনিয়ামের মতো ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে নিজামুদ্দিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিজেপি এই মুহূর্তে যে ধরনের সাফল্য পেয়েছে, তেমনটা তারা সাম্প্রতিক অতীতে পায়নি। লকডাউনজনিত সব রকমের সংকটের আবর্তকে নিজামুদ্দিনের ঘটনার মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমানের সংঘাতে আবদ্ধ করে দিতে পেরেছে। তাদের এই সাফল্যের সামাজিক বিস্তার ঘিরে দুটি ঘটনার উল্লেখ করছি।

সাবেক শাসক এক বামপন্থী দলের রাজ্য দপ্তরে কর্মরত এক কর্মী অকপটে বললেন, তাঁর আদি বাসস্থান আসামের সাপোটগ্রাম অঞ্চলে করোনাজনিত কোনো সমস্যাই ছিল না। নিজামুদ্দিনফেরত লোকদের কারণেই সেখানে করোনা এখন মহামারি।

বিশ্ব তো দূরস্থান, ভারতে কতজন মানুষ তবলিগের অনুরাগী—এই ভাবনার ধারেপাশে না গিয়ে বামপন্থী দলের ওই সর্বক্ষণের কর্মীটি তাঁর দেশ গাঁয়ে করোনা সংক্রমণে তবলিগ জামাত ফেরত মানুষদের, অর্থাৎ প্রকারান্তে গোটা মুসলমান সমাজকেই দায়ী করে বসলেন। একজন বামপন্থী বলে পরিচিত মানুষ পর্যন্ত এভাবে আরএসএসের সামাজিক প্রযুক্তির শিকার হয়ে এই অতিমারিকে কেন্দ্র করে কার্যত বিজেপির বিভাজনের রাজনীতিকে একদম মানুষের মনে গেঁথে দেওয়ার একজন নিঃশব্দ কর্মী হয়ে উঠছে। সংঘ-বিজেপির করোনাকালেও হিন্দু-মুসলমানের রাজনীতির এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ভারতের একটি অবিজেপি রাজনৈতিক দল এখনো পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছে না—এটা কেবল আগামী ভারতেরই দুর্ভাগ্য নয়, সামগ্রিকভাবে গোটা মানবজাতিরই দুর্ভাগ্য। কারণ, এই বিভাজনের বিষ কিন্তু আজ হোক, কাল হোক—বিনা পাশপোর্টে, বিনা ভিসাতে বাংলাদেশসহ সব প্রতিবেশী দেশগুলোকেই আক্রান্ত করবে।

*গৌতম রায়, পশ্চিমবঙ্গের গবেষক ও ইতিহাসবিদ