কৃষির সাফল্যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, কৃষক ও নারীর অবদান এবং তাঁদের অধিকারের সুরক্ষা

১৪ জুন ২০২০ প্রথম আলো ও এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) আয়োজিত ‘কৃষির সাফল্যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, কৃষক ও নারীর অবদান এবং তাঁদের অধিকারের সুরক্ষা’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম আলোর ডিজিটাল স্টুডিও থেকে সম্প্রচারিত সেই বৈঠকে অংশ নেওয়া আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।

যাঁরা অংশ নিলেন 

সাইফুজ্জামান চৌধুরী এমপি
মাননীয় মন্ত্রী, ভূমি মন্ত্রণালয়

 অধ্যাপক মইনুল ইসলাম
(একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ)
সাবেক অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

রাজা দেবাশীষ রায়
চাকমা সার্কেল চিফ 

 অধ্যাপক সাদেকা হালিম
ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 খুশী কবির
সমন্বয়কারী, নিজেরা করি;
চেয়ারপারসন, এএলআরডি।

 অধ্যাপক শফিক উজ জামান
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 শামসুল হুদা
নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি

 সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
প্রধান নির্বাহী, বেলা

 সঞ্জীব দ্রং
সাধারণ সম্পাদক,
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম

 রওশন জাহান মনি
উপনির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি

 সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

 সঞ্চালক

ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা 

আব্দুল কাইয়ুম

কোভিড-১৯–এর কারণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা এই গোলটেবিল বৈঠকটি করছি। কৃষিতে আমাদের বড় রকমের সাফল্য আছে। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ইতিমধ্যে সরকারের আগাম প্রস্তুতির জন্য হাওরাঞ্চলের ফসল আমরা তুলতে পেরেছি। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে কিছু ক্ষতি হয়েছে। গ্রামাঞ্চল, আদিবাসী ও পাহাড়ি অঞ্চলে কৃষির যে সমস্যা রয়েছে, তা সমাধান করা প্রয়োজন। তাহলে আরও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব। 

কৃষিতে মোট ১৮–১৯ ধরনের কাজ থাকে, যার ১৫–১৬টিই করেন নারী। কিন্তু সে কাজের স্বীকৃতিটুকু অনেক ক্ষেত্রে তিনি পান না। দেশের উন্নয়ন টেকসই করতে হলে কৃষিকে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে। বাজেটে কৃষি সুরক্ষার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কিন্তু এর সঠিক প্রয়োগ হওয়া প্রয়োজন।

ফিরোজ চৌধুরী
সূচনা বক্তব্যের পর এবার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য অনুরোধ করছি অধ্যাপক মইনুল ইসলামকে।

মইনুল ইসলাম

মইনুল ইসলাম
মইনুল ইসলাম

বাংলাদেশের কৃষি খাতে এক দশক ধরে একটা বিপ্লব চলেছে বলা হয়। জনসংখ্যার অত্যধিক ঘনত্ব, জমি-জন অনুপাতের অত্যল্পতা এবং চাষযোগ্য জমির ক্রমসংকোচন সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে এখন ধান-উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ধান উৎপাদন ছিল মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা তিন গুণের বেশি বেড়ে ৩ কোটি ৬২ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। ধান, গম ও ভুট্টা মিলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ১৩ লাখ টন। ৭০ লাখ টন আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ১ কোটি ৫ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। তরিতরকারি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। তরিতরকারি এবং হাঁস-মুরগির মাংস ও ডিম উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। গবাদিপশুর মাংস উৎপাদনে দেশ এখন চাহিদার প্রায় ৮৫-৯০ শতাংশ মেটাতে পারছে। অবশ্য বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে দুধ উৎপাদনে। এখনো আমরা অবশ্য ৫০–৫৫ লাখ টন গম আমদানি করি। একই সঙ্গে বিদেশ থেকে মসলাপাতি, ডাল ও ফল আমদানির জন্যও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে প্রতিবছর। তবু বলা যায়, কৃষি খাতে সাফল্যের ধারা প্রশংসনীয়।

বর্তমান সরকারের আমলে, প্রধানত সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর নিরলস নেতৃত্বে এই সাফল্যগাথা রচিত হতে শুরু করেছিল, যা বর্তমান কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছেন।

কৃষি খাতে অনেকগুলো ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, যার মধ্যে উচ্চফলনশীল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার, সেচব্যবস্থার আওতায় আসায় দেশের অধিকাংশ জমিতে বোরো চাষের সম্প্রসারণ, কৃষি খাতে যথাযথ ভর্তুকি প্রদান, কৃষিঋণ পদ্ধতির সহজীকরণ, ফসলের বহুধাকরণ, কৃষির লাগসই যান্ত্রিকীকরণ, উচ্চফলনশীল ফসল, তরিতরকারি, মাছ, হাঁস-মুরগি ও ফলমূল চাষের ব্যাপক প্রচলন, আধুনিক রাসায়নিক সার, বীজ ও কীটনাশকের সহজলভ্যতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসবের ফলে দেশে একটি কৃষিবিপ্লবের সূচনা হয়েছে।

কৃষিতে এখনো দেশের ৪১ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ কর্মরত। প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকেরা এখনো তাঁদের ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, বাম্পার ফসল হলে প্রায় প্রতিবছর ফসলের দামে ধস নামার পুরোনো সমস্যার ভালো সমাধান এখনো আমরা পাইনি।

কৃষিতে নারীর অবদান বাংলাদেশে এখনো একটি অবহেলিত বিষয়। কৃষিব্যবস্থা এ দেশে যেহেতু প্রধানত পারিবারিক উৎপাদন ও ভোগকেন্দ্রিক ‘কিষান উৎপাদন পদ্ধতির’ অধীনে রয়ে গেছে, তাই নারীদের শ্রম এই ব্যবস্থার প্রাণভোমরা হলেও পুরুষ-আধিপত্যাধীন সমাজের পরিবারে নারী এখনো অধস্তন অবস্থানের আপেক্ষিক মর্যাদাহীন অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। 

বাংলাদেশে ভূমি সংস্কার ইস্যুকে আর বিলম্বিত করা ঠিক হচ্ছে না। আমি মনে করি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ‘অপারেশন বর্গা’ ও ‘কেরালা মডেল’ থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, কৃষক ও নারীদের অধিকার সুরক্ষার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের এখনই সময়। 

এক্ষেত্রে মূল সুপারিশগুলো হচ্ছে: বর্গাদারদের ভূমিস্বত্বের নিরাপত্তা জোরদারকরণ এবং জবরদস্তিমূলক উচ্ছেদের আশঙ্কা নিরসন করা, গ্রামীণ ভিটেমাটিতে বসবাসরতদের দখলিস্বত্ব প্রদান, ভূমিহীন পরিবারগুলোকে বসতবাটির জন্য প্লট প্রদান, কোনো পরিবারকে আট হেক্টরের বেশি জমির মালিকানা রাখতে না দেওয়া, ভাগচাষি ও বর্গাদার কৃষকদের তাঁদের চাষকৃত জমির কার্যকর মালিকে পরিণত করা।

করোনা মহামারির এই সময়ে বলতে চাই, আমাদের কৃষির যে যে সংস্কার প্রয়োজন, তা করা গেলে কৃষির সাফল্য টেকসই অবস্থায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, কৃষক ও নারীর যে অবদান, তার যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারব এবং এই সংকট থেকে উত্তরণ ও কৃষির সাফল্যের এই ধারা অব্যাহত রাখতে পারব। (মূল প্রবন্ধের সংক্ষেপিত পাঠ)

রওশন জাহান মনি

রওশন জাহান মনি
রওশন জাহান মনি

এএলআরডি ১৯৯১ সাল থেকে ভূমি সংস্কার, খাসজমিতে ভূমিহীন ও দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষের অধিকার, আদিবাসী, নারী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠায় নীতিগতভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

জিডিপিতে কৃষি তৃতীয় অবস্থানে চলে গেলেও এখনো কৃষিতে নিয়োজিত জনশক্তি মোট জনসংখ্যার ৪০.৬ শতাংশ। অর্থনীতিতে কৃষির অবদান কমে এলেও সর্বোচ্চ জনশক্তি কিন্তু এখনো নিয়োজিত আছে কৃষি খাতে।

খাসজমি থাকার পরেও এখনো অনেক ভূমিহীন পরিবার খাসজমিতে বন্দোবস্ত পায়নি। সুনির্দিষ্ট কিছু প্রকল্পের অধীনে সীমিতসংখ্যক ভূমিহীন মানুষের আশ্রয়ের জন্য খাসজমি বন্দোবস্ত করা হলেও কৃষিজমি তাঁরা পাননি। নোয়াখালী ও দক্ষিণাঞ্চলের কিছু জায়গায় মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা এটা দেখেছি। স্বার্থান্বেষী প্রভাবশালী ভূমি দখলদারদের কারণে, আবার অপরিকল্পিত শিল্পায়নের জন্য অধিগ্রহণের ফলে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছেন পাহাড়-সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু, অসহায় দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ। পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়াতে পাহাড়ি বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই জমি ফেরত পায়নি। ফলে তারা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে।

সমতলের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে নতুন জরিপে অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জমি খাসজমি হিসেবে রেকর্ড হয়ে গেছে। জলমহাল বন্দোবস্ত নীতিমালার তোয়াক্কা না করে প্রভাবশালীরাই বিভিন্ন কৌশলে হাওর ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করেন। প্রকৃত মৎস্যজীবীরা সেখানে শ্রমিক হিসেবে চুক্তিতে কাজ করেন। কৃষিতে নারীদের সম্পৃক্ততা দ্রুতহারে বাড়ছে। কৃষি খাতে নারীর অংশগ্রহণ ৭২.৬ শতাংশ। কৃষি খাতের মূল ধারায় নিয়েজিত আছেন ৯০ লাখ ১১ হাজার নারী। অথচ কৃষক হিসেবে সেই নারী রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি আজও। কৃষি উৎপাদনে নারীর অগ্রণী ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও তার ভূমির মালিকানা নেই। খাসজমি বিতরণ নীতিমালা অনুযায়ী অগ্রাধিকার তালিকায় নারীর যৌথ মালিকানার কথা বলা হয়েছে। বিধবা নারীদের ক্ষেত্রে সক্ষম পুত্রসন্তানসহ আবেদনের কথা বলা হয়েছে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে ৩ কোটি ৪০ লাখ দরিদ্র মানুষ আছে। তাদের মধ্যে পৌনে দুই কোটি মানুষ হতদরিদ্র। করোনা-পরবর্তী সময়ে আরও অনেকেই দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। তাই করোনা–পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে মূলত ভূমি ও কৃষিই প্রধান চালিকা শক্তি হবে।

সাদেকা হালিম

সাদেকা হালিম
সাদেকা হালিম

ভূমির অভিগম্যতার কথা যদি বলি, দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে ৯৬ শতাংশ ভূমির মালিক হচ্ছেন পুরুষ, আর ৪ শতাংশ হচ্ছেন নারী। ২০০৫-০৬ সালের শ্রম জরিপে দেখা যাচ্ছে, ১ কোটি ২০ লাখ শ্রমিকের ৭৭ শতাংশই হচ্ছেন গ্রামীণ নারী। তাঁরা শুধু পোস্ট হার্ভেস্ট নয়, কৃষির সব কাজই তাঁরা করছেন। কৃষির মধ্যে এখন বৈচিত্র্য এসেছে। এখন ফলমূলের চাষ হয়। বাণিজ্যিক ফসল হচ্ছে। সামাজিক বনায়নের সঙ্গেও নারীরা সম্পৃক্ত। নারীরা প্রায় ১৬ ঘণ্টা কাজ করেন। কিন্তু তাঁরা সুযোগ–সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি ১ কোটি ৩৯ লাখ কৃষিকার্ড বিতরণ করেছিলেন। তখন আমরা বলেছিলাম, অধিকাংশ নারীর জমি নেই, রেকর্ডে তাঁদের নাম নেই। তাই জমিতে তাঁদের কোনো অধিকার নেই। তখন তিনি একটি উদ্যোগ নিয়ে যেসব নারী সরাসরি কৃষির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের কৃষিকার্ড দিয়েছিলেন। জানি না এখন সে কাজটি অব্যাহত আছে কি না। 

প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিয়েছেন নারীর জমি থাক বা না থাক, তাঁকে তাঁর কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে, নীতিমালায় নারীদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নারীর স্বামী মধ্যপ্রাচ্য বা কোনো দেশে কাজ করতে চলে গেছেন। কিন্তু জমির মালিক নারীর স্বামী। নারী যেহেতু জমির মালিক নন, সেহেতু কৃষিসংক্রান্ত কোনো সুযোগ–সুবিধা তিনি নিতে পারছেন না। এ ক্ষেত্রে বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে আমাদের নারীবান্ধব উদ্যোগ নিতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত উত্তরাধিকার আইনের সংশোধন করা না হবে, ততক্ষণ নারীরা ভূমির অধিকার পাবেন না। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন ইস্যুতে বলেছেন, নারীর সম–অধিকারের বিষয়টির দিতে হবে। আমরা জানি, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নারীদের ভূমিতে কোনো অধিকার নেই, অনেকের খণ্ডিত অধিকার আছে। পাহাড়ে ২৭ শতাংশ নারী কৃষিকাজে আছেন। কিন্তু পাহড়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার জন্য সেখানেও নারীরা ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত। এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। 

কোভিড–১৯–এর জন্য কৃষি একটা নতুন মাত্রা পাবে। ইতিমধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনেক দরিদ্র মানুষ শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। অভিবাসী শ্রমিকেরা দেশে ফিরছেন। এক লাখ নারী শ্রমিক বিদেশে, তাঁরাও হয়তো ফিরছেন। এঁরা সবাই গ্রামে অবস্থান করবেন। তাই যেকোনো মূল্যে আমাদের গ্রামের কৃষিকে উজ্জীবিত করতে হবে। 

সাইফুজ্জামান চৌধুরী

সাইফুজ্জামান চৌধুরী
সাইফুজ্জামান চৌধুরী

ভূমি মন্ত্রণালয় ‘ইউনাইটেড নেশনস পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড ২০২০’ অর্জন করেছে। এটা সরকারের এবং দেশের জন্য একটা বিশাল অর্জন।

আজকের মূল প্রবন্ধকার অধ্যাপক মইনুল ইসলামকে আমি অভিনন্দন জানাই।

১৯৯৬ সালে যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, তখন কৃষিমন্ত্রী ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। মূলত সে সময় থেকেই কৃষিতে সাফল্য আসতে শুরু করে, সেটা সেখান থেকেই শুরু। ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কৃষির বিষয়টি এত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়নি। 

আজ আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। এটা তো এক দিনে হয়নি। আমাদের সরকারের একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এটা সম্ভব হয়েছে। আমাদের প্রধান খাদ্য চাল। ধারাবাহিকভাবে খাদ্যশস্য নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। নতুন জাতের খাদ্যশস্য উৎপাদিত হচ্ছে। 

সমাজে কৃষিতে নারীর অবদান সব সময় ছিল। আগে এত গণমাধ্যম ছিল না। তাই তাদের কথা তেমনভাবে জানতে পারতাম না। এখন নারীর অবদানকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। শুধু ধান উৎপাদনই কৃষির মধ্যে পড়ে না, আমাদের এখানে ডেইরি ফার্ম আছে, পোলট্রি ফার্ম আছে। এ ক্ষেত্রে নারীসমাজের বিশাল অংশ কাজ করছে। এই সবই কৃষির মধ্যে পড়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের প্রাধান্য দিচ্ছেন। সচিব বলেন, নীতিনির্ধারক বলেন—নারীরা এখন সব ক্ষেত্রেই ভালো কাজ করছেন। আমার মন্ত্রণালয়েও অনেক নারী এসি ল্যান্ড আছেন। তাঁরা খুব ভালো কাজ করছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথা হচ্ছে জনগণের সেবক হতে হবে। তাঁর নেতৃত্বে সারা দেশে আমরা গুচ্ছ গ্রাম প্রকল্পে কাজ করছি। তিনি দেশে কোনো ভূমিহীন দেখতে চান না। যাদের ভূমি নেই, তাদের যেন ভূমি থাকে, সে জন্য আমরা দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে সচ্ছতার সঙ্গে এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। কৃষিজমিতে যত্রতত্র যেন বাড়িঘর তৈরি না হয়, শিল্পকারখানা গড়ে না ওঠে, সে জন্য কাজ করছি। এ বিষয়ে আমরা আইন করব।

কোভিড-১৯–এর পর খাদ্য উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। দেশে কৃষিজমি ফেলে রাখা যাবে না। খাদ্য আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে না বলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেশি। আমরা কেউ জানি না করোনা আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে। কিন্তু জীবন আর জীবিকা নিয়ে চলতে হবে। এটা হলো বাস্তবতা। আমরা সাবইকে নিয়ে সামনে এগোতে চাই। 

রাজা দেবাশীষ রায়

রাজা দেবাশীষ রায়
রাজা দেবাশীষ রায়

বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার একটি কাঠামো রয়েছে। এটাকে সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। একে পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রেক্ষিত অনুসারে ঢেলে সাজানো দরকার। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে যে ভিজিএফ, ভিজিডি কর্মসূচি আছে সেখানে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। কারণ, এখানে কাপ্তাই বাঁধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্বাস্তুও রয়েছে। প্রেসিডেন্ট জিয়া ও প্রেসিডেন্ট এরশাদের সময়ে ভূমিহীন মানুষদের এনে পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ৪ ভাগের ১ ভাগ জমিতে ভূমির মালিকানা স্বীকৃত না। 

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য আমরা চেষ্টা করছি খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। আমার চাকমা সার্কেলে ৩৫টি গ্রাম আছে, যারা কোনো খাদ্যসহায়তা পায়নি। ১২০টির মতো গ্রাম আছে, যারা গড়পড়তা ১০ কেজি চাল পেয়েছে। দিনে আড়াই কেজি খেলে চার দিনের বেশি চলে না। 

পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ জমি চাষের যোগ্য। ১ শতাংশ জমিও আমাদের দুই ফসলি না। চট্টগ্রাম থেকে এখন সমতলে আম যাচ্ছে। আমরা বেশি উৎপাদন করছি। কিন্তু আমাদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) কোল্ড স্টোরেজ করলে আমরা অনেক বেশি সুফল পেতাম। 

সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব, বিশেষত করোনার সময়ে ত্রাণ যেন সম্প্রসারিত হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় মিলে সমস্যার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। 

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

কৃষি নিয়ে একটা উপযোগী সময়ে এই আলোচনা হচ্ছে। কোভিড-১৯-এর কারণে মানুষের বেঁচে থাকতে হলে কৃষির প্রয়োজন। কিন্তু একশ্রেণির মানুষের হাত থেকে কোনোভাবেই কৃষিজমি রক্ষা করা যাচ্ছে না। মাননীয় ভূমিমন্ত্রী উপস্থিত আছেন। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁকে এ বিষয়টি জানাতে পারছি। দখলকারীরা আদালতের রায় মানছে না। জোর করে কৃষকের জমি দখল অব্যাহত রেখেছে। এই বাস্তবতাকে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই। মাননীয় মন্ত্রী যদি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান আর আমি যদি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যাই, দেখা যাবে চারপাশে কেবল সাইনবোর্ড আর সাইনবোর্ড। আমরা এখনো কৃষিজমির আইন চূড়ান্ত করতে পারিনি।

আপনারা সবাই কৃষির সাফল্যের কথা বলেছেন, আমি একমত। সাফল্যের বিপরীতে কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও বলতে চাই। আমাদের যে মৃত্তিকা গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে, তারা বলেছে যেভাবে কৃষিজমি অকৃষি কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে ২০৭০ সালের মধ্যে আর হয়তো কৃষিজমি তেমন থাকবে না। এমন পরিস্থিতিতে কৃষিজমি রক্ষায় কাজ করছি। হচ্ছে, হবে, হয়ে যাবে, শেষ পর্যায়ে আছে, অনুমোদন হবে—এসব বলার আর সময় নেই। এখন কৃষিজমি সুরক্ষার আইনটা অবিলম্বে করতে হবে।

ঢাকা শহরের আশপাশে আমরা কৃষিজমি হারিয়ে ফেলেছি। উন্নত যেকোনো দেশেই শহর ছাড়লেই কৃষিজমি দেখতে পাই। আমরা বুঝেছি শিল্পপ্রতিষ্ঠান লাগে। কিন্তু আমরা এবার এটাও বুঝেছি শিল্পপ্রতিষ্ঠান মানুষকে কোভিড-১৯-এর সময় খাওয়াতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইটভাটার কোনো সুযোগ নেই, কিন্তু সেখানেও প্রচুর ইটভাটা আছে। এসব বিষয়ে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। 

সঞ্জীব দ্রং

সঞ্জীব দ্রং
সঞ্জীব দ্রং

আদিবাসীদের জন্য একটা নীতিমালা হওয়া খুব জরুরি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা এটা আশা করতেই পারি। কোনো নীতিমালা না থাকলে কার্যক্রম গ্রহণ করা সহজ না। আমাদের বাজেটের আকার বেড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা থেকে ৫ লাখ কোটি টাকা হলেও এর প্রতিফলন আদিবাসীদের জীবনে খুব একটা দেখতে পাই না। নীতিমালা হলে আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাব।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আদিবাসীদের অংশগ্রহণের সীমাবদ্ধতা। পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি মন্ত্রণালয় আছে, আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদও আছে। কিন্তু সমতল অঞ্চলে আদিবাসীদের জন্য রাষ্ট্রে এমন কোনো ব্যবস্থাই নেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গত বছর থোক বরাদ্দ ছিল ৫০ কোটি টাকা, এবার আছে ৮০ কোটি টাকা। কিন্তু আদিবাসীদের ক্ষেত্রে এর কোনো সুবিধা আমরা পাই না। 

আবার এখন এল করোনার মতো ভয়াবহ দুর্যোগ। এই করোনাকালে অনেক আদিবাসী কঠিন সংকটে পড়ে গেছে। শহরে যাঁরা ছিলেন তাঁরা চাকরি হারিয়েছেন। আমার গ্রামে অনেক আদিবাসী ফেরত এসেছেন। শহরে তাঁরা বিউটি পারলার, সিকিউরিটি, ড্রাইভার, বাসাবাড়ি ইত্যাদি পেশায় কাজ করতেন। এঁরা সবাই কঠিন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়ে গেছে। এই সংকটে আদিবাসীদের পাশে কে দাঁড়াবে? রাষ্ট্র। কিন্তু রাষ্ট্রের কাছ থেকে আমরা তেমন সহযোগিতা পাই না। আমি আশা করি এসব বিষয় সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।

শফিক উজ জামান

শফিক উজ জামান
শফিক উজ জামান

গত ১০ বছর কৃষির সাফল্য উল্লেখ করার মতো। আজ আমরা খাদ্যে উদ্বৃত্তের দেশ। কিন্তু খাদ্য উৎপাদন করাই যথেষ্ট না। কৃষিকে যদি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করতে পারতাম তাহলে আমাদের অবস্থা আরও অনেক ভালো হতো। এখন তৈরি পোশাক খাতই দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প। প্রায় সম্পূর্ণ পোশাকই রপ্তানি হয়। কোনো কারণে যদি বিদেশিরা পোশাক না কেনে, এই শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তৈরি পোশাকশিল্পের পাশাপাশি আমাদের প্রয়োজন ছিল কৃষি খাতকে শিল্পায়নের সঙ্গে যুক্ত করা। কৃষিকে যদি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে যুক্ত করতে পারতাম তাহলে কৃষক উপযুক্ত মূল্য পেত। একই সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো। অর্থনীতিতে একটা ব্যাপক গতি আসত। 

কৃষির বহুমুখীকরণ এখনো আমরা করতে পারিনি। কৃষিভিত্তিক শিল্পের ওপর আমাদের জোর দিতে হবে। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এ ক্ষেত্রে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। পরপর ভালো ফসল হলে আমরা বলি খাদ্য রাখার জায়গা নেই। খাদ্য উৎপাদন বেশি হলে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ যেকোনো সময় দুর্যোগ আসতে পারে। আমাদের এটা অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ফসল ছিল পাট। প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন তৈরি হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে পাট থেকে আমরা বিশাল সাফল্য পেতে পারতাম। কিন্তু সেটা হয়নি। এখন আমাদের কৃষিকে শিল্পে রূপান্তরিত করতে হবে।

শামসুল হুদা

শামসুল হুদা
শামসুল হুদা

কোভিড-১৯ সারা বিশ্বের জন্য ওয়েকআপ কল। এটা এখন সবাই বলছেন, এটা শুধু সারা বিশ্বে জন্যই না, বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে ওয়েকআপ কল। কোভিড আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে কৃষি ছাড়া কোনো উপায় নেই। আরেকবার ১৯৭১ সালে বুঝেছিলাম। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন শহরগুলো আক্রমণ করেছিল, তখন সবাই গ্রামে ফিরে গিয়েছিল, কৃষি ও কৃষকের কাছে ফিরে যেতে হয়েছিল। এই কৃষির যাঁরা বীর তাঁরা হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষক, নারী, আদিবাসী, বর্গাচাষি। সব ধরনের বঞ্চনা সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের মেধা, শ্রম দিয়ে কৃষিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সরকার কৃষিতে সহযোগিতা দিয়েছে। কিন্তু দেশের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ এই শ্রেণির মানুষের অবদানেই আজ কৃষি এখানে এসেছে। 

এঁদের অবদানের স্বীকৃতি দিতেই হবে। প্রায় ৫০ বছর ধরে তাঁদের সঙ্গে অকৃতজ্ঞ আচরণ করে এসেছি।এখনো যদি তাঁদের অবদানের স্বীকৃতি না দিই তাহলে হয়তো কোভিড থেকেও ভয়াবহ কোনো দুর্যোগে পড়তে পারি। জমি, ফসল ও ঋণের ওপর নারীর অধিকার দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। নারী যেন নিজেই ফসল বিক্রির সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অর্থ ব্যবহারের অধিকার পায়। 

সমতলের কৃষিতে ঐতিহাসিকভাবে আদিবাসীদের অবদান রয়েছে। সাঁওতাল, গারো, হাজং, ওঁরাও সবার অবদান রয়েছে। কৃষক আন্দোলনের অবদান রয়েছে। সেই কৃষক আন্দোলনের সামনের সারিতে তারা লড়াই করেছে। তারা জীবন দিয়েছে কিন্তু আজও পর্যন্ত তারা কোনো স্বীকৃতি পায়নি। আদিবাসীদের ভূমি সুরক্ষার আইন দরকার। পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘকাল যে বঞ্চনা ছিল সেই বঞ্চনা দূর করার জন্য ১৯৯৭ সালে এই সরকারই সফল চুক্তি করেছিল। এই ঐতিহাসিক চুক্তির ধারাবাহিক বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ভূমি কমিশন আছে কিন্তু ঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না।

তাদের ভূমি অধিকারের সুরক্ষার জন্য একটা আইন দরকার। একটা স্বতন্ত্র আইনই দরকার। 

অনেকে বলছেন, সময় এসেছে। আমি বলব, সময় অনেক আগে এসেছে, এখন সময় বয়ে যাচ্ছে। এখনই এসবের ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়ার দরকার। 

খুশী কবির

খুশী কবির
খুশী কবির

বাজেটের সময়ে এ আলোচনাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমন আমাদের একটা বড় ফসল। সামনের মাসেই আমনের চাষ শুরু হবে। কিন্তু এ ব্যাপারেও তেমন কোনো উদ্যোগ দেখছি না। বিশেষ করে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে কৃষকেরা কীভাবে আমন ফসল করবেন, এ ক্ষেত্রে সরকারের কী করণীয়, এ বিষয়ে কিছু বুঝতে পারছি না।

নারীরা এখন ঘরে ও মাঠে দুই জায়গাতেই প্রায় সমানভাবে কাজ করছে। আমরা বিভিন্ন এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করছি। আমরা প্রায় এক হাজারের বেশি গ্রামে কাজ করছি। কোভিড শুরু হওয়ার পর থেকে মজুরি কমে গেছে। একই সঙ্গে দ্রব্যের দামও কমে গেছে। কোভিডের জন্য গ্রামের নারী-পুরুষ সবাই সংকটে আছে। সব সময় দেখা যায় পুরুষের থেকে নারী মজুরি কম পান। যদিও কাজ ও দক্ষতার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। 

করোনার জন্য প্রান্তিক মানুষেরা যেন হারিয়ে না যায় সে জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় তাদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা দিতে হবে। আদিবাসীদের সুরক্ষার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি কমিশন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ভূমিতে তাদের সুরক্ষার বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। আজ হাজার হাজার আদিবাসী শহরে কাজ করছে। ধীরে ধীরে তারা তাদের ভূমির ওপর অধিকার হারিয়ে ফেলছে। আর এখন তারা জীবিকার জন্য শহরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। 

সার্বিকভাবে কৃষিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এখন কৃষিকে সবার সমানে নিয়ে আসতে হবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ভূমি ও আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বসতে হবে। প্রান্তিক নারী-পুরুষ কৃষক, আদিবাসীসহ কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সুরক্ষা দিতে হবে। তাদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে যেন ভবিষ্যতে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারি।

ফিরোজ চৌধুরী

কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে কৃষিই হতে পারে আমাদের শেষ রক্ষাকবচ। ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিলে আজ চমৎকার আলোচনা হয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও নারীর কথা বেশ উচ্চকিতভাবে বলা হয়েছে। আশা করা যায়, সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।

আজকের ‘ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল’ বৈঠকে মাননীয় ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও অন্যান্য সম্মানিত আলোচক যাঁরা যুক্ত হয়েছেন তাঁদের প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

আলোচনা থেকে প্রাপ্ত সুপারিশ

■ প্রান্তিক কৃষকেরা যাতে ফসলের ন্যায্যমূল্য পান, তা নিশ্চিত করতে হবে।

■ তিন ফসলি জমি শিল্পায়নের জন্য বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

■ কৃষিজমি স‍ুরক্ষা ও ব্যবহার আইন দ্রুত পাশ করতে হবে।

■ বর্গাদারদের ভূমিস্বত্বের নিরাপত্তা জোরদারকরণ ও জবরদস্তিমূলক উচ্ছেদের আশঙ্কা নিরসন করা। 

■ গ্রামীণ ভিটেমাটিতে বসবাসরতদের দখলিস্বত্ব প্রদান করা।

■ ভূমিহীন পরিবারগুলোকে বসতবাটির জন্য প্লট প্রদান করা। 

■ কোনো পরিবারকে আট হেক্টরের বেশি জমির মালিকানা রাখতে না দেওয়া। 

■ ভাগচাষি ও বর্গাদার কৃষকদের তাঁদের চাষকৃত জমির কার্যকর মালিকে পরিণত করা।

■ জমি, ফসল ও ঋণের ওপর নারীর অধিকার দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

■ সমতলের আদিবাসীদের ভূমি সুরক্ষার আইন দরকার।

■ করোনার জন্য প্রান্তিক মানুষেরা যেন হারিয়ে না যায়, সে জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় তাদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা দিতে হবে।