করোনা পরীক্ষা

কোভিড-১৯ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার একদম শুরুর দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে কাজগুলোর ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে প্রথম হচ্ছে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা। যত দ্রুত যত বেশিসংখ্যক মানুষকে পরীক্ষা করা হবে, তত তাড়াতাড়ি মহামারির প্রকৃত পরিস্থিতি, সংক্রমণের প্রবণতা ও গতি–প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের কাজগুলো এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। প্রথম আলোসহ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমও শুরু থেকেই বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। গুরুত্বটা এখন আরও বেড়েছে।

কারণ, প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পাঁচ মাস পরও আমাদের গড় দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা ১৫ হাজার পার হয়নি। এ ক্ষেত্রে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের পেছনে পড়ে রয়েছি। পিছিয়ে রয়েছি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানদণ্ডেও। সংস্থাটি সংক্রমণের বৈশ্বিক প্রবণতার পর্যবেক্ষণ থেকে বলেছে, সংক্রমণ-প্রবণতাভেদে কোনো দেশে ১০ থেকে ৩০ ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা করে যদি একজন রোগী শনাক্ত হয়, তাহলে ধরে নেওয়া যাবে পর্যাপ্তসংখ্যক পরীক্ষা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতি ৫ দশমিক ৫টি নমুনার পরীক্ষাতেই একজন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। অর্থাৎ, এ দেশে প্রকৃত করোনা রোগীর সংখ্যা সরকারি পরিসংখ্যানের দ্বিগুণ থেকে অন্তত পাঁচ গুণ বেশি হতে পারে। কিন্তু সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে হলে পরীক্ষার সংখ্যা সেই হারে বাড়াতে হবে।

প্রশ্ন হলো, পরীক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের এতটা পিছিয়ে থাকার কারণ কী? প্রথম ও প্রধান কারণ শুরু থেকে পরিকল্পনার ঘাটতি এবং তা থেকে সৃষ্ট সিদ্ধান্তহীনতা ও অব্যবস্থাপনা। শুরুতে করোনা শনাক্তকরণের যাবতীয় দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল একটি মাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের মধ্যে। কিন্তু তাদের পর্যাপ্ত সামর্থ্য ছিল না, লোকবলের ঘাটতি ছিল বিরাট। তা সত্ত্বেও তাদের একটি মাত্র পরীক্ষাগারের পরীক্ষা সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক সংস্থা আইসিডিডিআরবি ও সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে করোনা শনাক্তকরণের উপযোগী পরীক্ষাগার ও যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও তাদের কাউকেই পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে অনেক লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু সরকার কর্ণপাত করেনি। অনেক সমালোচনা ও কালক্ষেপণের পর একটি-দুটি প্রতিষ্ঠানকে পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া শুরু হয়। এখন পরীক্ষা সমন্বয়ের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাদের কর্তৃত্বে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৬১টি পরীক্ষাকেন্দ্রে দৈনিক গড়ে প্রায় ১৫ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।

শনাক্ত রোগীর সংখ্যা এখনো যে গতিতে বাড়ছে, সে তুলনায় পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ছে না। তা ছাড়া মানুষ পরীক্ষা করাতে গিয়ে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে, পরীক্ষার ফল পেতে বিলম্ব হচ্ছে, পরীক্ষার ফল নিয়ে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে। ফলে পরীক্ষার গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে; কিন্তু মান নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। অনেকে বলছেন, করোনা শনাক্তকরণ ঠিকভাবে হচ্ছে না। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আইসোলেশনে নেওয়াসহ অনেক কাজে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।

আরেকটি হতাশাব্যঞ্জক চিত্র হলো, করোনার নমুনা সংগ্রহ ও তা পরীক্ষাগারে পৌঁছানো পর্যন্ত নানা সমস্যার কারণে মোট সংগৃহীত নমুনার প্রায় ৫ শতাংশ অকার্যকর বা বাতিল ঘোষণা করা হচ্ছে। যাঁদের নমুনা বাতিল করা হচ্ছে, তঁাদের দ্বিতীয়বার নমুনা নেওয়া হচ্ছে না। আবার এমনও বলা হচ্ছে যে সব পরীক্ষাগারের মোট সামর্থ্যের তুলনায় সংগৃহীত নমুনার সংখ্যা বেশি হচ্ছে। প্রতিদিনই অনেক নমুনা অপরীক্ষিত থেকে যাচ্ছে এবং প্রতিদিনই আরও নতুন নতুন নমুনা এসে জড়ো হওয়ায় পরীক্ষার চাপ আরও বাড়ছে, কিন্তু পরীক্ষাগারগুলো সে চাপ সামাল দিতে পারছে না বলে নমুনা নষ্ট হচ্ছে।

সুতরাং পরীক্ষাগারের সংখ্যা, যন্ত্রপাতি ও লোকবল আরও এমনভাবে বাড়াতে হবে, যেন সংগৃহীত সব নমুনাই যথাসময়ে পরীক্ষা করা সম্ভব হয়।