সরকারি কাজে 'জুম' অ্যাপ কেন?

সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে ১৭ জুন একটি সরকারি আদেশ জারি হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসজনিত পরিস্থিতিতে সরকারি অফিসারদের ‘জুম’ অ্যাপ ব্যবহার করে জনপ্রশাসনের সচিব মহোদয় ভার্চ্যুয়াল সভাসহ অন্যান্য বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করবেন। এ কারণে প্রত্যেক কর্মকর্তাকে জরুরি ভিত্তিতে তাঁর স্মার্টফোন/ট্যাব/ল্যাপটপে জুম অ্যাপ ডাউনলোড/আপডেট করে প্রস্তুত থাকার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ সংবাদ জেনে আমরা কিছুটা বিচলিত হয়েছি এই কারণে যে ভিডিও কনফারেন্সের জন্য সাম্প্রতিক কালে জুম একটি জনপ্রিয় বা বহুল ব্যবহৃত অ্যাপ হওয়া সত্ত্বেও নিরাপত্তার কারণে এর বিরুদ্ধে অনেক দেশে অভিযোগ উঠেছে। ভারত, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশেই অন্তত সরকারি কাজে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সরকারের দাপ্তরিক কাজে এই অ্যাপ ব্যবহার করা কতটা সমীচীন হবে, সেই চিন্তা থেকেই এ লেখার সূত্রপাত।

আজ থেকে নয় বছর আগে, ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় সিসকো ওয়েবেক্সে (সিসকোর ভিডিও কনফারেন্স শাখা) কর্মরত এরিক ইউয়ান নামের এক চীনা বংশোদ্ভূত প্রযুক্তিবিদ চাকরি ছেড়ে ‘সাসবি’ নামের একটি ভিডিও কনফারেন্স সিস্টেম তৈরি করে বাজারজাত করার চেষ্টা করেন। এরিক ইউয়ান প্রথমে তেমন একটা সুবিধা করতে না পারলেও পরের বছর নাম পাল্টে ও পুরোনো কর্মস্থল সিসকোর কর্মকর্তাদের সহায়তায় আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে ‘জুম ভিডিও কমিউনিকেশনস’ নামে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে এই কোম্পানির কর্মীসংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার; তাদের বেশির ভাগই চীনে অবস্থান করে কাজ করে; ২০১৯ সালে এর নিট মুনাফা ছিল ২১ মিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে এর ব্যবহারকারী দাঁড়ায় ২২ লাখ। আর করোনা পরিস্থিতিতে হোম অফিস ও আন্তযোগাযোগের ব্যাপকতার ফলে এপ্রিল মাসে এর দৈনিক ব্যবহারকারী বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ কোটিতে। পৃথিবীর অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন শিক্ষা কাজেও জুম প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে। সহজে ব্যবহারের সুবিধা থাকায় বাংলাদেশেও এই অ্যাপের ব্যবহার বেড়েছে। তবে এই অ্যাপের বিষয়ে বিভিন্ন শ্রেণির ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তাজনিত অভিযোগ ও উদ্বেগ আছে।

আমাদের দেশের সরকারি কাজে এই অ্যাপের ব্যবহার কতটা নিরাপদ, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের তথ্যগুলো একটু যাচাই করে নেওয়া দরকার। গত ১৫ এপ্রিল ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম (CERT-in) বলেছে, এই অ্যাপে নানান রকম ত্রুটি আছে, যেটি সহজেই অপব্যবহার করতে পারে হ্যাকাররা। এ কারণে ভারত সরকার কোনো থার্ড পার্টি সফটওয়্যারে ভিডিও মিটিং করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তাদের দেশের সাইবার কো-অর্ডিনেশন সেন্টার জুমকে অনিরাপদ উল্লেখ করায় ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেশের যাঁরা জুম ব্যবহার করতে চান, তাঁদের জন্য ১৭ পৃষ্ঠার একটি নিরাপত্তা গাইডলাইন করে দিয়েছে, যেন সেগুলো অনুসরণ করে ব্যবহারকারী নিজের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা অক্ষুণ্ন রাখতে পারেন। শুধু ভারতে নয়, সারা বিশ্বেই জুম ব্যবহার করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও জুমের সিইও এরিক এস ইউয়ান বলেছেন যে তাঁরা কিছু ভুল করেছেন দ্রুত এই অ্যাপের পরিধি বাড়াতে গিয়ে; তবে নতুন করে প্রাইভেসি ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ হবে। কিন্তু তাতেও অনেক দেশ ভরসা করতে পারেনি। এরই মধ্যে তাইওয়ান ও জার্মানি জুমের ব্যবহার ঘোষণা দিয়ে সীমিত করেছে। জার্মানির পররাষ্ট্র দপ্তর নিরাপত্তা ভঙ্গের প্রমাণ পেয়ে এক আদেশ বলে জুম ব্যবহারে কর্মকর্তাদের নিষেধ করে দিয়েছে। সুইজারল্যান্ডসহ অনেক দেশ সরকারি কাজে জুম ব্যবহার না করতে পরামর্শ দিয়েছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তায় ঘাটতি আছে জানিয়ে জুম ব্যবহার নিরুৎসাহিত করেছে। অস্ট্রেলিয়াও একই পথ অনুসরণ করেছে।

কোন পরিস্থিতিতে বা পরিপ্রেক্ষিতে দেশগুলো এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বা জনগণকে জুম ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করেছে, তার ব্যাপক তাত্ত্বিক ও কারিগরি আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। আমাদের বুঝতে হবে উন্নত দেশগুলো এসব বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর বা সজাগ। ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে আমাদের নিশ্চয়ই সে তাত্ত্বিক জ্ঞান অনুধাবনের সক্ষমতা আছে, যে কারণে আমরা বুঝতে পারছি না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আইসিটি ডিভিশনের সঙ্গে পরামর্শ করেছে কি না। আমাদের এ-ও বুঝতে হবে, কেন তথ্যপ্রযুক্তি জগতের সবচেয়ে বড় কোম্পানিগুলোও (আমাজন, গুগল, মাইক্রোসফট) নিজেদের দপ্তরে জুম ব্যবহার নিষিদ্ধ করল।

ভারত সরকারি কাজে নিজেদের তৈরি নিজস্ব ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের কাজ হয় এনআইসি (ন্যাশনাল ইনফরমেটিকস সেন্টার) প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। বাংলাদেশেরও নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম আছে, আমরা দেখেছি যা দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ভিডিও কনফারেন্স করে থাকেন। খুব সহজেই কর্মকর্তাদের জন্য এই পদ্ধতিকে স্মার্টফোনে ব্যবহারের উপযোগী অ্যাপে পরিণত করা যায়। সে সৃজনশীল মেধা ও সক্ষমতা বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই আছে। এই সুযোগে আরও একটি কথা বলে রাখি, আমাদের সরকারি দপ্তরের দাপ্তরিক কাজে ও সব যোগাযোগে নিজদের ডোমেইন ব্যবহার করা উচিত। আমাদের নিজেদের সিসিটিএলডি (কান্ট্রি কোড টপ লেভেল ডোমেইন যেমন ডট বিডি বা ডট বাংলা) রয়েছে। সে পরিচয় বাদ রেখে আমরা অন্যের ফ্রি ডোমেইন ব্যবহার করে দেশের সরকারি কাজের প্রয়োজনীয় গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারছি কি না ভেবে দেখা দরকার। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই জি-মেইল ও ইয়াহু মেইল ব্যবহার করেন, এটাও দেশের জন্য উপযোগী কারিগরি শর্ত মানের দিক থেকে সম্মানজনক নয়।

রেজা সেলিম: পরিচালক, আমাদের গ্রাম প্রকল্প
ই-মেইল: [email protected]