কেন মন্দ কথা কই?

ফেসবুক। ছবি: রয়টার্স
ফেসবুক। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বজুড়ে সেলিব্রিটিদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহের সীমা নেই। আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল না। পেপার-পত্রিকার মাধ্যমেই ভক্তরা প্রিয় তারকাদের তথ্য পেত। অনেকে প্রিয় তারকার ছবি কিংবা অটোগ্রাফ সংগ্রহে রাখত। অতি উৎসাহীদের কেউ কেউ তারকাদের ঠিকানা জোগাড় করে চিঠি লিখত; উত্তরের আশা করে কিংবা না করেই।

সময় এখন পাল্টেছে। এখন আর তথ্য পাওয়ার জন্য কষ্ট করার প্রয়োজন হয় না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে তারকাদের রাশি রাশি খবর পাঠকের হাতে সকাল–বিকেল চলে আসে অনায়াসে। শুধু তারকাই নয়, উন্মুক্ত যোগাযোগমাধ্যমের দাপটে এখন খুব সহজেই পাওয়া যায় পরিচিত–অপরিচিত সবার খবর। আগে মানুষ তাদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব কিংবা কাঙ্ক্ষিত তারকার খবর পেলেও সেসব খবরে প্রতিক্রিয়া জানানোর তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে সেই সুযোগও উন্মুক্ত হওয়ার কারণে কিনা জানি না, অনেকেই যেন অনুভূতি প্রকাশে আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন। নিজের মর্যাদা, সীমারেখা ইত্যাদি বিষয় গুলিয়ে ফেলে যেনতেন ভাষার প্রয়োগ করছেন। এতে তাঁরা যেমন বিশিষ্টদের মান মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছেন, ঠিক একইভাবে নিজেদের ব্যক্তিত্বকেও অসম্মানিত করছেন, অপমানিত করছেন।

এই ধরনের নোংরা আচরণ যে শুধু তারকা, বিশিষ্ট ব্যক্তি কিংবা অপরিচিতদের প্রতি সীমাবদ্ধ থাকছে তা কিন্তু নয়, বরং এই প্রবণতা সংক্রমিত হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে। এমনকি ব্যক্তির নিজস্ব পরিসরে বন্ধু, সহকর্মী, এমনকি আত্মীয়-পরিজনও এই প্রবণতা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে গ্রুপ তৈরির সুযোগ আছে। অনেক ক্ষেত্রে অনুভূতির আদান–প্রদানের নামে এসব গ্রুপেও চলে নোংরা কথার চর্চা। কিছু বিকৃত মানসিকতার কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে গ্রুপের প্রকৃত উদ্দেশ্য। প্রশ্ন হলো অনলাইনে কেন আমাদের এই বিকৃত আচরণ?

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটেনের টিভি তারকা ক্যারোলিন লুইস ফ্ল্যাকের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পর ‘হ্যালো’ ম্যাগাজিনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। ক্যারোলিন ফ্ল্যাক আত্মহননের কারণ হিসেবে যা পাওয়া গিয়েছিল, তা হলো মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচক মন্তব্য এবং ট্রল থেকে সৃষ্ট হতাশা থেকে তিনি এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তবে ক্যারোলিন ফ্ল্যাকের মতো হতাশায় ভোগা মানুষের সংখ্যা কিন্তু নেহাত কম নয়। অনেকেরই পরিণতি হয় ভয়াবহ।

সেই প্রতিবেদনে আলোচিত হয়েছিল কেন মানুষের মধ্যে এই ধরনের নেতিবাচক আচরণের চর্চা। বিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিক জো হেমিংসের উদ্ধৃতি দিয়ে সেখানে বলা হয়েছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচক আচরণ কিংবা মন্তব্য করেন মূলত তাঁরাই, যাঁরা ব্যক্তিজীবনের বাস্তব সম্পর্কের প্রতি উদাসীন এবং শ্রদ্ধাহীন। তাঁদের অনেকেরই ব্যক্তি জীবনে রয়েছে তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং না পাওয়ার যন্ত্রণা। অনেকেই ভারসাম্যহীন সম্পর্কের বোঝা বয়ে চলেছেন। অনেকেই আবার শ্রদ্ধাপূর্ণ পারস্পরিক সম্পর্কের অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত। যার পরিণাম অন্যের প্রতি অশ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ।

অনেকে আবার ব্যক্তিজীবনে গুরুত্ব না পাওয়ার হতাশা দূর করতে ভার্চ্যুয়াল জগতে রাতারাতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চান। যে কথাটি সামনাসামনি বলার সাহস অনেকেই রাখেন না, সেই কথাটিই অনায়াসে উচ্চারণ করেন ফেসবুক, টুইটার কিংবা ইনস্টাগ্রামের কমেন্টে, ট্রলও করেন। শুধু নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার অভিলাষে তাঁরা মেতে ওঠেন কটু মন্তব্য কিংবা নোংরা ভাষা প্রয়োগের মহোৎসবে। গুণী খেলোয়াড়, প্রিয় লেখক কিংবা শিল্পীর প্রতি ছুড়ে দেওয়া হয় নোংরা কদর্য ভাষা, লেখককে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হয়।

ক্রীড়া, শিল্প কিংবা সাহিত্য গৌণ হয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক কিংবা খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত জীবন। আর টার্গেটটি যদি নারী হন, তাহলে তো কথাই নেই। অপ্রাসঙ্গিক আদি রসাত্মক ভাষার ব্যবহারে কমেন্ট বক্স নোংরা বিনোদনের উৎস হয়ে ওঠে অনেকের কাছে। আবার অনেকে আছেন, যাঁরা একেবারেই উদাসীন নিজেদের আত্মমর্যাদা সম্পর্কে। নিজেদের ভাবমূর্তি গড়তে ব্যর্থ এই মানুষগুলো তাঁদের স্বকীয় অস্তিত্বের ব্যাপারে একেবারেই শ্রদ্ধাশীল নন। তাই মন্তব্য করার ক্ষেত্রে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেন তাঁরা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যবহারকারীর অবশ্যই রয়েছে। তবে মতপ্রকাশের নামে কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা, গালমন্দ করা, যৌনতার চর্চা করা, ইঙ্গিতপূর্ণ, কুরুচিপূর্ণ ভাষার প্রয়োগ করা স্বেচ্ছাচারিতারই অন্য নাম। শুধু শিক্ষার প্রসার কিংবা আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের এই প্রবণতা রোধ করা যাবে না। কারণ, দেখা যায়, এই সমস্ত কুরুচিকর মন্তব্যকারীর অনেকেই উচ্চশিক্ষিত এবং সমাজে উচ্চস্তরে বসবাসকারী। অনেকে আবার দেশের খ্যাতনামা কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাই প্রয়োজন মানুষের আচরণগত পরিবর্তন। মূল্যবোধের সঠিক বিকাশ ঘটায়—এমন শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। মানুষ পরিবার থেকেই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। এরপর ভূমিকা রাখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। মানুষের মূল্যবোধ গঠনে প্রতিটি স্তরেই কাজ করা প্রয়োজন।

মনে রাখা প্রয়োজন, এই ধরনের আচরণের মাধ্যমে ব্যক্তি সাময়িকভাবে পুলক অনুভব করলেও প্রকৃতপক্ষে এই আচরণের চর্চা তাকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। সে ধীরে ধীরে অন্যের চোখে শ্রদ্ধা ও সম্মানের জায়গাটি হারিয়ে ফেলে। ক্রমাগত তার পরিধি ছোট হতে থাকে। ফলে কাছের মানুষও একসময় তাকে প্রত্যাখ্যান করে। এসব নোংরা মন্তব্যের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে কলুষিত করে, যার দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। তাই আসুন আমরা একবার ফিরে তাকাই আমরা যা লিখছি তা কি ঠিক লিখছি? মনে রাখতে হবে, যা সত্য, সুন্দর ও শাশ্বত, তা সুবাস ছড়াবেই।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
[email protected]