সুখের পায়রাদের পৃষ্ঠপোষকতার পরিণতি

কিছুদিন পরপর কোনো কীর্তিমানের কারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি বিশ্ববিখ্যাত হয়। গণতান্ত্রিক দেশের সাংসদ অতি সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাঁদের ইংরেজিতে বলে ল-মেকার, অর্থাৎ আইনপ্রণেতা। আইন ভঙ্গকারী তাঁরা হতেই পারেন না। সেই আইনপ্রণেতাদের মধ্যে কেউ যখন বিদেশে গিয়ে কোনো গুরুতর অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে কারারুদ্ধ হন, তখন তাঁর নিজের ইজ্জত গেল কি না, তার চেয়ে বড় দেশটার চরম বেইজ্জতি। ক্যাসিনো–কাণ্ডে দেশের ভেতরে তুলকালাম ব্যাপার ঘটেছে, কুয়েত–কাণ্ডে দেশের ভাবমূর্তির ওপর আঘাত এল।

একজন মানুষ যখন খুব কম সময়ের মধ্যে অজ্ঞাত উপায়ে অর্জিত সম্পদে রকফেলার বা বিল গেটসের মতো ধনী হন, তাঁর সেই অভিযাত্রায় তাঁর আশপাশের মানুষের, তাঁর দলের কোনো কোনো নেতার এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কোনো আনুকূল্য নেই, তা বিশ্বাস করা কঠিন। যে যা-ই বলুক, তাঁর সাফল্যের কৃতিত্ব তাঁর একার নয়। পত্নীসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের এবং শ্বশুরকুলের প্রশ্রয় না পেলে কারও পক্ষে এত দূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। এই কৃতিত্বের পুরস্কারও তাঁরা একেবারে নগদ পেয়েছেন। এক ঘর মে দো এমপি। বিরল সৌভাগ্য যাকে বলে!

যে দেশের পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে, সেখানে আমাদের দক্ষ কূটনীতিকেরা রয়েছেন। তাঁর কর্মতৎপরতা ও গতিবিধি সম্পর্কে তাঁরা বিন্দু-বিসর্গ অবগত ছিলেন না, তা অবিশ্বাস্য। দেশের একজন মাননীয় হিসেবে রাষ্ট্রদূত তাঁকে প্রটোকলের বাইরে গিয়ে আদর-আপ্যায়ন করেননি, তা ভাবার কারণ নেই।

যে দেশের কারাগারে তিনি আজ অতিথি, সেই দেশেরও কোনো কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর প্রণয় ছিল না, তা হতেই পারে না। না থাকলে এত দিন তিনি সেখানে রাজার হালে বিচরণ করতেই পারতেন না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর আমির-ওমরাহ ও আমলারা ধোয়া তুলসী পাতা নন। মানব পাচার গুরুতর অপরাধ। আমাদের যিনি অভিযুক্ত হয়েছেন, ধারণা করি তিনি কুয়েত থেকে কোনো নারী বা পুরুষকে বাংলাদেশে পাচার করেননি; করে থাকলে বাংলাদেশ থেকেই সেখানে পাচার করেছেন। কোনো জিনিসের চাহিদা থাকলেই তা সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

দ্য অ্যারাব টাইমস ১৮ জুন জানিয়েছে, বাংলাদেশের সাংসদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ায় দুজন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে আমাদের সাংসদ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে ঘুষ দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। নির্বিঘ্নে দুই নম্বরি ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে ঘুষ লেনদেন খুব স্বাভাবিক। পরদিন আরেক খবরে জানা যায়, অভিযুক্ত আদমব্যবসায়ী কুয়েতে ২০ লাখ ডলার বা ১৭ কোটি টাকা নিট প্রফিট করেছেন। তাঁর জন্য এটা কোনো বড় অঙ্ক নয়। তবে অ্যারাব নিউজ–এর ১৯ তারিখের আরেক খবর থেকে জানতে পারলাম, বাংলাদেশি সাংসদ কাজী শহিদ ইসলাম ও তাঁর প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কুয়েতের পাবলিক প্রসিকিউশন। তারা এরই মধ্যে সাংসদ ও তঁার প্রতিষ্ঠানের ১৩৮ কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে।

আলোচ্য সাংসদ সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রিকায় কয়েক দিন যাবৎ আকর্ষণীয় সংবাদ বেরোচ্ছে। তিনি স্বতন্ত্র হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমানে যে কায়দার ‘নিয়ন্ত্রিত’ নির্বাচন হচ্ছে,, তাতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি কীভাবে নির্বাচিত হলেন, তা নিয়ে খুব আলোচনা দেখিনি। তবে অনুমান করা যায়। আর একজন স্বতন্ত্র সাংসদের স্ত্রীও যখন নারী সাংসদের কোটায় সংসদ সদস্যের পদ পান, তখন সরকারি দলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার মাত্রাটি বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি চিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের। আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে এখন রয়েছেন তিনটি প্রজন্ম। আমার এই লেখা যখন প্রকাশিত হবে, কাকতালীয়ভাবে সেটি আওয়ামী লীগের জন্মদিন—৭১তম প্রতিষ্ঠা দিবস। এই দলের ইতিহাস কঠিন সংগ্রামের। প্রথম প্রজন্মের নেতারা পঞ্চাশের দশকে মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করেছেন। বছরের পর বছর জেল খেটেছেন। হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে দিতে জুতার সুকতলি ক্ষয় করেছেন। নিজের ঘরসংসারের কাজ করতে পারেননি।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহকর্মী ও মন্ত্রীদের সঙ্গে বিভিন্ন জেলা-মহকুমার নেতাদের বাড়িতে অনেক সময় আতিথ্য গ্রহণ করেছি। খুবই সাদাসিধে ছিল তাঁদের জীবনযাপন। পঁচাত্তরের পরেও প্রলোভন থাকা সত্ত্বেও তাঁরা দলে মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন। নির্বাচনী খরচ মেটাতে পারবেন না বলে মনোনয়ন পাননি। জরাগ্রস্ত তাঁদের কেউ কেউ আজও বেঁচে আছেন।

দলের দ্বিতীয় প্রজন্মটি আমাদেরই বয়সী। তাঁরা ষাটের দশকের নেতা। অধিকাংশই এসেছেন ছাত্ররাজনীতি থেকে। সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে স্বাধিকারের জন্য তাঁরা সংগ্রাম করেছেন। জেল-জুলুম, মামলা-মোকদ্দমা ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। তাঁরা উনসত্তরে গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে লৌহমানব আইয়ুব খানের পতন ঘটান। তাঁরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। স্বাধীনতার পর তাঁরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁদের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। আশির দশকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করে জেল–জুলুম সহ্য করেছেন। তাঁদের অনেকে আজও শেখ হাসিনার সঙ্গে আছেন। তাঁরা জনগণের সুখ-দুঃখেও তাদের পাশে থাকেন। তাঁদের সঙ্গে আশির দশকের অনেক ছাত্রনেতাও রয়েছেন।

আওয়ামী লীগে আরেকটি প্রজন্মের প্রাদুর্ভাব ঘটে ১৯৯৬ থেকে। অতীতে তঁারা দলের জন্য, দেশের জন্য কে কী করছেন, তা বিধাতা ছাড়া আর কেউ জানে না। তবে অন্য দলের সরকারের সময় ব্যবসা-বাণিজ্যে ফুলেফেঁপে উঠেছেন। টাকার পাহাড় গড়েছেন। বিভিন্ন দেশে দ্বিতীয়-তৃতীয় বাড়ি নির্মাণ করেছেন। সেসব দেশের ব্যাংকে জমিয়েছেন টাকা। টাকা পাচার করেছেন। কেউ কেউ মানুষ পাচারের সঙ্গে যুক্ত। শুধু অর্থেই তাঁরা সন্তুষ্ট নন, তাঁরা চান রাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ পদ। এলাকার নিবেদিত নেতাদের টেক্কা দিয়ে পেতে থাকেন সাংবিধানিক পদ। বিমল মিত্রের উপন্যাসের শিরোনাম ধার করে তাঁরা বলতে পারেন, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’। একটি পুরোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ভরে গেল সুখের পায়রায়। দুঃখের দিনে তাঁদের দেখা মেলেনি।

সংসদীয় গণতন্ত্রে একজন জনপ্রতিনিধি একজন নেতা। কিন্তু তিনি আইনের ঊর্ধ্বে নন। আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। আলোচ্য আইনপ্রণেতার বিরুদ্ধে মানব পাচার ও অবৈধ অর্থ পাচারের অভিযোগে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯ জুন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘কুয়েত সরকারের কাছ থেকে তথ্য না পেলে আমাদের পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়।’ কুয়েত সরকার তাদের বিধানমতো যা করার করবে। কিন্তু আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাজ কী? কুয়েত যদি কোনো তথ্য না দেয়, তাহলে কি সাংসদ নির্দোষ?

পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে উঁচু সাংবিধানিক পদের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে প্রায়ই তাঁদের আইনের জালে আটকাতে দেখা যায়। আমাদের দেশে সুখের পায়রারা প্রশাসনের প্রশ্রয় এবং রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়ে ধন্য হন। তাতে দলের নিবেদিত নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে এবং আইনের শাসনের প্রতিও আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক