ভারত কেন চীনের আগ্রাসী নীতির কবলে

ফাইল ছবি এএফপি
ফাইল ছবি এএফপি

সাম্প্রতিক সময়টা ভারত বেশ উপভোগ করছিল। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের কৌশলগত মিত্র হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ছড়ি ঘোরানো। অন্যদিকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক জোটে চীন রাশিয়ার সঙ্গে গাটছড়া বেঁধে রাজনীতি করা। ভারত একই সঙ্গে শ্যাম ও কুল দুটোই রক্ষা করে চলছিল। এ কারণেই ভারত এনআরসি, কাশ্মীর–সংক্রান্ত আইন রদসহ বেশ কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ রকম নীরবই ছিল। কিন্তু চীন ও নেপালের বেমক্কা আচরণে হকচকিত হয়ে পড়েছে ভারত।

চীনের না হয় ভারতের বিভিন্ন সময় সীমান্তে উত্তেজনা ছিল। কিন্তু তাই বলে নেপাল ভারতের দখলে থাকা ভূমি নিজেদের বলে মানচিত্র প্রকাশ করবে! সীমান্তে নেপালি রক্ষীদের হাতে ভারতীয় প্রাণ হারাবে! সর্বশেষ বিহার সীমান্তে একটি বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করে দিয়েছে নেপাল। শুধু ভারত কেন, কেউই ধারণা করতে পারেনি সীমান্তে নেপালের দিক থেকে কোনো চাপ আসতে পারে। এতটা চাপের মুখে ভারত সাম্প্রতিক সময়ে আর পড়েনি। এক পাশে চিরশত্রু পাকিস্তানকে নিয়ে চীন ও নেপাল সীমান্তে সংঘাত ও সংকট ভারতের জন্য বেশ অস্বস্তিকর।

হঠাৎ করেই যেন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি বদলে গেল। অথচ কিছুদিন আগেও দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একাধিপত্য ছিল। বিশেষ করে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি পুরোটাই কবজায় নেয় ভারত। এই অঞ্চলের রাজনীতিতে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করত। কিন্তু জঙ্গিবাদ, তালেবানসহ নানা সংকটে জড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র পাকিস্তান নিজেই এখন অস্তিত্ব নিয়ে লড়ছে। পাকিস্তানের অখণ্ডতাই এখন সংকটের মুখে রয়েছে।

এ অবস্থায় সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধকালে দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন মিত্র হিসেবে ভারত আবির্ভূত হয়। ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের অলিখিত মিত্রতার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল এই অঞ্চলে চীনের প্রবেশ ঠেকানো। স্নায়ুযুদ্ধের পর মার্কিন আধিপত্যের বিপরীতে মূল চ্যালেঞ্জ ছিল মুসলিম বিশ্ব আর চীন। মুসলিম বিশ্বকে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ দিয়ে ঘায়েল করা গেছে। তবে চীনকে বাগে আনা সহজ ছিল না যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। চীনকে দমাতে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা।

বিপরীতে চীনও চারদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যূহ ভেঙে বের হয়ে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করতে চাইছে। এর প্রথম ধাপে চীন অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে অনেক আগেই। এখন সামরিক মহড়া দেওয়ার পালা। চীনের সামরিক সক্ষমতা আছে। প্রয়োজন শুধু মাঠপর্যায়ে এর প্রয়োগ করে সবাইকে জানান দেওয়া। রাশিয়া ছাড়া কমবেশি সব প্রতিবেশীর সঙ্গেই চীনের সীমান্ত বিরোধ আছে। মধ্য এশিয়ার তুর্কমেনিস্তান ও তাজিকিস্তান, ভিয়েতনামের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ থাকলেও এরা চীনের জন্য হুমকি নয়। বরং এদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ালে ক্ষতিই বেশি হবে। কারণ, সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারে। তাই এমন একটি দেশের প্রয়োজন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি উপস্থিত হতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে চীনের জন্য সহজ শিকার হচ্ছে ভারত।

লওয়ান ভ্যালি নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। ছবি: এএফপি
লওয়ান ভ্যালি নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। ছবি: এএফপি

প্রথমত, ভারত সামরিক শক্তিতে চীনের থেকে পিছিয়ে। চীনের আঞ্চলিক স্বার্থের জন্য হুমকিও বটে। রোহিঙ্গা সংকটের সময় ভারত চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মিয়ানমারে উপস্থিত ছিল। কিন্তু চীন–ভারত সংঘাতে ভারতের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি হস্তক্ষেপের আগে দর–কষাকষি করবে। এ ক্ষেত্রে ভারতকে বড় ধরনের ছাড় দিতে হবে। এমনও হতে পারে ভারতকে সহায়তার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ সাগরে চীনকে প্রতিরোধের জন্য আন্দামানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের প্রস্তাব দিতে পারে। এতে ভারত পড়বে উভয়–সংকটে। উত্তরে চীনকে ঠেকাবে না সমুদ্রসীমা যুক্তরাষ্ট্রকে ছেড়ে দেবে?

এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আগ্রাসী নীতির বিপরীতে দুই দশক ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে চীন প্রতিবেশীদের ভারতের কবজা থেকে বের করে নিয়েছে। শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বিনা শর্তে সব বিষয়ে ভারতকে সমর্থন করে না। পাকিস্তানের সঙ্গে চিরবৈরিতা। ভুটানও এখন আর আগের মতো ভারতের ঘনিষ্ঠ নয়। বাকি রইল নেপাল ও বাংলাদেশ। সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক থাকলেও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে ভারতের ব্যাপারে সন্দেহ ও অবিশ্বাস রয়েছে। দেশের নাগরিকদের একটি বড় অংশ মনে করে বাংলাদেশ ভারতকে নানা ক্ষেত্রে অনেক ছাড় দিলেও এর বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে তেমন কিছুই পাচ্ছে না।
তা ছাড়া ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিবেশী দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ আছে। যেমন, নেপালের কংগ্রেস সরকার ভারতের অধিক আস্থাভাজন ছিল। বামপন্থীরা সরকার গঠন করলে অবস্থা বদলাতে শুরু করে; নেপালের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধ শুরু হয়। সীমান্ত সমস্যা, সংবিধান সংস্কারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে নেপালের বর্তমান সরকার ভারতীয় সরকারকে আমলে নেয়নি। এখন ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় বন্ধুহীন। চীনের জন্য এটা ভারতকে চাপে ফেলার মোক্ষম সময়। চীন এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একাধিপত্যের অবসানের জন্য চীন বেছে নিয়েছে নেপালকে, যাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশ্ন উঠবে না বলে চীন ভাবছে। চীন নেপালকে সঙ্গে পেয়েছে এক রেল করিডোর নির্মাণ করে দিয়েই। পাকিস্তান বা বাংলাদেশ সীমান্তে ভারত যতটা আগ্রাসী ভূমিকায় থাকে, নেপাল সীমান্তে সেটা সম্ভব নয়।

সম্প্রতি লাদাখের গালওয়ান ভ্যালিতে ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। ফাইল ছবি রয়টার্স
সম্প্রতি লাদাখের গালওয়ান ভ্যালিতে ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। ফাইল ছবি রয়টার্স

সব মিলিয়ে ভারত বেশ বেকায়দায় আছে। ভারতের পক্ষে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া সম্ভব নয়। কারণ, ভারত চীনের সঙ্গে ব্রিকসের সদস্য। সাংহাই কো–অপারেশনে যুক্ত হয়েছে ২০১৭ সালে। বিশাল ঋণের প্রলোভন আছে। জলবায়ু রাজনীতিতেও চীনের সঙ্গে জোট বেসিক গঠন করেছে। যুদ্ধ হলে ভারতের ভারসাম্যের নীতি বদলে যাবে। পুরোপুরিই যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়তে হবে। আর সংঘাত তখন একাধিক ফ্রন্টে ছড়িয়ে পড়তে পারে। একাধিক ফ্রন্টের লড়াই ভারতকে বিপাকে ফেলে দেবে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চীন বা ভারত কেউই যুদ্ধে জড়াবে না। যুদ্ধ হবে না জেনেই চীন ভারতকে চাপে রাখতে লাদাখে হামলা করেছে। চীনের এই নীতির প্রথম উদ্দেশ্য, ভারতকে চাপে রেখে দক্ষিণ চীন সাগরসহ বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সরিয়ে আনা। ভারত যদি দক্ষিণ চীন সাগর থেকে ভারত মহাসাগরে চীনকে প্রবেশ করতে দেয়, তবে সীমান্তের সমস্যা এমনিতেই মিটে যাবে। ভারতের বাজারে চীনকে বড় বড় ব্যবসা করতে দিলে চীন কোনো সমস্যাই করবে না। চীন শুধু ভারতকেই চাপে রাখতে চাইছে না, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবও প্রতিহত করতে চাইছে।

অনেক দিন ধরেই বলাবলি হচ্ছে, বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আসছে। ক্ষমতার ভর অনেকটাই বেইজিংয়ের দিকে সরে যাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে চীন অনেকটাই বিশ্বকে দখলে নিয়েছে। এখন সামরিক শক্তি প্রকাশের পালা। ভারতই চীনের আগ্রাসী সামরিক শক্তির প্রথম শিকার হতে পারে। চাপের মুখে ভারত চীনের বশে এলে সব সমস্যা চুকে যাবে। কিন্তু ভারত যদি এ পথে রাজি না হয়, তবে তো যুদ্ধের পথ খোলাই রইল।

মারুফ মল্লিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক