চিকিৎসকদের সুরক্ষা

কোভিড–১৯ মহামারি চলাকালে চিকিৎসকদের সুরক্ষা সরঞ্জাম পিপিই ও এন-৯৫ মাস্ক নিয়ে শুরু থেকেই অনেক অভিযোগ উচ্চারিত হয়েছে। গতকাল প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে এমন ধারণা স্পষ্টতর হলো যে এ ক্ষেত্রে গুরুতর অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়ে থাকতে পারে।

একটি গুরুতর অনিয়ম সুস্পষ্ট—চিকিৎসকদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন চতুর্থ ধাপের পিপিই, কিন্তু তাঁদের সরবরাহ করা হয়েছে প্রথম ধাপের পিপিই, যা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ঝুঁকি দূর করার উপযোগী নয়। এই মানের পিপিই কেনা হয়েছে এক লাখের বেশি এবং সেগুলো ইতিমধ্যে ৬৩ জেলায় পাঠানো হয়েছে। সুরক্ষার উপযোগী নয়, এই মানের এতসংখ্যক পিপিই কেনা হয়েছে বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দামে।

আরও গুরুতর ও বিপজ্জনক বিষয় হলো পিপিইগুলোর গুণমান যাচাই না করেই চিকিৎসকদের মধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে। পিপিইর মান যাচাইয়ের জন্য পাঁচ সদস্যের যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তার অন্তত দুজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেছেন, পিপিই কেনাকাটা সম্পর্কে তাঁদের কিছুই জানানো হয়নি।

দেশে এ পর্যন্ত ৪৫ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়ে এবং উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। সংক্রমিত হয়েছেন ১ হাজার ৯৭ জন। আক্রান্ত নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা আরও বেশি—প্রায় আড়াই হাজার। চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মী মিলিয়ে মোট আক্রান্ত হয়েছেন সাড়ে তিন হাজার জন। এ অবস্থার প্রধান কারণ নিম্নমানের সুরক্ষা সরঞ্জাম। কার্যকর অস্ত্রশস্ত্র ও সুরক্ষা বর্ম ছাড়া যেমন কোনো সৈনিককে যুদ্ধে পাঠানো যায় না, তেমনই সংক্রামক রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের মানসম্পন্ন সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ না করে দায়িত্ব পালন করতে বলা অন্যায়। চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের সঙ্গে সেই অন্যায় করা হয়েছে। সুরক্ষার উপযোগী নয়, এমন নিম্নমানের পিপিই ও এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ করে তাঁদের মৃত্যুর ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

এতসংখ্যক চিকিৎসকের মৃত্যু ও আক্রান্ত হওয়া অনিবার্য ছিল না। সুরক্ষা নিশ্চিত করা হলে তাঁদের সংখ্যা অনেক কম হতে পারত। এন-৯৫ মাস্ক ও পিপিই নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করতে হবে। প্রমাণিত দুর্নীতিবাজদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সব সুরক্ষাসামগ্রীর গুণগত মান পরীক্ষার লক্ষ্যে গঠিত কমিটির দায়িত্ব ছিল সব পিপিইর মান যাচাই করে লিখিত মতামত পেশ করা। কমিটি কেন এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলো, সে জন্য কে বা কারা দায়ী, তা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে ৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানীর মহাখালীতে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের জন্য যে বিশেষ অস্থায়ী হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার কাজ কেন এখনো শেষ হলো না; ওই হাসপাতালের সরঞ্জাম ক্রয় নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো অংশের সঙ্গে ‘প্রভাবশালী ঠিকাদার’দের যোগসাজশ চলছে কি না—এসব তদন্ত করতে হবে। তাদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে।

অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করা না হলে কোভিড–১৯ মহামারি সামাল দেওয়া দুরূহ হয়ে পড়বে। এযাবৎ যে ব্যর্থতা, তার পেছনেও দুর্নীতির অভিসন্ধি ও ব্যক্তিগত স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা তাড়িত লোকজনের ভূমিকা কম নয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এ ধরনের লোকজনের দ্বারা দক্ষ ব্যবস্থাপনাও সম্ভব নয়। এসব চলতে পারছে জবাবদিহির অভাবে। অবিলম্বে জবাবদিহির উদ্যোগ নিতে হবে, অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে।

আমরা আর একজন চিকিৎসককেও হারাতে চাই না।