চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এগিয়ে আনবে করোনা?

লকডাউনের মধ্যে নেটফ্লিক্সে দ্য ইমিটেশন গেম ছবিটি দেখলাম। অ্যালেন টিউরিং নামের একজন গণিতবিদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানদের আক্রমণকৌশলের নির্দেশনাসংবলিত একটি কোড ল্যাঙ্গুয়েজ ‘অ্যানিগমা’ ডিকোড করতে গিয়ে একটি মেশিন আবিষ্কার করেন। আধুনিক যে কম্পিউটার, সেই মেশিনের ওপর ভিত্তি করেই তা গড়ে উঠেছে। বর্তমানে যে ‘মেশিন ল্যাঙ্গুয়েজ’, ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’র কথা বলা হচ্ছে, তারও স্বপ্নদ্রষ্টা এই অ্যালেন টিউরিং। সে সময়ের লোকজন অবশ্য তাঁর এই ধারণাগুলোকে মোটেই পাত্তা দেননি।

বলা হয়ে থাকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ‘অ্যানিগমা’ ডিকোড করার মাধ্যমে তিনি যুদ্ধকে প্রায় দুই বছর কমিয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। ব্রিটিশ বাহিনী তখন এই গোপন সংকেত ডিকোড করার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছিল। ‘প্রয়োজন সব আবিষ্কারের জননী’—এর এক যথার্থ দৃষ্টান্ত এটি।

যুদ্ধ না হলেও আমরা এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। মানুষ মরছে এক অদৃশ্য শত্রুর আঘাতে। আপাতত বাঁচার উপায় ঘরে বসে থাকা। কিন্তু ঘরে বসে তো আর দুনিয়া চলে না। বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন। কিন্তু কবে তার ফল মিলবে, তা বলা কঠিন। এমন একটি পরিস্থিতিতে ঘরে বসে কীভাবে কাজ করা যাবে, তা নিয়ে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হচ্ছে।

বেশ কিছুদিন ধরে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের একটি ধারণা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমহলে ব্যাপক আলোচনায় আসছে। এই বিপ্লবের মূল উপাদান কম্পিউটার আর তথ্যপ্রযুক্তি। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবোটিকস, থ্রিডি প্রিন্টিং, ইন্টারনেট অব থিংস, ফাইভ-জি প্রযুক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা। এর পাশাপাশি ন্যানো টেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা বিকল্প জ্বালানির মতো বিষয়গুলোও আলোচনায় আসছে।

এই নতুন প্রযুক্তিগুলোর কয়েকটি ব্যবহার করে আমাদের প্রচলিত অফিসের ধারণা ও সংস্কৃতিতে কিছু পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। করোনা মহামারি শুরুর আগ থেকেই হোম অফিস বা বাড়িতে বসে কাজ করা বা এ ধরনের কিছু ধারণা জনপ্রিয় হতে শুরু করেছিল। ‘গুগল’ অফিসের ধারণাটিও জনপ্রিয়। ঢাকার গ্রামীণফোন অফিসটি এই আদলে করা। সেখানে ঢুকলে দেখবেন, বড় কর্মকর্তাদেরও কোনো নির্দিষ্ট অফিস নেই। অফিস নিজের ল্যাপটপে আর সকালে গিয়ে আপনি যে টেবিলে বসবেন, সেটাই অফিস। নিজের জন্য একটা লকার থাকতে পারে বড়জোর। অনেকগুলো মিটিং রুম আছে, যেখানে পূর্বনির্ধারিত একটি সময়ে একেকটি বিভাগের সদস্যরা সারা দিনের কাজের সমন্বয়সাধন, তথা দেখা–সাক্ষাতের জন্য আলোচনায় বসেন। এ ছাড়া বাকি যোগাযোগ অধিকাংশ সময় অনলাইনেই হয়ে থাকে বা ই-মেইলে।

‘হোম অফিস’-এর ধারণাটি জনপ্রিয় ও কার্যকর বিবেচিত হওয়ায় কিছু বড় বড় কোম্পানি তাদের ভাড়া করা বড় অফিস ছেড়ে দিয়ে অফিস ছোট করে ফেলে এবং অধিকাংশ কর্মচারীকে বাড়িতে বসে কাজ করার অনুমতি দেওয়া শুরু করে। এতে অফিস ভাড়া সাশ্রয় হলো, একই সঙ্গে বাঁচল অফিসে আসা-যাওয়ার সময়। এতে ট্রাফিক জ্যামের ওপরও চাপ কমবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকায় কর্মরত একজন মধ্যম সারির সরকারি কর্মকর্তার অভিজ্ঞতার কথা বলি। তাঁর ধারণা, সপ্তাহে অফিস সময়ের প্রায় অর্ধেকই নাকি চলে যায় মিটিংয়ে যোগ দিতে গিয়ে, এই অফিস থেকে ওই অফিসে দৌড়াতে দৌড়াতে আর ট্রাফিক জ্যামে আটকে থেকে। করোনার সময়ে বাধ্য হয়ে হোম অফিসের ধারণাকে কাজে লাগাতে হয়েছে। এখন এই বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে সরকারি অফিসগুলোর ভার্চ্যুয়াল সুযোগ-সুবিধা যদি বাড়ানো হয়, তবে তা কাজের কাজ হবে।

করোনার অভিজ্ঞতা শিক্ষাক্ষেত্রেও একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা ঘটাতে পারে। ইতিমধ্যেই অনেক পরিবর্তন দৃশ্যমান। হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের বিশালায়তন লাইব্রেরি আর সেখানে থাকা দুষ্প্রাপ্য সব বইয়ের জন্য গর্ব করে। কিন্তু সামনে এমন দিন আসতে যাচ্ছে, যখন ছাপা বইয়ের বদলে ই-বুক ও ই-জার্নালই হয়ে উঠবে মূল উৎস। আজকালকার ছেলেমেয়েদের মুঠোফোনেই থাকে ডজনখানেক বইয়ের ই-কপি।

অনলাইন কোর্স আর পাঠদানের পদ্ধতি আপন গতিতে চলছিল। তবে এই করোনাকালে এর গুরুত্ব বেড়েছে। প্রায় এক যুগ আগে থেকেই ‘গুগল ক্লাসরুম’ বা ‘ব্ল্যাকবোর্ড’জাতীয় অনলাইন শিক্ষাদান প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। আজকাল এর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এসবের ওপর ভিত্তি করে ‘কোর্সেরা’ বা ‘এডেক্স’-এর অনলাইন কোর্সগুলো ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়। এই প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহার এত দিন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে এই করোনাকালে এই প্রযুক্তিগুলোর ব্যাপক ব্যবহার আশা করা হচ্ছে, এমনকি স্কুল পর্যায়েও। ‘হোম স্কুলিং’ পদ্ধতিটি অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত দেশে বহু যুগ ধরেই প্রচলিত। করোনাকালে এ ধারণার ব্যাপক প্রসার ঘটবে নিঃসন্দেহে। ঢাকার অনেক নামীদামি স্কুল তো এখন উঠেপড়ে লেগেছে এই প্রযুক্তিগুলো আয়ত্ত করতে। কেননা, এই করোনাকালে ছাত্রছাত্রী আর অভিভাবকেরা আন্দোলনে নেমেছেন, ‘নো ক্লাস, নো টিউশন ফি’!

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এখনই কাম্য। বহু যুগ আগে আবিষ্কৃত সেই আলেক্সান্ডার ফ্লেমিংয়ের অ্যান্টিবায়োটিক যেখানে ব্যাকটেরিয়া নির্মূলে অব্যর্থ; সেখানে সার্স, মার্স ও ইবোলার তাণ্ডবের পরও ভাইরাস নির্মূলে তেমন কিছু করা যায়নি। এবার করোনায় যদি কিছু একটা হয়! একইভাবে রোবটপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়তে পারে রোগীর সেবাশুশ্রূষায়। আজ থেকে আরও এক যুগে আগেই দেখেছিলাম জাপানে বৃদ্ধদের সেবাশুশ্রূষায় রোবটের ব্যবহার। এই করোনাকালে এর চেয়ে মোক্ষম উপকারী প্রযুক্তি আর কী হতে পারে?

শিল্পক্ষেত্রে রোবটের ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াও বেগবান হতে পারে। কেননা মানুষের সংস্পর্শ যত এড়ানো যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী আপনার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করতে পারে উড়ন্ত ড্রোন। ড্রাইভারবিহীন গাড়ি তো ইতিমধ্যেই বাজারে এসে গেছে।

সবকিছু মিলিয়ে এই প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে, করোনার কারণে কি চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আরও বেগবান হয়ে উঠবে? এখানেও সেই একই কথা, প্রয়োজন সব আবিষ্কারের জননী।

ড. মো. সিরাজুল ইসলাম: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর ইনফ্রাস্ট্রাকচার রিসার্চ অ্যান্ড সার্ভিসেসের পরিচালক