নতুন নীতি এনজিওগুলোকে চিন্তায় ফেলবে

যুক্তরাজ্য আবারও বৈদেশিক সাহায্যের পুরোনো ধারায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন থেকে যেকোনো সাহায্যের শর্তই হবে সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের রাজনৈতিক এবং পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্যপূরণ। গত দুই দশকে এই যোগসূত্র ছিল কিছুটা পরোক্ষ । ফলে, বৈশ্বিক পরিসরে ঠিক করা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহের (এসডিজি) মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক লক্ষ্য অর্জনের উদ্যোগে অর্থায়ন অগ্রাধিকার হারানোর আশঙ্কা সত্য হতে চলেছে। বরিস জনসন কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বে আসীন হওয়ার সময় থেকেই বৈশ্বিক পরিসরে কাজ করা ব্রিটেনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা বা আইএনজিওগুলো এ রকম আশঙ্কা করছিল।

১৬ জুন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ঘোষণা করেছেন যে আগামী সেপ্টেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক উন্নয়নসহায়তা বিভাগ ডিএফআইডির বিলোপ ঘটবে এবং বৈদেশিক সহায়তার বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হবে। তিনি পার্লামেন্টে বলেন, ‘এর লক্ষ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক উদ্যোগে আমাদের সাহায্যকে কূটনীতির সঙ্গে একীভূত করা।’ তাঁর এই ঘোষণায় আইএনজিওগুলো অনেকটাই ক্ষুব্ধ ও হতাশ।

সাহায্যসেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো এই সিদ্ধান্তের ধাক্কায় বিশেষভাবে হতাশ এ কারণে যে সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটের মধ্যেই ব্রিটেন এ রকম একটি সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের পথে হাঁটছে। চলমান বৈশ্বিক মহামারি বা জনস্বাস্থ্যগত সংকটের পাশাপাশি অর্থনৈতিক মন্দার পদধ্বনি যেভাবে অনুভূত হচ্ছে, তাতে দারিদ্র্যপীড়িত ও নানা ধরনের যুদ্ধ-সংঘাত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার কোটি কোটি বিপন্ন মানুষের জরুরি মানবিক সহায়তা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে বলেই তাদের আশঙ্কা। বাংলাদেশের বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, এনজিও এবং নাগরিক গোষ্ঠী সিএসওগুলোর ওপর এই পরিবর্তনের কিছু না কিছু প্রভাব পড়াই স্বাভাবিক। কেননা, বাংলাদেশ ব্রিটিশ উন্নয়নসহায়তার অন্যতম সুবিধাভোগী।

যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম আইএনজিও অক্সফাম বলছে, এই পরিবর্তন বৈশ্বিক দারিদ্র্যবিরোধী লড়াইয়ের ক্ষতি করবে। ডিএফআইডি ও পররাষ্ট্র দপ্তরের একীভূতকরণকে ‘ভয়ানক’ অভিহিত করে বৈশ্বিক নাগরিক সংগঠন গ্লোবাল জাস্টিস বলেছে, এর ফলে ব্রিটেন দুই যুগ পেছনে ফিরে যাচ্ছে, যখন ব্রিটিশ সাহায্য ছিল ব্রিটেনের ব্যবসায়িক স্বার্থের অধীন। অন্য কয়েকটি এনজিও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে বাণিজ্য ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাওয়ার কারণে বিদেশি সরকারগুলোকে সাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্রিটেন এখন মানবাধিকারের রেকর্ড উপেক্ষা করবে।

বিরোধী দলগুলো এবং ক্ষমতাসীন দলের উদার বা মধ্যপন্থী এমপিরাও একই রকম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী কনজারভেটিভ পার্টির ডেভিড ক্যামেরন এবং লেবার পার্টির গর্ডন ব্রাউন ও টনি ব্লেয়ারও এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। মি. ক্যামেরনের ভাষায়, এই পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের আলোচনায় ব্রিটেনের মর্যাদা ও বিশেষজ্ঞ গুণের স্বীকৃতি ক্ষুণ্ন হবে এবং কণ্ঠ দুর্বল হবে। বৈদেশিক সহায়তার বিষয়টিকে আলাদাভাবে দেখভালের জন্য ভিন্ন মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন ১৯৬৪ সালে। কিন্তু তারপর থেকে কনজারভেটিভ পার্টি ও লেবারের মধ্যে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকবার এ রকম একীভূতকরণ ও আলাদা দপ্তর হিসেবে আবির্ভাবের ঘটনা ঘটে। শেষবার ১৯৯৭ সালে টনি ব্লেয়ার এই স্বতন্ত্র ও স্বাধীন দপ্তর ডিএফআইডি গঠনের পর দুজন টোরি প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন ও থেরেসা মে তা আর বদলাননি।

প্রধানমন্ত্রী জনসন পার্লামেন্টারি বিতর্কে এসব সমালোচনার যে জবাব দিয়েছেন, তাতে এই পরিবর্তনের আসল চেহারাটা কেমন হবে, তা মোটামুটি স্পষ্ট হয়েছে। দারিদ্র্য দূরীকরণের চেয়ে যুক্তরাজ্যের স্বার্থ এখন থেকে বেশি গুরুত্ব পাবে, এমন সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, এখন একটি সংহত নীতি ও কৌশল অনুসরণের সুযোগ তৈরি হবে। বিদ্যমান বিভাজনে দেখা যেত, বিভিন্ন রাজধানীতে ব্রিটিশ কূটনীতিকেরা এক কথা বলছেন, আর পরে দেখছেন যে ডিএফআইডির সহকর্মীরা সেখানে অন্য কথা বলে এসেছেন। বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে তিনি বলেন, ‘একটি দেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে দেখা করে তাঁর প্রতিপক্ষকে নির্মূল না করার অনুরোধ জানিয়ে গণতন্ত্রের জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের বলার কোনো মানেই হয় না, যদি পরদিন ব্রিটিশ সরকারের আরেক প্রতিনিধি ২৫ কোটি পাউন্ডের কেটি চেক নিয়ে সেখানে হাজির হন। আমাদের একগলায় কথা বলতে হবে; বিদেশে যুক্তরাজ্যকে অবশ্যই সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এবং শক্তিশালী উপায়ে কথা বলতে হবে এবং আমরা সেটাই করতে যাচ্ছি।’

তাঁর সরকারের উন্নয়নসহায়তার অগ্রাধিকার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী জনসন বলেন, ‘আমরা জাম্বিয়াকে যতটা সাহায্য দিই, ততটাই দিই ইউক্রেনকে। অথচ ইউরোপীয় নিরাপত্তার জন্য পরেরটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আমরা তানজানিয়াকে যতটা সহায়তা দিই, তা পশ্চিম বলকানের ছয়টি দেশের সমান, যে দেশগুলো রাশিয়ার অনধিকার চর্চার ঝুঁকিতে আছে। এসব সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা যা-ই থাকুক না কেন, তা বিচারের ভার এককভাবে কোনো মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই। ফলে আমরা ডান হাত এবং বাঁ হাত দুটোকেই স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার অন্তর্নিহিত ঝুঁকি সহ্য করে চলেছি।’ মি. জনসন ঘোষণা করেন যে এই দুই দপ্তর একীভূত হওয়ার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেবেন কোন দেশ সহায়তা পাবে, আর কোন দেশে তা বন্ধ হবে। প্রতিটা দেশের বিষয়ে কৌশলগত সিদ্ধান্ত হবে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে, যার সভাপতি প্রধানমন্ত্রী। তাঁর এই বক্তব্যে কারা লাভবান হতে পারেন আর কারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, সে সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা মেলে।

যুক্তরাজ্য হচ্ছে সেই অল্প কটি ধনী দেশের অন্যতম, যারা সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ বা এমডিজির প্রাক্কালে জাতীয় আয়ের শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ দরিদ্র দেশগুলোর জন্য বরাদ্দের অঙ্গীকার পূরণ করেছে। ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বরাদ্দ ৪০০ কোটি পাউন্ডের মতো আর ডিএফআইডির জন্য বরাদ্দ ছিল প্রায় তার চার গুণ, ১ হাজার ৫০০ কোটি পাউন্ড। প্রধানমন্ত্রী জনসন অবশ্য বৈদেশিক উন্নয়নসহায়তার বরাদ্দের এই হার বজায় রাখার কথা বলেছেন। সমালোচকেরা অবশ্য তাঁর এই আশ্বাসে আশ্বস্ত হতে পারছেন না। কেননা, ক্ষমতাসীন টোরি দলের অতিরক্ষণশীল অংশটি বৈদেশিক সাহায্যের খরচ কমানোর জন্য অনেক দিন ধরেই চাপ দিয়ে আসছে। তা ছাড়া ইতিমধ্যেই অভিযোগ উঠেছে, আফ্রিকার দেশগুলোর বাণিজ্যিক সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ হিসেবে বৈদেশিক সহায়তার অর্থ খরচ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে অন্তত তিনটি পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে—১. ইউক্রেন ও বলকান দেশগুলোর মতো ইউরোপীয় প্রতিবেশীরা আফ্রিকা ও অন্যান্য অঞ্চলের দেশগুলোর চেয়ে কৌশলগত কারণে বেশি গুরুত্ব বহন করে; ২. গণতন্ত্র মানবিক সহায়তা পাওয়ার একটি পূর্বশর্ত হতে পারে এবং ৩. যুক্তরাজ্যের বাণিজ্যিক স্বার্থ জাতীয় স্বার্থের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ সরকারব্যবস্থায় এই সংস্কারের কতটা প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়বে এবং তার রূপটা কেমন হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে বাংলাদেশ ব্রিটিশ উন্নয়নসহায়তার পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ১৯ কোটি পাউন্ড বা ২০০০ কোটি টাকার সহায়তার বেশির ভাগই অবশ্য বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে ব্যয় হয়ে থাকে। এ ছাড়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক এনজিও ব্র্যাকও ডিএফআইডির অর্থায়নে বিশ্বের বহু দেশে দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষা , স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে কাজ করে।

সুতরাং, বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও এবং নাগরিক গোষ্ঠী বা সিএসও হিসেবে পরিচিত সংগঠনগুলোর জন্য এটি একটি চিন্তার বিষয় হতে বাধ্য। এসব সংগঠন শুধু যে প্রান্তিক বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে কাজ করে, তা-ই নয়, তারা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে কিছুটা কর্মসংস্থানও করে।

কামাল আহমেদ, সাংবাদিক