এবার আমের সেই স্বাদ নেই কেন

কোভিড–১৯ মহামারির কারণে মানুষ প্রায় চার মাস ঘরে স্বেচ্ছাবন্দী। অথচ ফলের মৌসুম এসে গেছে। শ্রেষ্ঠ ফল আমের আস্বাদনে অবরুদ্ধ দশার একঘেয়েমি থেকে একধরনের পরিতৃপ্তি পাওয়ার প্রত্যাশায় ছিলাম। কিন্তু এ বছরের গোপালভোগ, রানিপসন্দ, ক্ষীরশাপাতি, হিমসাগর এমনকি ল্যাংড়া আমের স্বাদও হতাশ করল। সেই স্বাদ, গন্ধ, মিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে না। আমগুলোর প্রকৃত ঔজ্জ্বল্য নেই, পাকার সময়ের কোনো সামঞ্জস্য নেই; অধিকাংশ আমের গোড়ায় পচন।

এসবের কারণ প্রাকৃতিক। আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে মাটির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ুর প্রভাব। সূর্যকিরণ ও বৃষ্টিপাত আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলে। বছরের ঠিক কোন সময়ে কী পরিমাণ বৃষ্টিপাত হবে, আমের পরিপক্বতার সময়ে সূর্যকিরণ কেমন থাকবে ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে আমের সরসতা, মিষ্টতা, স্বাদ-গন্ধ, ঔজ্জ্বল্য, রোগমুক্ত থাকা ইত্যাদি। বিশেষ করে আমের মুকুল আসা ও আম পাকার সময় অতিরিক্ত বৃষ্টি, বাতাসে বেশি আর্দ্রতা আমের ফলন ও স্বাদগন্ধের ক্ষতি করে; রোগবালাইয়ের ঝুঁকিও বাড়ায়। মুকুল আসা ও আম পুষ্ট হওয়ার পর্যায়ে শুষ্ক জলবায়ুই আমের জন্য অনুকূল। বাংলাদেশে আমের এ রকম অনুকূল জলবায়ু থাকে বৃহত্তর রাজশাহীসহ মেহেরপুর, যশোর ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে। এসব অঞ্চলেই প্রধানত বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদিত হয়।

আশু ও মধ্য মৌসুমি জাতের আমের বৃদ্ধি ও পাকার সময় এপ্রিলের শেষ থেকে মের প্রায় শেষ পর্যন্ত। ল্যাংড়ার ক্ষেত্রে পুরো মে মাস। এ সময় আম উৎপাদনকারী জেলাগুলোতে সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টি হয় না। প্রচণ্ড রোদে মানুষ কষ্ট পেলেও রসাল ফল আমের মিষ্টতা সঞ্চয়ের প্রক্রিয়াটি এই খরতাপের মধ্যেই নীরবে ঘটতে থাকে। এ সময় ঘন ঘন বৃষ্টি হলে আমের ঔজ্জ্বল্য, সুবাস, সরসতা, মিষ্টতা ইত্যাদি কমে যায়।

উৎকৃষ্ট আম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত বৃহত্তর রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে মৌসুমি বায়ুর বৃষ্টিপাত শুরু হয় জুন মাসের শুরু থেকে। এপ্রিলের শেষ থেকে পুরো মে মাস অবধি প্রলম্বিত খরা এখানকার জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই দীর্ঘ খরা ও সূর্যতাপ উৎকৃষ্ট নানা জাতের আম উৎপাদনে প্রধান সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এ বছর এপ্রিলের শেষ দিক থেকে মে মাসজুড়ে ঘন ঘন বৃষ্টি-ঝড় লেগেই আছে। ৩৬ ঘণ্টার জন্যও একটানা রোদ আম উৎপাদনকারী অঞ্চলের আমবাগানগুলো পেয়েছে বলে জানা নেই। এরপর গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো আম্পান ঘূর্ণিঝড় এসে তছনছ করে দিয়ে গেল সাতক্ষীরা থেকে শুরু করে মেহেরপুর-রাজশাহী-নবাবগঞ্জের শত শত আমবাগান। আম্পানের কারণেও আমের গুণমানের অনেক ক্ষতি হয়েছে।

আমের পুষ্পায়ন, মুকুল থেকে ফল হলেও গুটি হওয়ার সময় বৃষ্টি হলে উৎকৃষ্ট ও রোগমুক্ত আমের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুষ্পায়নের সময় বৃষ্টি হলে পুষ্পরেণু ধুয়ে যায়। ফলধারণ প্রক্রিয়া ভীষণভাবে বিঘ্নিত হয়। শুধু তাই নয়, এ সময়ে বৃষ্টি হলে আমে হপার ও মিলিবাগ পোকার আক্রমণ ও অ্যানথ্রাকনোজ নামক রোগ হয়। এ বছর পুষ্পায়নের সময় মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি হয়েছে। আর আম পাকার সময় ঘন ঘন বৃষ্টিপাতের ফলে ভেজা অবস্থায় আম গাছ থেকে নামিয়ে না শুকিয়েই প্যাকেটজাত করে কুরিয়ারে তুলে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে আমে ডিপ্লোডিয়া ন্যাটোলেনসিস (Diplodia natalensis) নামক ছত্রাক ও সিডোমোনাস ম্যাঙ্গিফেরি (Pseudomonas Magniferae) নামক ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ হয়েছে; অনেক আম পচনের শিকার হয়েছে।

আম উৎপাদনকারী জেলাগুলোতে ইদানীং জেলা প্রশাসন বাগান থেকে আম সংগ্রহ ও বিপণনের দিনক্ষণ ঠিক করে দিচ্ছে। রাজশাহী জেলায় এ বছর ২০ মে গোপালভোগ, ২৮ মে ক্ষীরশাপাতি এবং ১০ জুন ল্যাংড়া আম সংগ্রহ ও কেনাবেচা শুরুর দিন ধার্য করা হয়। এসব দিন নির্ধারণ সঠিক ছিল না। এ বছরের জলবায়ু আম উৎপাদনের প্রতিকূল ছিল। স্বাভাবিক সময়ে গোপালভোগ পরিপক্ব হয় ২৫ মে থেকে। ক্ষীরশাপাতি ৭ জুনের আগে পরিপক্ব হয় না। ল্যাংড়া ১৫ জুনের আগে বাজারে আসা উচিত নয়।

আমের এই ক্যালেন্ডার স্বাভাবিক সময়ের জন্য। এ বছর ঘন ঘন বৃষ্টির কারণে আম পরিপক্ব হতে শুরু করেছে ওপরের তারিখগুলো থেকে অন্তত সাত থেকে দশ দিন পরে। অথচ আমরা লক্ষ করেছি, জেলা প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময়ে আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট জাতের আম বাগান থেকে সংগ্রহ করেছেন, যার অধিকাংশই ছিল অপরিপক্ব। এই আম খাওয়ার উপযোগী মাত্রায় পাকতে সময় লেগেছে। ফলে স্বাদ–গন্ধ কমে গেছে; অনেক আম রোগাক্রান্ত, বিশেষ করে পচনজাতীয় রোগ হয়েছে।

বাংলাদেশের আমভোক্তাদের আম কেনার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। প্রশাসনেরও উচিত জলবায়ুর দিকে দৃষ্টি রেখে আম সংগ্রহ ও কেনাবেচার সময় নির্ধারণ করা।

মাহবুব সিদ্দিকী স্থানীয় ইতিহাস, নদ-নদী ও

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবিষয়ক গবেষক