নার্সদের ওপর চাপ অনেক বেশি

>
ইসমত আরা পারভিন
ইসমত আরা পারভিন
ইসমত আরা পারভিন বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। বর্তমানে সেবা মহাবিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। নার্সিংয়ে বিএসসি পাস করার পর স্নাতকোত্তর লেখাপড়া করেছেন জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে। উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ায়। সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

প্রথম আলো: জরুরি স্বাস্থ্যকর্মী এবং সামনের সারির করোনাযোদ্ধা হিসেবে আপনারা কী অবস্থার মধ্যে রয়েছেন?

ইসমত আরা পারভিন: এই সংকটে যতটা ভালো থাকা যায়, ততটাই আছি। করোনাভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হচ্ছে। আমাদের ১ হাজার ৩০০-এর বেশি ছেলেমেয়ে আক্রান্ত। মারাও গেছেন ছয়জন। করোনা চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতাল হোক কিংবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স—সব জায়গাতেই ঝুঁকির মধ্যে নার্সরা কাজ করছেন। আক্রান্তও হচ্ছেন।

প্রথম আলো: করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে নার্সদের ঠিক কী কী দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে?

ইসমত আরা পারভিন: স্বাভাবিক সময়ে আমরা চিকিৎসকদের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী রোগীদের সেবা দিই, তাঁদের সুখ-সুবিধার দিকে খেয়াল রাখি। তবে এই পরিস্থিতিতে নার্সদের ওপর চাপ অনেক বেশি। যে রোগীর যা প্রয়োজন, রোগীর কাছে সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে তাঁকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সব কাজই নার্সদের করতে হয়েছে। আপনারা জানেন, দেশে নার্স-সংকট প্রকট। করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতেও এই সংকট আছে। নতুন পাঁচ হাজার নার্স নিয়োগ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাঁদের পদায়ন করা হচ্ছে সাধারণ হাসপাতালে। আরও কিছু সমস্যা শুরুর দিকে ছিল। তার কিছুটা আমরা কাটিয়ে উঠেছি। এখনো কাজ বাকি রয়েছে।

প্রথম আলো: শুরুতে কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন আপনারা?

ইসমত আরা পারভিন: চীনের উহানে কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পরপরই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত ছিল। আমরা প্রায় তিন মাস সময় পেয়েছিলাম। তখনই করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যকর্মীদের কী কী প্রয়োজন, সেটা হিসাব-নিকাশ করে সংগ্রহ করা যেত। করা হয়নি। যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিল, তখন দেখা গেল পিপিই নেই, এন-৯৫ মাস্কের অভাব। কোভিড-১৯ রোগীদের নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, নিয়ম হলো সাত দিন টানা হাসপাতালে কাজ করে ১৪ দিনের জন্য তাঁরা আইসোলেশনে থাকবেন। শুরুতে দেখা গেল, নার্সদের জন্য আইসোলেশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। চিকিৎসকদের জন্য হোটেল বরাদ্দের এক মাস পর নার্সরা পেয়েছেন। কোনো কোনো জায়গায় হোটেলে কক্ষ ফাঁকা থাকলেও নার্সদের সেখানে থাকার ব্যবস্থা করা হয়নি।

আমাদের এক সহকর্মী হাসপাতালের দায়িত্ব পালন শেষে বাসায় যাওয়ার পর দেখা গেল তাঁর স্বামীর কোভিড-১৯ পজিটিভ এসেছে। সহকর্মীর কোনো উপসর্গ ছিল না। পরে দেখা গেল, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আক্রান্ত। আমরা হাসপাতালে সেবা দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু আক্রান্ত হলে আমরা কোথায় যাব, তার কোনো খবর নেই। আমি অনেকের কাছে শুনেছি, আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নার্সদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বেসরকারি বেশ কিছু হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এমন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তা হওয়ার কথা ছিল না। আক্রান্ত হলে কর্তৃপক্ষকে তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে হবে। তাঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে কেন?

তবে এখন পিপিইর সংকট অনেকটাই কেটেছে। কিন্তু কোভিড-১৯-এর জন্য নির্ধারিত হাসপাতালের বাইরে নার্সদের সবাই কিন্তু এখনো পিপিই পাননি। আমাদের ছেলেমেয়েরা নিজেদের টাকায় পিপিই কিনছে। অন্তত ধুয়ে ব্যবহার করা যায়, এমন দুটো করে পিপিই নার্সদের দিতে পারে সরকার। এ নিয়ে আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি।

প্রথম আলো: কর্তৃপক্ষ তো বলছে এখন সমস্যা অনেকটাই সামলে নেওয়া গেছে...

ইসমত আরা পারভিন: পিপিইর সংকট পুরো মেটেনি। আরও সমস্যা আছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোয় রোগী ভর্তির সংখ্যা কমে যায়। বেসরকারি বেশ কিছু হাসপাতাল ও ক্লিনিকে আমাদের নার্সরা বেতন-ভাতা ঠিকমতো পাননি। অনেকের তো চাকরিই চলে গেছে। তাঁরা কী করবেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। রোগী ব্যবস্থাপনায় একটা ঘাটতি ছিল। সেটা এখনো আছে কিন্তু। তার পেছনেও অনেকগুলো কারণ আছে।

প্রথম আলো: ঘাটতিটা কোথায়?

ইসমত আরা পারভিন: এই যে একটা মহামারি, সেটা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সে ব্যাপারে প্রশিক্ষণের দরকার ছিল। আমরা সময় পেয়েছি, ফলে এই সুযোগটা কাজে লাগানো যেত। কিন্তু তা হয়নি। আমরা কোনো প্রশিক্ষণ পেলাম না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা কী হবে, সে সম্পর্কে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। নার্সদেরও তো একটা অধিদপ্তর আছে। আমাদের অধিদপ্তর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়নি। নার্সিং পড়ার সময় আমরা সংক্রামক ব্যাধির রোগীদের সেবা কীভাবে দিতে হবে, তা নিয়ে যে লেখাপড়া করেছিলাম, তার ওপর ভর করে আর মনের জোরে সেবা দিচ্ছি।

তারপর ধরুন, হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনার কাজটা শুধু তো চিকিৎসকদের নয়, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিটি হাসপাতালে একটি কমিটি করার ব্যাপারে নির্দেশ দিতে পারত। ওই কমিটিতে চিকিৎসক, নার্স থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্নতাকর্মী পর্যন্ত যাঁরা যাঁরা রোগীর সেবায় কাজ করবেন, তাঁরা যুক্ত থাকতে পারতেন। এতে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় ও রোগী ব্যবস্থাপনাটা ভালো হতো। বাড়তি টাকাকড়িও খরচ হতো না। সত্যি কথা বলতে কি, আসলে হাসপাতালগুলো রোগীকেন্দ্রিক হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোর বড় অংশই রোগীকেন্দ্রিক নয়।

প্রথম আলো: কোভিড-১৯-এর জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে নার্সদের ডেকেও পাওয়া যায় না, তাঁরা একেবারেই অমনোযোগী—এমন অভিযোগ অনেকের, কী বলবেন?

ইসমত আরা পারভিন: এমন অভিযোগ আমিও শুনেছি। তবে আমার মনে হয়, ব্যক্তির নিজস্ব সমস্যা ও দোষ। সব পেশাতেই ভালো-মন্দ আছে। নার্সিংও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে আমি মনে করি, বেশির ভাগ নার্স রোগীবান্ধব।

প্রথম আলো: দক্ষ নার্স, প্রশিক্ষিত নার্সের সংকটের কথা আমরা শুনি...

ইসমত আরা পারভিন: দেখুন, সরকার আমাদের জন্য অনেক করেছে। তারপরও এই সংকট থেকে যাচ্ছে। তার কারণ, সরকার যে সিদ্ধান্ত নেয় বা যে নির্দেশনা দেয়, সেটা বাস্তবায়নে সমস্যা ও আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। এখন বছরে প্রায় ২০০ নার্স দেশের বাইরে বিষয়ভিত্তিক উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে যাচ্ছেন। বিষয়ভিত্তিক বলতে কেউ আইসিইউ, কেউ সিসিইউতে কীভাবে সেবা দেবেন, তার ওপর প্রশিক্ষণ। এসব প্রশিক্ষণে যাঁরা যোগ্য, তাঁদের সুযোগ পাওয়ার কথা। কিন্তু সব সময় যোগ্যতা অনুযায়ী প্রার্থী বাছাই করা হচ্ছে না। ফলে এসব প্রশিক্ষণ থেকে যে ফল পাওয়ার কথা, সেটা পাওয়া যাচ্ছে না।

মুগদায় নার্সিং এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চে নার্সদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ আছে। কিন্তু সেখানে শিক্ষক-সংকট। আবার যোগ্যতা আছে, এমন শিক্ষক সব সময় নিয়োগও পাচ্ছেন না। বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের দায়িত্ব নার্সিং কলেজগুলোর শিক্ষার মান তদারক করা। সরকারি কলেজগুলো তবু নজরদারিতে থাকে, বেসরকারিগুলোর ওপর খেয়াল নেই বললেই চলে। সরকারি নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার পাশাপাশি হাসপাতালে কাজ করেন। হাতে-কলমে শেখেন। বেসরকারি নার্সিং কলেজগুলোর সেই সুযোগ কোথায়? তারা হাসপাতাল পাবে কোথায়? যদিও অনেকগুলো শর্ত পূরণের পর নার্সিং কলেজের অনুমোদন পাওয়ার কথা, সেই শর্ত কি সবাই পূরণ করছে?

প্রথম আলো: নার্সিংয়ের ভবিষ্যৎ কী দেখেন?

ইসমত আরা পারভিন: পেশার মর্যাদা দিলে ভালো ছেলেমেয়েরা আসবে। পুরো সেবা খাতে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেখুন, আমরা একটা সময় দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত হওয়ার জন্য সংগ্রাম করেছি। সরকার সে দাবি মেনে নিয়েছে। সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু আমাদের এখনো ফাউন্ডেশন ট্রেনিং দেওয়া হয় না। একজন নার্সের কাছ থেকে আপনি তখনই আন্তর্জাতিক মানের সেবা পাবেন, যখন সে যথাযথ প্রশিক্ষণ পাবে। বিদেশে এই পেশার এত চাহিদা। এই সুযোগটা নিতে আমাদের বেশি কিছু নয়, ইংরেজিতে একটু দক্ষতা আর কিছু আদবকায়দা শেখা প্রয়োজন। কিন্তু সেদিকে কেউ নজর দিচ্ছে না। এটা ফাউন্ডেশন ট্রেনিং নার্সদের অনেক আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে পারত বলে আমি বিশ্বাস করি।

গবেষণার সুযোগও আমাদের নেই। এই যুগে যা কিছু করি না কেন, সেটা ‘এভিডেন্স বেইজড’ হওয়া দরকার। সেই সুযোগ আমরা পাচ্ছি না। আরেকটা কথা বলতে চাই। একসময় আমাদের নার্সিং পরিদপ্তর ছিল। এখন অধিদপ্তর হয়েছে। কিন্তু সেখানে পেশাজীবী নার্সদের প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে। নার্সদের যদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা না যায়, তাহলে ফল মিলবে না। আমাদের মধ্যে কি যোগ্য নার্স নেই? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাতেও আমাদের নার্সরা কাজ করেছেন। নার্সদের তাঁদের কথা বলতে দিন, রোগী ব্যবস্থাপনা নিয়ে তাঁদের পরামর্শগুলো আমলে নিন। এতে সুফল পাওয়া যাবে।

প্রথম আলো: ধন্যবাদ।

ইসমত আরা পারভিন: আপনাকেও ধন্যবাদ।