গবেষকদের কথা শুনতে পাচ্ছি কি আমরা

রয়টার্স প্রতীকী ছবি
রয়টার্স প্রতীকী ছবি

২৪ জুন খবর বের হলো, দেশে এক বছরের ব্যবধানে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ৮ হাজার ২৭৬। আগের চেয়ে বৃদ্ধি প্রায় ১১ শতাংশ। পত্রিকা বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য এটা। শুধু ব্যাংক আমানতে কোটি টাকা ও তার বেশি আছে যাঁদের এটা তাঁদের হিসাব। বলাবাহুল্য, এর বাইরেও ধনী এবং অতিধনী মানুষ অনেক আছেন।

ধনীর সংখ্যা বাড়া ভালো খবর। কিন্তু একই দিনে বিআইডিএসের গবেষণা তথ্য পাওয়া গেল: দেশে নতুন করে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। শহুরে শ্রমিকদের আয় কমেছে ৮০ ভাগ, গ্রামের ১০ ভাগ। এর মধ্যেই আরেক খবর: বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের অধীনে ২৫টি পাটকল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে একসঙ্গে বেকার হবেন প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক। মানে ২৫ হাজার পরিবারের জন্য এ এক বিরাট দুঃসংবাদ। করোনার সর্বগ্রাসী হতাশা, দারিদ্র্য আর বেকারির ছোবলের মধ্যেই এরকম একটা সিদ্ধান্ত হলো! হতে পারল! বিশ্বব্যাপী যখন পাটের সোনালি সময়,Ñ বাংলাদেশে তখন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলশ্রমিকদের একসঙ্গে সবার জন্য বিদায়ের ডাক এল।

হ্যাঁ, এসব সংবাদের মধ্যে কোটিপতি ক্লাবের সংখ্যাবৃদ্ধির খবরই বেশি প্রচার পাবে বলে অনুমান করছি। দেশে বেশি বেশি মানুষ লাখপতি থেকে কোটিপতি হচ্ছে। এর চেয়ে বড় উন্নয়ন আর কী হতে পারে। ওই খবর অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট আমানতধারীর সংখ্যা ১০ কোটি ৬৫ লাখ ৯৫ হাজার ২১১। মোট আমানত ছিল ১২ লাখ ১৪ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা। তার প্রায় ৪৩ দশমিক ৩৯ শতাংশই কোটিপতিদের আমানত। অর্থাৎ দেশের অর্থবিত্তের পরিমণ্ডলে কোটিপতির উপস্থিতিই প্রধান হয়ে উঠছে। কিন্তু এ রকম ‘ইতিবাচক’ খবর নিয়েও উৎসব করা যাচ্ছে না। কারণ, একই সময় বিআইডিএসের গবেষকেরা (বিনায়ক সেন, মনজুর হোসেন, কে এ এস মুরশিদ) মাঠ থেকে তুলে আনলেন একগুচ্ছ নির্মম শঙ্কার কথা। সেখানে দেখা যাচ্ছে, করোনার আগে মোট বেকার ছিল ১৭ শতাংশ। করোনার কারণে নতুন করে ১৩ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছে। এই ধারা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, আমরা কেউ জানি না। বিআইডিএস দেশকে সতর্ক করল মাত্র। গবেষক ড. মনজুর হোসেনের গবেষণায় জানা গেল, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে শুধু দুই মাসের ক্ষতিই প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা। কীভাবে এসব ক্ষতি পোষাবে মানুষ? কীভাবে তারা টিকে থাকবে? কোনো উত্তর নেই কোথাও। বর্তমানের মতোই ভবিষ্যৎ তাদের চরম অশ্চিয়তায় ভরা। এই খাতের ৬৩ ভাগ কর্মী বলেছেন আসন্ন দিনগুলোতে বেতন পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা।

কাণ্ডজ্ঞান বলছে, এই অনিশ্চয়তা রুখতে পারত সম্পদের সুষম বণ্টন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোটিপতি সংক্রান্ত হালনাগাদ উপাত্তই জানাচ্ছে দেশে সম্পদ ছিল এবং আছে। কিন্তু সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়ে আছে মুষ্টিমেয়র হাতে। ব্যাংক হিসাবের কোটিপতি ছাড়াও দেশে অন্যান্য সম্পদে কোটিপতি আছেন লাখে লাখে। এই সম্পদশালীরা এ দেশ থেকেই সম্পদের মালিক হয়েছেন এবং হচ্ছেন। কিন্তু যঁাদের শ্রমে আর যেসব ভোক্তার কল্যাণে এই সমৃদ্ধি, তঁারা করোনাকালে জীবন-জীবিকা দুটোতেই বিপন্ন। এই শ্রমিক কিংবা ভোক্তাদের রক্ষা করতে সম্পদশালীদের তহবিলের সামান্য হিস্যা দরকার আজ। এটা দরকার মানুষ বাঁচাতে রাষ্ট্রীয় কর হিসেবে।

কোটিপতি ও দরিদ্রের সহাবস্থান কুৎসিত

কোটিপতি ও দরিদ্রের আধিক্য ও সহাবস্থান কুৎসিত। এটা নৈতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক—কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। দীর্ঘ মেয়াদে সহনীয়ও নয়। বৈষম্য আজ দেশে বহুমুখী। সম্পদে বৈষম্য, আয়ে বৈষম্য, ভোগে বৈষম্য। বিবিধ বৈষম্যের চূড়ান্ত রূপ দেখা যাচ্ছে দেশজুড়ে। নানা পদক্ষেপে তা কেবল বাড়তি গতি পাচ্ছে।

অতীতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও বলেছে, অর্থনীতি যত ছোটই হোক, বাংলাদেশের বড় বৈশিষ্ট্য এখানে সহজে ‘সম্পদ তৈরি’ করা যায়। ‘দক্ষ’ অনেক ‘উদ্যোক্তা’ তা কাজে লাগিয়েছেন এবং লাগাচ্ছেন; নানা নীতি–সহায়তা পেয়ে চলেছেন। গত মাসে ব্রিটেনের গবেষণা সংস্থা ওয়েলথএক্স-এর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে গুটি কয়েকের সম্পদ বাড়ছে, এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশ সবার ওপরে। ২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বিশ্বের দ্রুত সম্পদশালী হওয়া যায় এমন বাজারগুলোতে ৫০ লাখ ডলারের বেশি সম্পদধারী জনগোষ্ঠীর বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে ছিল ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। বাংলাদেশের পরে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে ভিয়েতনাম ও চীন। অর্থাৎ বাংলাদেশে সম্পদের কুক্ষিগতকরণ এবং পুঞ্জিভবন খুব দ্রুত হচ্ছে। নানা সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে একটা শ্রেণি এটা করতে পারছে। কিন্তু সম্পদ তৈরির এই ‘সোনার খনি’ নিশ্চয়ই টিকিয়ে রাখতে হবে তাদের। করনীতি হলো তার বৈধ উপায়। সমাজের অসমতা চরমভাবে বেড়ে গেলেÑ তাতে লাগাম টেনে ধরার অন্যতম উপকরণ করকাঠামোর সংস্কার। উন্নত দেশগুলোতে অতি ধনীদের সম্পদের একটা অংশ বাড়তি কর হিসেবে সমাজে সুবিধাবঞ্চিত নিচুতলার মানুষদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আবাসনে বিনিয়োগ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা হচ্ছে কই? এককালে যে পাটকল খাত সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা করেছে, সেই পাটকল আমরা লোকসানি প্রতিষ্ঠান বানিয়ে শ্রমিকদের দোষারোপ করে এখন পুরো খাতই বন্ধ করে দিচ্ছি। পাটকল করপোরেশন ও মন্ত্রণালয়ের বিপুল কর্মকর্তা-সমাজ তাহলে এত দিন কী দক্ষতা প্রদর্শন করলেন? কার পাপে ২৫ হাজার শ্রমিক আজ চাকরি হারাচ্ছেন? করোনাকালে এসব পরিবারের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা কারখানা বন্ধের এই সংবাদে মানসিকভাবে কেমন ভেঙে পড়বে, সে কথা কি একবারও ভেবেছি আমরা? কার দোষে কার ভবিষ্যৎ গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে?

যদি দরিদ্র খেটে-খাওয়া জনগোষ্ঠীর ওপর একের পর এক আঘাত আসতে থাকে আর উল্টো দিকে কোটিপতির সংখ্যা বাড়তে থাকে, তাহলে তা দীর্ঘ মেয়াদে দেশের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে। এ অবস্থা জাতীয় স্বার্থবিরোধী। অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলামের ভাষায়, সমাজের ওপরতলার ১০ ভাগ মানুষ নিচুতলার ১০ ভাগের চেয়ে ১৯ গুণ বেশি ‘আয় করার সুযোগ’ পাচ্ছে। এই অস্বাভাবিক অবস্থা আর কত দিন চলতে পারে? দেশের শীর্ষস্থানীয় পেশাদার গবেষকেরা তাঁদের তথ্য-উপাত্তে সমাজ নিরন্ন হয়ে ভেঙে পড়ার কথাই জানাচ্ছেন। আমরা কি দুই ডলারের নিচের কোটি কোটি মানুষের জীবনের অধিকার কেড়ে নেওয়ার দিকে এগোতে থাকব? নাকি সম্পদ পুনর্বণ্টনের দিকে যাব? সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়তো এবার পেরিয়ে যাচ্ছে। বিনায়ক সেনরা সে কথাই জানিয়ে ইতিহাসের কাছে দায়মুক্ত হয়ে থাকলেন।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক