করোনা ও বানে কুড়িগ্রাম আজ দিশেহারা

‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো দেশের সবচেয়ে গরিব জেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। একটি দৈনিক পত্রিকার সূত্র অনুযায়ী কুড়িগ্রামে ‘আড়াই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত’। কুড়িগ্রামের পাঁচ শতাধিক চরের লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দী। ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা-ধরলা নদীর পানি বেড়ে গেছে। বৃষ্টি আর উজানি ঢলে এই বন্যা। এ জেলায় কোনো কোনো বছর তিনবার বন্যা হয়। আবহাওয়ার পূর্বাভাস সূত্রেই জানা গেছে, এ জেলায় দুবার বন্যা হবে। বন্যার আগাম খবর জেনেও অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও নির্বিকার থেকেছে সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। অনেক সবজিখেত, বীজতলা এখন পানির নিচে। অনেক এলাকায় দেখা দিয়েছে ব্যাপক ভাঙন। চোখে অন্ধকার দেখছেন এখানকার মানুষ।

কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের কালিরহাটে বাড়ি মিলনের। কয়েক দিন ধরে তিনি আমাকে ফোন দিচ্ছেন। একটাই কথা, ‘ভাই, হামার জন্যে একটা কিছু করেন। তিস্তা নদীত হামার সব শ্যাষ হয়া যাইবে।’ বন্যা শুরু হওয়ার আগে থেকেই তিস্তা সেখানে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। তিস্তার ভাঙনে তিস্তাতীরবর্তী হাজার হাজার মানুষের বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হলেও সরকারের যে তাতে খুব বেশি কিছু আসবে বা যাবে, তা তো নয়। শুধু কুড়িগ্রামে বাড়বে গরিব মানুষের সংখ্যা।

কুড়িগ্রামে নদ-নদীর সংখ্যা ৫০–এরও বেশি। বর্ষা মৌসুমে কুড়িগ্রামের অধিকাংশ ভূমি পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় থাকে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৎপরতা বর্ষায় বৃদ্ধি পায়। যখন নদীর কাজ করা প্রয়োজন, তখন নদীর পাড়ের সংস্কার না করে বর্ষা মৌসুমে তৎপরতা বৃদ্ধি দেখে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেন। তাতেই–বা কার কী আসে–যায়।

করোনাকালে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কতখানি বন্যার কথা মনে রেখেছে, তা বন্যার শুরুতেই কিছুটা আঁচ করা যাচ্ছে। পানিবন্দী মানুষের পাশে সরকারের সহায়তা সামান্যই। বন্যা প্রাকৃতিক নিয়মে হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু যে সামান্য পানিতে ভয়াবহ বন্যা হচ্ছে, তা হতো না যদি নদীগুলোর প্রতি যথাযথ পরিচর্যা থাকত। পরিচর্যার অভাবে প্রতিবছরের তুলনায় পরবর্তী বছরগুলোয় কম পানিতে বন্যা আসে। তবু সরকারের দায়িত্বশীল দপ্তরগুলোর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায় না।

প্রতিবছর কুড়িগ্রামে বন্যায় অসহায় মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা যায় না। সরকারিভাবে যে সহায়তা দেওয়া হয়, তা নামমাত্র। প্রতিবছর দেশের সহৃদয় ব্যক্তিরা কুড়িগ্রামবাসীর জন্য অর্থ সংগ্রহ করে পাঠান। করোনাকালে এ বছর বন্যার্তদের পাশে তাদের পাওয়ার আশা করাটা বোকামি হবে।

এবার ভাবুন তো কুড়িগ্রামের মানুষ কেমন আছে? এ জেলায় ১০০ জন মানুষের মধ্যে ৭১ জন গরিব। প্রতিবছর বন্যায় এই সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ে। কারণ, হাজার হাজার মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়। লাখ লাখ হেক্টর জমির ফসল নদী খায়। সেই জেলার জনগণ করোনাকালে সামান্যই সহায়তা পেয়েছেন। তারাই এখন বন্যাকবলিত। জনবিচ্ছিন্ন নেতার পক্ষে এসব উপলিব্ধ করা কঠিন। অথচ এ সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের নেতাদের কোনো বিকল্প নেই।

কুড়িগ্রাম দেশের সবচেয়ে গরিব জেলা। এ জেলার এই কলঙ্কতিলক মুছে ফেলার চেষ্টা কোনো সরকার কখনোই করেনি। যুগের পর যুগ উন্নয়নের তলানিতে পড়ে আছে কুড়িগ্রাম নামক এক অসহায় জেলা। এ জেলার প্রকৃত অভিভাবক খুঁজে পাওয়া কঠিন। মনে হবে—মায়ে তাড়ানো, বাপে খেদানো শিশুর মতো। দেশের উন্নয়নের সূচক যতই ঊর্ধ্বমুখী, সরকারি অবহেলায় কুড়িগ্রাম ততই নিম্নমুখী।

করোনাকালেও গরিবপ্রতি সরকারি বরাদ্দ পাওয়া দেশের সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা দু–চারটি জেলার একটি হলো কুড়িগ্রাম। গরিব পরিবারপ্রতি আড়াই হাজার করে যে টাকা দেওয়া হয়েছে কুড়িগ্রামে, তাও গরিব পরিবারের সংখ্যা বিবেচনায় নগণ্য। বরং ধনী জেলাগুলোতেই গরিবপ্রতি বরাদ্দ বেশি দেওয়া হয়েছে। ‘তেলা মাথায় তেল দেওয়া’র নীতি যেন বজায় রাখা হয়েছে। কোনো জনপ্রতিনিধিকে এসব নিয়ে তৎপর হতে দেখিনি। বরং তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন কুড়িগ্রামের বিত্তশালী রাজনীতিকেরা। না-দেখার ভান করেছেন দায়িত্বশীল(!) ব্যক্তিরা। অন্ধ হলে তো আর প্রলয় বন্ধ থাকে না।

কুড়িগ্রাম জেলা থেকে সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় হাজার হাজার কর্মহীন মানুষ যান কাজের সন্ধানে। অনেকেই রিকশা চালান, অনেকে বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেন। তাঁদের উপার্জিত টাকা এ জেলার রেমিট্যান্সের মতো। করোনাকালে সেই কাজও অনেকটাই বন্ধ। করোনাকালে সারা দেশে অনেকে মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নমধ্যবিত্ত হচ্ছে। আর কুড়িগ্রামের দরিদ্র জনগণ হচ্ছে হতদরিদ্র, নিম্ন–মধ্যবিত্ত হচ্ছে নিম্নবিত্ত।

সম্প্রতি প্রথম আলো পত্রিকা কুড়িগ্রামের সংকট নিয়ে চারটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনগুলোর শিরোনাম হচ্ছে ‘কাজ নেই, অভাবী মানুষের কষ্ট’, ‘চিলমারীর ঘরে ঘরে অভাব’, ‘নদীর মতো অভাবেরও সীমানা নেই’, ‘কাজ নেই, দিশেহারা অভাবী মানুষ’। এই প্রতিদেবনগুলোর মাধ্যমেও কুড়িগ্রামের করুণ চিত্র ফুঠে উঠেছে। সারা দেশের সচেতন মানুষমাত্রই জানেন কুড়িগ্রামের করুণ অবস্থার কথা। করোনাকালে সরকারি সহযোগিতায় যে এ জেলার প্রতি চরম বৈষম্য করা হয়েছে, এটিও সরকারে থাকা বিজ্ঞজন না জানার কথা নয়।

কুড়িগ্রাম বানের জলে ভেসে আসা কোনো জনপদ নয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ জেলারও আছে সক্রিয় অংশগ্রহণ। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এ জেলারও অগণিত মানুষ অকাতরে জীবন দিয়েছেন। দেশের সবচেয়ে বড় মুক্তাঞ্চল এ জেলাতেই। এ জেলায় মোট উৎপাদিত খাদ্যশস্য এ জেলার মানুষের চাহিদার দ্বিগুণ। তারপরও এ জেলার প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ কি অব্যাহত থাকবে? পিছিয়ে থাকা জেলাগুলোর জন্য বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করার কোনো বিকল্প নেই।

প্রধানমন্ত্রী, আপনি তো জানেন, কুড়িগ্রামের মানুষ চাইতেও জানে না। যে জেলার মানুষ চাইতে না জানার কারণে গরিব, তার জন্য তো আপনি আছেন। অভাব–অনটনে থাকা স্বাভাবিক অবস্থার ৭১ শতাংশ মানুষ আপনার দিকে চেয়ে আছে। করোনায় নতুন করে সংকটে পড়া লাখ লাখ মানুষ আপনার দিকে চেয়ে আছে। নতুন করে সংকটে পড়া বন্যার্ত লাখো মানুষ আপনার দিকে চেয়ে আছে।

তুহিন ওয়াদুদ: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
[email protected]