সংকটকে সম্ভাবনায় নেওয়ার এখনই সময়

স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার পর, ১৯১৮ ও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর, ২০২০
স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার পর, ১৯১৮ ও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর, ২০২০

করোনা পরিস্থিতির কারণে আমরা অনেকেই এখনো গৃহবন্দী। দেশের সবার সঙ্গে, পরিবারের সবার সঙ্গে আমরাও দিন গুনছি, কখন এই দুঃসময় কাটবে, কখন স্বাভাবিক হবে সবকিছু। কবে এই করোনা রোগের ওষুধ-টিকা পাওয়া যাবে, তার নির্দিষ্ট কোনো তারিখ নেই। কবে আমাদের এই অনিশ্চয়তার জীবন কাটবে, তার কোনো হদিস নেই, কবে আবার আমরা আমাদের চিরাচরিত জীবনাচরণে ফেরত যেতে পারব, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। নিষ্প্রাণ হয়ে ঘরে নেতিয়ে আছেন অনেকে। অনেকে কাজে বের হচ্ছেন বটে, তবু সারা দিন আছেন শঙ্কার মধ্যে—কখন না জানি আমারও করোনা হয়ে যায়। করোনা সংক্রমণের হার, করোনায় মৃত্যুর হার এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এই সময়টা অনিশ্চিত, এই সময়টা অসময়।

তবে অসময়ের মধ্যেও কিছু সুসময় লুকিয়ে থাকতে পারে। এই করোনা মহামারির কারণে এই যে আমরা সবাই ঘরে আছি, এটা আমাদের জন্য শাপে বরও হতে পারে। বিশেষত, পারিবারিক বন্ধনের ক্ষেত্রে এই অসময় সুন্দর সুযোগ হয়ে উঠতে পারে। আমাদের অনেকেরই আমাদের মা–বাবার সঙ্গে প্রজন্ম-দূরত্ব রয়েছে। এই দূরত্বের কারণে কখনো কখনো হয়তো আমাদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। সেই মনোমালিন্য কাটানোর, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করার সময়টা এখনই। মা–বাবার কাছাকাছি আসতে পারার চেষ্টাটুকুন করার সময় এখনই। আরও রয়েছে ভাইবোন, তাদের সঙ্গেও সম্পর্কটি সুন্দর বা সুন্দরতর করে আনার ফুরসত পাওয়া গেছে। এমনি করে মা–বাবা, ভাই-বোনের সঙ্গে সম্পর্কটি সহজ-স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে। পরিবারের সবার সঙ্গে গল্প করে, আড্ডা দিয়ে, তাশ-লুডু খেলে আমরা একটা চমৎকার সময় কাটাতে পারি, যেটা আমাদের কাছে থেকে এই করোনা মহামারিও কেড়ে নিতে পারবে না।

আবার আত্মোন্নয়নের জন্যও কিছু কাজ করা যেতে পারে। করোনার সময় আমাদের অনেক আকাঙ্ক্ষিত একটি অবসর দিয়েছে, যেটি সাধারণত পাওয়া যায় না। কিছু বই হয়তো ঘরে পড়ে রয়েছে, কখনো পড়া হয়নি—সেগুলো পড়ার সময় এখন। কিছু সিনেমা হয়তো দেখি দেখি করেও দেখা হয়নি—সেগুলো দেখার সময় এখন। কিছু জিনিস হয়তো শিখতে চেয়েও শেখা হয়নি, সেগুলো শিখে নেওয়ার সময় এখন। অনেক দিন ধরে ব্যায়াম করার কথা ভেবেও করা হচ্ছে না—শুরু করার সময় এখন। সময় কাটানো বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, যদি আত্মোন্নয়নের ক্ষুধা না থাকে। আত্মোন্নয়নের ক্ষুধাটাকে জাগিয়ে তুলতে হবে, যাতে করোনাকালটা ভালো কাটে আর এই সময়ের শেষে নতুন এক মানুষ হয়ে উঠতে পারি আমরা।

আমাদের মধ্যে অনেকের আবার কিছু বদভ্যাস আছে। এর মধ্যে একটা বড় বদভ্যাস আবার গড়ে উঠছে এই করোনা মহামারির আমলে। বিশেষত, যাদের কাজে ঘরের থেকে বের হতে হচ্ছে না, তাদের মধ্যে গড়ে উঠছে দেরি করে ঘুমানো আর দেরি করে ওঠার এই বদভ্যাস। সার্কাডিয়ান রিদমের এই ওলট–পালট আমাদের কবজায় আনতে হবে। নিয়মিত ঘুম হলে আমাদের দিন হবে আরও উপভোগ্য, আর শরীরে ক্লান্তি থাকবে না। করোনাকালে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে চাঙা রাখা দরকার, আর তার জন্য একটা নিয়মিত জীবনাচরণের বিকল্প নেই।

করোনা মহামারিকে আবার অনেকে মানুষের ওপর পৃথিবীর অভিশাপ হিসেবে দেখছেন। তা–ই যদি হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের অনেক ভাবনার কাজ বাকি রয়ে গেছে। আমাদের ভাবতে হবে, কেন আমাদের ওপরে নেমে এল এই অভিশাপ? কেমন করে পৃথিবীকে কষ্ট দিয়েছি আমরা? আমাদের কোন কোন অসভ্য স্বেচ্ছাচারিতায় পৃথিবীর প্রাণবায়ু দমে এসেছে? সেসব ভাবনার পরে যে উত্তরগুলো আমরা পাই, সেগুলোও একেকটা বদভ্যাস। প্লাস্টিক, পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার, ধূমপান, প্রয়োজন ছাড়া একা গাড়ি ব্যবহার করা—এসব বদভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। করোনার আমল কেটে গেলে কেমন মানুষ হয়ে আমরা পৃথিবীর বুকে ফিরতে চাই, সেটা আমাদের ভাবতে হবে। যে মানুষ হয়ে আমরা করোনাকালে প্রবেশ করেছি, তার চেয়ে ভালো হয়ে আমাদের পৃথিবীর কাছে ফিরতে হবে—এমনটাই হোক আমাদের পরিকল্পনা।

আমাদের এখনকার সময়টা আবার প্রতিবাদেরও। আমাদের সামনেই হয়ে যাচ্ছে একের পরে এক অবিচার। সুন্দরবনের ঘাড়ের ওপরে রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে উঠছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে একের পর এক সাংবাদিক, শিক্ষক, এমনকি কিশোরও গ্রেপ্তার হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেখা যাচ্ছে অপরিমেয় অব্যবস্থাপনা আর ত্রুটি। এগুলো নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে, কথা বলতে হবে, লিখতে হবে। প্রতিবাদের ভাষা যাতে কোনো কালাকানুনের চাপে নেই না হয়ে যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে।

সবশেষে, আমাদের এই সময়টা হলো প্রস্তুতির। করোনা একসময় কেটে যাবে হয়তো, তবে রাষ্ট্রের যে অব্যবস্থাপণা করোনা উন্মোচন করে দিয়েছে বা যেটিকে আমরা চোখের সামনে দেখছি, সেটি রয়ে যাবে। সেই অন্যায্য ব্যবস্থাকে ন্যায্যতার শাসনে রূপান্তরিত করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে এখনই। এখনই সময় সম্মিলিত ভাবনায় কাজ শুরু করার।

*অনুপম দেবাশীষ রায়: লেখক ও রাজনীতিবিদ্যা বিষয়ে গবেষক।